বজ্রপাতে এত মৃত্যু, হুশ হচ্ছে কি

বছরে ৮০ থেকে ১২০ দিন বজ্রপাত হয় বাংলাদেশে

বাংলাদেশে বছরে ৮০ থেকে ১২০ দিন বজ্রপাত হয়। যুক্তরাষ্ট্রের কেন্ট স্টেট ইউনিভার্সিটির ডিপার্টমেন্ট অব জিওগ্রাফির অধ্যাপক ড. টমাস ডব্লিউ স্মিডলিনের ‘রিস্ক ফ্যাক্টরস অ্যান্ড সোশ্যাল ভালনারেবিলিটি’ শীর্ষক গবেষণা মতে, ‘প্রতিবছর মার্চ থেকে মে পর্যন্ত বাংলাদেশে প্রতি বর্গকিলোমিটার এলাকায় ৪০টি বজ্রপাত হয়।’ উপরন্তু এ সময়ে কালবৈশাখী হয়। বছরে দেড় শর মতো লোকের মৃত্যুর খবর বিচ্ছিন্নভাবে সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হলেও প্রকৃতপক্ষে এ সংখ্যা ‘পাঁচ শতাধিক’ বলে আবহাওয়াসংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলে থাকে। বজ্রপাত-ভয়াবহতার এমন প্রেক্ষাপটে টেকসই দৃষ্টিকোণ থেকে শিক্ষাসচেতনতা, বনায়ন, নির্মাণশিল্প, বিদ্যুৎ ও টেলিকম অবকাঠামোর সমন্বিত ও ঝুঁকিপূর্ণ দিকগুলোর ওপর নজর দেওয়ার সমন্বিত প্রয়াস জরুরি। ভাসমান শ্রম কিংবা ধান কাটার মতো উন্মুক্ত কাজে নিয়োজিত পেশাদার শ্রমিকের মৃত্যুর বিষয়টি ভাবনার দাবি রাখে।

বজ্রপাত নিরোধক বৃক্ষায়ন
আমাদের গ্রামগুলোয় উঁচু গাছ কমে যাচ্ছে। মধ্যবয়স থেকে একটি গাছের মোটাসোটা ও লম্বা হতে সময় বেশি লাগে বলে ব্যবসায়িক বনায়ন মডেলে দ্রুত বাড়ন্ত মাঝারি গাছ কেটে ফেলা হয়। নির্দিষ্ট দূরত্বে উঁচু গাছ রাখার মতো সচেতনতা ও পরিবেশবিষয়ক জ্ঞান লোপ পেয়েছে। শিক্ষাব্যবস্থা, সমাজব্যবস্থা ও স্থানীয় সরকার পরিবেশ সংরক্ষণ ও সুরক্ষার প্রাকৃতিক জ্ঞান বিস্তারে নিদারুণ অযোগ্যতা দেখাচ্ছে। জনপ্রতিনিধিরা পরিবেশ সংরক্ষণ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার প্রাকৃতিক জ্ঞানে পশ্চাৎপদ, যাঁদের সঙ্গে টেকসই পরিবেশবিষয়ক জ্ঞানের দূরতম সম্পর্ক নেই। তাঁরাই রাতের আঁধারে সড়ক ও সামাজিক বনায়নের উঁচু–লম্বা গাছ চুরি করে বিক্রি করেন। গৃহায়ণ ও নৌকার ধরন পরিবর্তন হয়ে যাওয়ায় তালগাছের চাহিদাও কমেছে।

প্রতিকার হিসেবে গত বছর সরকার সারা দেশে ১০ লাখ তালগাছ লাগানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। পরে শোনা গিয়েছে, তালগাছ লাগানো হয়নি, কয়েক লাখ তালের আঁটি রোপণ করে দায়িত্ব সারা হয়েছে। দুর্নীতিপ্রবণ বাস্তবায়নের কালে গাছ দৃশ্যমান করা বেশ ঝামেলার বলে আঁটিতেই লুটের খোয়াব মিটেছে সম্ভবত! গাছগুলো সত্যি সত্যি রক্ষণাবেক্ষণ করে বড় করলেও প্রশাসনের বজ্রনিরোধন পরিকল্পনা কাজে আসতে আরও ১৫ থেকে ২০ বছর লাগতে পারে, যদি গাছগুলো অসময়ে চুরিতে না পড়ে! তথাপি এই দীর্ঘ মধ্যবর্তী সময়ে বিকল্প পরিকল্পনা চাই। গ্রাম ও শহরের আবাসিক এলাকাগুলোর প্রতি ৫০ বর্গমিটার এলাকায় অন্তত একটি করে ৪০ মিটার বা তার কাছাকাছি উচ্চতার গাছ থাকা চাই। বিস্তীর্ণ ফসলের মাঠ, জলাশয় কিংবা হাওরে কাজ করা কৃষক-জেলের নিরাপত্তা–সতর্কতা বিষয়েও ভাবতে হবে। কাজগুলো বন ও পরিবেশ এবং দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিভাগ যৌথভাবে করতে পারে।

