বদলে যাওয়া রাজনীতির ‘ডিজিটাল মাঠ’

জগতে একমাত্র পরিবর্তনই স্থির। প্রতিনিয়ত বদলে যাচ্ছে সবকিছু। কোথাও পরিবর্তনটা দ্রুত, তাই নজরে আসে তাড়াতাড়ি। কোথাও পরিবর্তনটা ধীর, অলক্ষ্যেই ঘটে চলে। দ্রুত হোক কিংবা ধীর, পরিবর্তন কিন্তু চলছেই। বদলায় মানুষ, বদলায় সমাজ-রাষ্ট্র, সেই সঙ্গে বদলে যায় রাজনীতির ধরন। আর তাই গতকাল রাজনীতির যে রূপ ছিল চিরচেনা, অনেকেই ভাবতাম এর পরিবর্তন বুঝি অসম্ভব। সবকিছু বদলের ধাক্কায় একদিন দেখা যায়, রাজনীতির সেই চিরচেনা ধরনটাও পাল্টে গেছে আমূল।

এই যেমন কয়েক বছর আগেও কি কেউ কল্পনা করতে পারত বাঘা বাঘা সব রাজনীতিবিদকে বাদ দিয়ে এই উপমহাদেশে নির্বাচনী কৌশল ঠিক করবেন একজন ৩৪ বছরের (বর্তমানে ৪৪) ঝকঝকে তরুণ, যাঁর সঙ্গে দলীয় রাজনীতির তেমন কোনো সম্পর্কই নেই? হ্যাঁ, আমি বলছি ভারতের প্রশান্ত কিশোরের কথা। যথারীতি বর্ষীয়ান রাজনীতিবিদদের প্রবল বাধার মুখেই তৃণমূল কংগ্রেস তাঁকে সর্বশেষ বিধানসভা নির্বাচনের দায়িত্ব দেয়। ফল হয়েছে একটা রাজ্যের নির্বাচনকে ‘মোদি বনাম দিদি’ বানিয়ে ফেলা বিজেপি স্রেফ বিধ্বস্ত হয়ে গেছে তৃণমূল কংগ্রেসের কাছে। মজার ব্যাপার হলো এই ব্যক্তির হাত ধরেই নির্বাচনে প্রথম উত্থান হয়েছিল বিজেপির। অর্থাৎ রাজনীতিতেও ধীরে ধীরে বহুজাতিক কোম্পানির মতোই মার্কেটিং স্ট্র্যাটেজি ঠিক করে পদক্ষেপ নেওয়ার বিশেষজ্ঞ তৈরি হচ্ছে। এ ধরনের রাজনীতি উপমহাদেশে যে হতে পারে, তা কিছুদিন আগেও কেউ কল্পনা করেনি।

আমাদের দেশের রাজনীতিতে ‘মাঠ’ একটি বহুল ব্যবহৃত শব্দ। এমনকি ‘মাঠের রাজনীতি’ বলে আলাদা একটি কথাই প্রচলিত আছে। আজকাল বিরোধী দলের ব্যর্থতা বোঝাতে প্রায়ই বলা হয়, মাঠের রাজনীতিতে কর্মীদের সক্রিয়তা কম। বিরোধী শিবির থেকে উত্তর আসে, সনাতন মাঠে, অর্থাৎ মাঠের রাজনীতির চিরচেনা রূপ—মিছিল, জনসভা, মানববন্ধনে বিরোধী দলকে কম সক্রিয় থাকতে বাধ্য করছে কর্তৃত্ববাদী সরকার। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, বর্তমান সময়ে দাঁড়িয়ে রাজনীতির মাঠকে কি আর কেবল সনাতন মাঠে আবদ্ধ রাখা সম্ভব? ভীষণ রকম একটা পরিবর্তন কি রাজনীতির এই ‘মাঠ’কে ঘিরেও ঘটে যায়নি?