নার্সারিভিত্তিক বনায়নের অটেকসই দিক
দেশের সামাজিক বনায়ন টিকিয়ে রেখেছে ব্যক্তি খাতের নার্সারিকেন্দ্রিক চারা উৎপাদনব্যবস্থা। যেহেতু আমাদের নার্সারিতে বীজ থেকে চারা তৈরির প্রক্রিয়া খুবই বাণিজ্যিক এবং স্থানসংকটে আবর্তিত, তাই এখানে চারা গাছে প্রধান মূল থাকল কি না, এটা একেবারেই বিবেচ্য নয়। নিতান্তই সামান্য মাটি ও অবলম্বনের খুঁটিতে গাছ বড় করে পরিবহন ও বিক্রি করা হয়। এ কারণে প্রধান মূলহীন গাছ একটু বড় হলে সহজেই ঝড়ে উপড়ে পড়ে। মানুষ কিংবা স্থাপনা বাঁচিয়ে বজ্রের আধানকে নিরপেক্ষ (চার্জ নিউট্রালিটি) করতে দরকার অনেক উঁচু গাছ। গতানুগতিক চারায়নের বিপরীতে নার্সারির চারা উৎপাদকে প্রধান মূল রেখেই টেকসই করতে বন বিভাগের বোধোদয় ও কারিগরি সহায়তা একান্ত প্রয়োজন। নির্দিষ্ট দূরত্বে রোপিত বজ্রপাত ব্যবস্থাপনার গাছগুলোকে প্রধান মূলসহ উৎপাদন এবং রোপণ–পরবর্তী বিশেষ সংরক্ষণের ব্যবস্থাটা করা হোক।

উঁচু শহুরে দালানে বজ্রনিরোধক টাওয়ার স্থাপন
শহরে উঁচু গাছ খুবই কম। তবে শহরে বজ্রনিরোধ ব্যবস্থাপনা খুবই সহজ। শহরে উঁচু ভবন আছে, কিন্তু ভবনের ওপরে বজ্রনিরোধক টাওয়ার রাখার সমন্বিত ও কেন্দ্রীয় নির্দেশনা নেই। শহরের উঁচু দালানে বজ্রনিরোধক লাইটনিং সার্জ এরেস্টার টাওয়ার বসানো বিশ্বের বড় বড় শহরে বেশ প্রচলিত। একটি নির্দিষ্ট দূরত্বে উঁচু শহুরে দালানে বজ্রনিরোধক টাওয়ার স্থাপন করে বজ্রপাতের ক্ষতি কমিয়ে আনা যায়, এসব টাওয়ারে অনেক দীর্ঘ উল্লম্ব উচ্চতার লাইটনিং অ্যারেস্টার থাকবে, যা বজ্রপাত কিংবা বৈদ্যুতিক আধানকে নিরপেক্ষ বা নিউট্রালাইজ করবে। সাধারণত শহুরে ভবনে ইচ্ছামাফিক বৈদ্যুতিক আর্থিং ব্যবস্থা থাকে, নকশামাফিক টেকসই আর্থিং থাকে না বলে বজ্রপাতে ওই সব ভবনে আগুন ধরতে পারে এবং না ধরলেও বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতি বিকল হয়।