পাঠক, একটু লক্ষ করলেই দেখতে পাবেন, গত কয়েক বছরে রাজনীতির শক্তিশালী মাঠ হিসেবে দাঁড়িয়ে গেছে ‘ডিজিটাল মাঠ’, যাঁর মধ্যে আছে প্রিন্ট এবং ইলেকট্রনিক মিডিয়া, আছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, আছে কলাম লেখা, মূলধারার গণমাধ্যম কিংবা
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে টক শো বা আলোচনা। রাজনীতির চিরচেনা শাশ্বত যে রূপ, তা অনেকটাই এখন ভেঙেচুরে একাকার।

আমাদের মতো কর্তৃত্বপরায়ণ দেশে ডিজিটাল মাঠের এ রাজনীতিও আসলে যুদ্ধই। অনেক ক্ষেত্রে এটি সনাতন মাঠের যুদ্ধের চেয়ে বেশি বিপজ্জনক। ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট নামের এক ভয়ংকর অস্ত্রের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে এ যুদ্ধ করতে হয়।

রাজনীতিতে ‘ডিজিটাল মাঠ’ তৈরি হয়েছে আরও আগেই। কিন্তু গত কয়েক বছরে এর প্রসার ঘটেছে মারাত্মক। হাতে হাতে স্মার্টফোন, ইন্টারনেটের প্রসার, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রায় সব শ্রেণি-পেশার মানুষের সরব উপস্থিতি বিষয়টিকে অনেকটা সহজ করে দিয়েছে। তৈরি হয়েছে বুদ্ধিবৃত্তিক রাজনীতির নতুন প্ল্যাটফর্ম, যেখানে মেধার চর্চা, বুদ্ধির উৎকর্ষ দেখানোর সুযোগ রয়েছে। ফলে রাজনীতিতে বহু বছরের মেধার যে খরা আমরা দেখেছি, সেখান থেকে বের হওয়ার একটা পথ সম্ভবত তৈরি হয়েছে। বাংলাদেশের সূচনালগ্ন থেকে রাজনীতিকে ধীরে ধীরে এমন সব মানুষের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে, যাঁদের বাজারমূল্য শূন্য। এঁদের অধিকাংশেরই ব্যবসায়ে পরিণত হওয়া রাজনীতিতে যুক্ত হতে না পারলে হাজার কোটি টাকা বানানো দূরেই থাকুক, মোটামুটি সংসার চালানোই দায় হয়ে যেত।

রাজনীতির মূল বিষয়ই হলো মানুষকে কানেক্ট করা। একটা জনসভায় যত মানুষ জড়ো হয়, তার চেয়ে অনেক বেশি মানুষ একজন প্রিয় আলোচকের টিভি টক শো দেখে বা একটি জাতীয় দৈনিকের কলামে চোখ বোলায়। ফলে মানুষকে কানেক্ট করা যায় সহজেই। একটি জনসভা আয়োজনের যে খরচ আর চাপ, সে তুলনায় বুদ্ধিবৃত্তিক রাজনীতির এই মাঠটা প্রায় বিনা খরচের।

রাজনীতিতে বয়ান তৈরি খুব গুরুত্বপূর্ণ। নতুন স্লোগান, নতুন বয়ান তৈরি করে সেটি সব শ্রেণি-পেশার মানুষের কাছে ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য অতি গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম হলো ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম। বিশেষ করে আমাদের মতো দেশে যেখানে পড়তে-লিখতে পারে না, এমন মানুষ আছে অনেক, সেখানে লেখার (লিফলেট, বুকলেট, পোস্টার) মাধ্যমে রাজনৈতিক বয়ান প্রচারের চেয়ে কথা বলে প্রচার অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। আর এ ক্ষেত্রেও ডিজিটাল মাধ্যম অপ্রতিদ্বন্দ্বী ভূমিকা পালন করতে পারে। একটা জনসভায় কয়েক হাজার লোক জমায়েত করা যেখানে একটা বড় চ্যালেঞ্জ, সেখানে ডিজিটাল মাধ্যমে মুহূর্তেই একজন রাজনৈতিক নেতার বক্তব্য পৌঁছে যাচ্ছে কয়েক লাখ মানুষের কাছে।

মাঠের রাজনীতির চিরচেনা যে রূপ মিছিল, জনসভা, মানববন্ধন, তা সরকার আর প্রশাসনের অনুমতির নানা বেড়াজালে আটকে বিলুপ্তপ্রায়। এমনকি বিরোধী দলের ঘরোয়া সভাতেও সরকারের কড়া নজরদারি। বাদ নেই দোয়া মাহফিলও, সেখান থেকেও কর্মী গ্রেপ্তারের নতুন সংস্কৃতি চালু হয়েছে।