টেকসই আবহাওয়ার পূর্বাভাস
ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস, কালবৈশাখীসহ বজ্রপাতের স্থানভিত্তিক আবহাওয়ার পূর্বাভাস বিষয়ে মানুষ সচেতন নয়। বর্তমানে কোন এলাকায় কোন সময়ে ঠিক কতটি সম্ভাব্য বজ্রপাত হবে, তা সহজেই আবহাওয়াবিষয়ক অনলাইন সফটওয়্যারের মাধ্যমে জানা যায় (<https://weather. us/lightning/bangladesh>)। উদাহরণস্বরূপ ওয়েদারডটইউএস সাইটে দেখা গেছে, বাংলাদেশের কিছু কিছু অঞ্চলে কালবৈশাখী মৌসুমে বিদ্যুৎ চমকানোর স্থায়িত্বকাল ‘এজ অব লাইটনিং মিনিট’ ৪০ থেকে ৫৫ মিনিট, যা বৈশ্বিক হারে প্রায় সর্বোচ্চ। বজ্রপাতের পূর্বাভাস নিখুঁতভাবে মোবাইল সেবাদাতা কোম্পানির ‘লোকেশন এরিয়া’ তথ্যশালা অনুসারে মোবাইল খুদে বার্তায় পাঠানোর ব্যবস্থা করা খুবই সহজ কাজ। অর্থাৎ দ্বিতীয়–তৃতীয় প্রজন্মের ‘ল্যাক কোড’ ও চতুর্থ প্রজন্মের ‘ট্যাক কোড’–এর সব গ্রাহককে স্থানভিত্তিক পূর্বাভাস ও সতর্কতা খুদে বার্তায় পাঠানোর ব্যবস্থা হবে একটা টেকসই কাজ।

জলবায়ু পরিবর্তনের তীব্র ঝুঁকির মুখে আবহাওয়া গবেষণা অতি প্রয়োজনীয় হয়ে উঠেছে। দুঃখজনক যে দক্ষিণ এশিয়ার একমাত্র আবহাওয়া ও জলবায়ুবিজ্ঞান গবেষণা প্রতিষ্ঠান সার্ক আবহাওয়া গবেষণা কেন্দ্র (শেরেবাংলা নগর, ঢাকা) বন্ধ করে এর গবেষক ও বিজ্ঞানীদের চাকরিচ্যুত করার ঘটনা ঘটেছে। আবহাওয়া পূর্বাভাস ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় আন্তর্জাতিক আবহাওয়া স্যাটেলাইটগুলোর তথ্য নিখরচায় ব্যবহার করা যায়। আবহাওয়ার গাণিতিক মডেল, কৃত্রিম ভূ-উপগ্রহ, রাডার এবং মোবাইল সেবার বোধগম্য ব্যবহার নিশ্চিত করে প্রাণ ও সম্পদের ক্ষতি কমানো যায় অনায়াসেই।

টেকসই বৈদ্যুতিক অবকাঠামো
শহুরে আবাসিক এলাকাসহ দেশের বিতরণ লাইনের সিংহভাগ এখনো ওভারহেড, যা বজ্রপাতের ঝুঁকি বাড়াচ্ছে। এসব বিতরণ লাইনের আর্থিং ব্যবস্থাপনা মান প্রশ্নাতীত নয়, কেননা উচ্চ লোডের কারণে এমনিতেই সময়ে–সময়ে ট্রান্সফরমার, এমনকি লাইনগুলোয় স্পার্কিং দেখা যায়। বিদ্যুৎ সঞ্চালনের জাতীয় গ্রিড লাইনে উচ্চমান বজ্রনিরোধক ব্যবস্থা থাকার কথা, তথাপি সেগুলো ডিজাস্টার ক্যাপাবল কি না, তা পুনর্মূল্যায়ন করা দরকার। কেননা, বজ্রপাতের হার সময়ের সঙ্গে বেড়েছে। নতুবা অবকাঠামোগত বড় ক্ষতি হওয়ার সুযোগও থেকে যাচ্ছে।

জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি
জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বজ্রপাত আরও ঘন ঘন হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। বিশ্বের উষ্ণতা বৃদ্ধির কারণে বজ্রপাত আরও ঘনঘন হবে। এমনকি বায়ুদূষণেও বজ্রপাত বাড়ার আশঙ্কা রয়েছে। ঢাকার আবাসিক এলাকাগুলোর ভূমির উষ্ণতা পার্শ্ববর্তী এলাকা থেকে অন্তত ৬ থেকে ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেশি, বাতাসের উষ্ণতাও তেমনই বেশি। নিরন্তর জ্যামে জ্বালানির দহন, অত্যধিক গরমের শহরে শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্রের অতি ব্যবহার, শক্তির যাবতীয় রূপান্তর, এনার্জি কনভারশন—এসব মিলে উষ্ণতা ও দূষণ দুটোই বাড়াচ্ছে।

টেলিকমের পরিবেশবান্ধব টাওয়ার নীতিমালা
বজ্রনিরোধক ব্যবস্থাপনার একটা বিকল্প সমাধান হতে পারে প্রতিটি মোবাইল টাওয়ারের সঙ্গে অন্তত ৪৫ থেকে ৫০ মিটার উচ্চতায় থাকা বজ্রনিরোধক (লাইটনিং এরেস্টার) বসানোর বাধ্যবাধকতা। দেশে টেলিকমের টাওয়ার বসানোর পরিবেশবান্ধব টেকসই পরিকল্পনা নেওয়া হয়নি। বাড়ির ছাদে কিংবা উঁচু দালানের সাইড ওয়ালে বড় বড় অ্যানটেনা মাউন্টেড টাওয়ার করার কারণে এগুলো বজ্রপাত আকর্ষণ করে, ফলে বাড়িগুলো ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে ওঠে। সাধারণত, এসব টাওয়ারের নিজস্ব আর্থিং ব্যবস্থা থাকে (ছোট লাইটনিং অ্যারেস্টার), যা পার্শ্ববর্তী এলাকার বজ্রনিরোধনে কাজে আসে না। বরং ঘনঘন বজ্রপাতে টাওয়ারসংযুক্ত বাড়ির বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতিই নষ্ট হচ্ছে। মূলত, উপযুক্ত ভবনের অভাবে কিংবা উচ্চ ক্ষমতার জন্য গ্রিনফিল্ড টেলিকম টাওয়ার হয়, বাদবাকি টাওয়ার যেনতেনভাবে বসতবাড়ির ছাদে বসানো হয়। এই বাড়িগুলো সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং গাইডলাইন ও নকশা দিয়ে বানানো নয় বলে বেশ ঝুঁকিপূর্ণ। তরঙ্গ দূষণরোধে বিটিআরসিকে পরিবেশ ও স্বাস্থ্যবান্ধব তড়িৎ-চুম্বকীয় তরঙ্গ সঞ্চালন ও রেডিও অ্যানটেনা স্থাপনের সমন্বিত পরিবেশবান্ধব নীতিমালা তৈরি করতে হবে। যত্রতত্র বাড়ি ছাদে, উঁচু বাড়ির সাইড ওয়ালে টেলিকমের অ্যানটেনা মাউন্ট করে একদিকে নাগরিকের স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়াচ্ছে, অন্যদিকে এগুলো বজ্রপাতেও ঝুঁকিও তৈরি করছে।

সার্বিক নগর বনায়ন
গত দশকে নগর বনায়ন একেবারেই অবহেলিত থেকেছে। দুর্বৃত্তরা শুধু গাছই কেটেছে। সোহরাওয়ার্দী উদ্যান, ওসমানী উদ্যান, বনানী, গুলশান ও বিমানবন্দর সড়কের উন্নয়নের নামে নির্বিচার বৃক্ষনিধন হয়েছে। সড়কের পার্শ্ব ও সড়কদ্বীপের বনায়ন যা ছিল, তাও ধীরে ধীরে কমে আসছে। বজ্রঝুঁকি মাথায় রেখে এলাকাভিত্তিক নতুন বনায়ন উদ্যোগ দরকার, যেখানে নির্দিষ্ট দূরত্ব পরপর একটি সুউচ্চ গাছ রাখার পরিকল্পনা হবে।

বজ্রপাতের সময় করণীয়–বর্জনীয়
বজ্রপাতের সময় এবং সম্ভাব্য সময়ে কী কী কাজ করণীয় এবং কী কী বর্জনীয়, তা নিয়ে প্রতিষ্ঠানিক স্কুলশিক্ষা কিংবা অপ্রতিষ্ঠানিক বয়স্ক শিক্ষায় আনা যায়। আবহাওয়া অফিস থেকে বজ্রপাতবিষয়ক সতর্কতা নিয়ে তৈরি একটা পিকচার বুলেটিন ফেসবুকে থাকলেও সাধারণ নাগরিক পর্যায়ে পৌঁছানোর ফলপ্রসূ উদ্যোগ নেই। পরিবেশবিষয়ক প্রাকৃতিক জ্ঞানের বিবিধ বিষয় মসজিদ, পাঠাগার, সমাজকল্যাণ কেন্দ্রের বয়স্ক ও অপ্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় রাখা যায়।

জীবন ও সম্পদের ক্ষতিরোধে টেকসই বজ্রনিরোধক ব্যবস্থাপনা শুরু করা হোক।

ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব টেকসই উন্নয়নবিষয়ক লেখক
[email protected]