আমাদের মতো কর্তৃত্বপরায়ণ দেশে ডিজিটাল মাঠের এ রাজনীতিও আসলে যুদ্ধই। অনেক ক্ষেত্রে এটি সনাতন মাঠের যুদ্ধের চেয়ে বেশি বিপজ্জনক। ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট নামের এক ভয়ংকর অস্ত্রের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে এ যুদ্ধ করতে হয়। অসংখ্য মানুষ এ আইনের কারণে মামলা এবং কারাবাসের শিকার হয়েছেন। অতি সমালোচিত এ আইনে নন-ডিজিটাল ক্ষেত্রের অপরাধের চেয়ে বেশি শাস্তির বিধান রাখা হয়েছে। শাস্তির পরিমাণ বেশি রেখে সরকার প্রকারান্তরে এ মাঠের অন্তর্গত ক্ষমতারই একধরনের স্বীকৃতি দিয়েছে। এমনকি একটি কার্টুন পর্যন্ত কতটা ভীতির কারণ হয়ে উঠতে পারে, তার জ্বলন্ত উদাহরণ কার্টুনিস্ট আহমেদ কবির কিশোর। কয়েক বছর আগপর্যন্ত শীর্ষস্থানীয় পত্রিকাগুলোর প্রথম পাতায় যে রাজনৈতিক কার্টুনগুলো দেখা যেত, সেগুলো এখন হারিয়ে গেছে। ওদিকে শোনা যাচ্ছে নির্বাচন সামনে রেখে ক্ষমতাসীন দলের পক্ষে এক লাখ কর্মী ছেড়ে দেওয়া হবে ডিজিটাল মাঠে, যাঁদের জন্য প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা পর্যন্ত রাখা হচ্ছে।

পরিবর্তনের শাশ্বত রূপের সঙ্গে সঙ্গে এটাও সত্য, রাজনীতির প্রচলিত যে মাঠ, সেখানে ন্যূনতম কাজ করার কোনো স্পেস সরকার গত কয়েক বছরে একেবারেই রাখেনি। মাঠের রাজনীতির চিরচেনা যে রূপ মিছিল, জনসভা, মানববন্ধন, তা সরকার আর প্রশাসনের অনুমতির নানা বেড়াজালে আটকে বিলুপ্তপ্রায়। এমনকি বিরোধী দলের ঘরোয়া সভাতেও সরকারের কড়া নজরদারি। বাদ নেই দোয়া মাহফিলও, সেখান থেকেও কর্মী গ্রেপ্তারের নতুন সংস্কৃতি চালু হয়েছে।

প্রচলিত মাঠের রাজনীতি আর আজকের ডিজিটাল মাঠ একটি অপরটির প্রতিদ্বন্দ্বী নয়, বরং পরিপূরক। এর প্রমাণ মেলে আমাদের দেশে নিরাপদ সড়ক, কোটা সংস্কার, ভ্যাটবিরোধী আন্দোলন কিংবা আরব বসন্তে। এর সব কটিই ডিজিটাল মাঠে শুরু হয়ে পূর্ণতা পেয়েছিল প্রথাগত মাঠে।

ভীত প্রাণী সব সময়ই ভয়ংকর, তা সে মানুষ হোক বা অন্য কিছু। একই কথা সরকারের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। ভীত সরকার দমন-পীড়নের ক্ষেত্রে এমন কিছু নেই, যা পারে না। অন্য আরও কিছু কারণের সঙ্গে এটিও একটি বড় কারণ রাজনীতির প্রচলিত এ মাঠের জৌলুশ হারানোর পেছনে। আর সেই সঙ্গে অনেক বেশি প্রাসঙ্গিক ও শক্তিশালী হয়ে উঠছে ডিজিটাল মাঠ। যদিও আমাদের মতো দুর্বল গণতন্ত্রের দেশে ক্ষয়িষ্ণু মাঠের রাজনীতির গুরুত্ব থাকবে সামনের দিনগুলোতেও।

রুমিন ফারহানা বিএনপিদলীয় সাংসদ ও হুইপ এবং বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী