বরিস জনসনের বিদায়ে খুশি হওয়ার সুযোগ কতটা?

জনসনের বিদায়কে তাঁর দলের লোকেরাই সবচেয়ে বেশি উদ্‌যাপন করছেনছবি : রয়টার্স

সদ্য পদত্যাগ করা মন্ত্রী ঋষি সুনাক ২০১৯ সালে টোরি পার্টির (কনজারভেটিভ পার্টি) নেতা হিসাবে বরিস জনসনের মনোনীত হওয়ার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন। তিনি একটা যৌথ বিবৃতির সহ–লেখক ছিলেন। বিবৃতিতে বলা হয়েছিল, ‘বরিস জনসন আশাবাদী একজন মানুষ। একটা আনন্দপূর্ণ অনুভূতি পুনরুদ্ধারে এবং কনজারভেটিভরা ব্রিটেনের জন্য যা করতে চায়, তার জন্য আশাবাদ জোগাতে সহায়তা করবেন তিনি।’ বৃহস্পতিবার রাতে সুনাক হঠাৎ করেই বরিস জনসনের ওপর তাঁর আগের সেই আস্থা হারিয়ে ফেললেন। বরিস জনসন সম্পর্কে সবাই যেটা জানে, সেটা আবিষ্কার করতে তাঁর তিন বছর লেগে গেল।

সুনাক তাঁর শেষ সপ্তাহটা উদ্‌যাপন করলেন কীভাবে? ‘গত এক দশকের মধ্যে সবচেয়ে বড় ব্যক্তিগত করছাড়’ ঘোষণা করে। জনসনের পরে যেই ১০ নম্বর ডাউনিং স্ট্রিটে আসুক না কেন, কীভাবে জনগণের ওপর ভ্যাট আরোপ করা যাবে অথবা করপোরেট করহার কমানো যাবে—তা নিয়েই কথাবার্তা বলবেন। ফর্মুলা ওয়ান রেসের মাঠে শ্যাম্পেনের ফোয়ারা ছুটিয়ে কীভাবে আরও শতকোটিপতির সংখ্যা বাড়ানো যাবে, সেই চিন্তাই তাঁরা করবেন। এমন কোনো নীতির কথা তাঁরা চিন্তা করতে পারবেন না, যাতে খাদ্যপণ্যের দাম কমে, বিদ্যালয়ের শিশুদের জন্য বিনিয়োগ বাড়ে অথবা হাসপাতাল নির্মাণ করা যায়।

যুক্তরাজ্যে সরকার পরিচালনার জন্য নতুন কোনো ব্যবস্থাপক দরকার নেই। যুগের পর যুগ ধরে যাঁরা বঞ্চিত, তাঁদের জন্য ক্ষমতা ও সম্পদের ভিন্ন এক ব্যবস্থাপনা যাতে তৈরি হয়, সেই প্রত্যাশাই এখন জনগণের। যুক্তরাজ্যের জনগণের প্রতিদিনকার জীবনযাপনে ইতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে এ রকম অর্থনৈতিক ব্যবস্থা ও সরকার এখন সময়ের দাবি। বরিস জনসনের সঙ্গে তাঁর অনুসারীদের বিদায়ের মধ্য দিয়ে প্রকৃত উদ্‌যাপন হতে পারে।

এ সপ্তাহে মন্ত্রীরা ‘বিশুদ্ধতা’ ও ‘শিষ্টাচার’–এর নামে পদত্যাগ করেছেন। এটা তাঁদের কোনো গুণের প্রকাশ নয়। তাঁরা, ‘একটা ডুবন্ত জাহাজ থেকে পলায়নরত ইঁদুর’। ব্রিটেনে আজ বাবা–মা তাঁদের সন্তানদের কীভাবে ভালোভাবে খাওয়াবেন, তা নিয়ে দুশ্চিন্তা করছেন, কর্মজীবীরা ভীত এই ভেবে যে কাল তাঁদের কাজটি থাকবে কি না, যেভাবে জ্বালানির দাম বেড়েই চলেছে, তাতে আগামী শীতে কীভাবে বিল পরিশোধ করবেন, তা নিয়ে পেনশনভোগীদের কপালে চিন্তার ভাঁজ তৈরি হয়েছে।

এই যখন অবস্থা, তখন টোরি পার্টির সংসদ সদস্যরা মাসের পর মাস ধরে সরকার পরিচালনা না করে বরং কীভাবে সঠিক সময়ে তাঁদের নেতাকে ছুড়ে ফেলা যাবে, সেই ষড়যন্ত্র নিয়েই ব্যস্ত ছিলেন। তাঁরা প্রধানমন্ত্রীর বদলকে শখের বদল হিসেবেই দেখছেন।

এক দিক থেকে বরিস জনসনকে খুব সঠিক বলে মনে হয়। কেননা, মধ্যবয়স্ক একজনের পক্ষে নিজের স্বভাব বদল করা সম্ভব নয়। সেটা বদলের ইচ্ছাও জনসন কখনো প্রকাশ করেননি। কিন্তু যে রাজনীতিবিদ, অর্থদাতা ও সাংবাদিকেরা তাঁকে প্রধানমন্ত্রীর পদে বসিয়েছিলেন, তাঁরাই এখন নিজেদের অবস্থান বদল করে ফেলেছেন। জনসনের ভোটের বাজির কৌশল তাঁদের কাছে একসময় খাঁটি সোনার মতো ছিল। এখন সেটা ওয়েস্টমিনস্টারের সবচেয়ে অকেজো ধাতু।

এ কারণেই জনসনের বিদায়কে তাঁর দলের লোকেরাই সবচেয়ে বেশি উদ্‌যাপন করছেন। প্রধানমন্ত্রী তাঁর লোকপ্রিয় কাজগুলো সম্পন্নের দায়িত্ব দিয়েছিলেন ক্রিস পিনচারের ওপর, যিনি কিনা যৌন হয়রানির অভিযোগে অভিযুক্ত। ডেপুটি হুইপ হিসেবে তাঁর বেতন ছিল ১ লাখ ১৫ হাজার পাউন্ড। আইন ভেঙে তিনিও লকডাউনকালে পার্টিতে যোগ দিয়েছিলেন এবং যথারীতি মিথ্যাও বলেছিলেন। জনসন সুনিশ্চিতভাবে ব্রিটেনের গণতন্ত্রের গভীর সংকটের গুরুতর লক্ষণের প্রকাশ।

বরিস জনসনকে সরিয়ে কে এখন প্রধানমন্ত্রী হবেন? সুনাক ও সাজিদ জাভেদ দুজনে মিলে ৩২ বছর ব্যয় করেছেন অর্থ লেনদেনসংক্রান্ত চাকরিতে। লিজ ট্রাস আরেকজন নাইজেল ফারাজ, পার্থক্য এই যে তাঁর হাতে বিয়ারের গ্লাস নেই। ম্যাট হ্যানকক হলেন ম্যাট হ্যানকক। আজকের টোরি পার্টি ব্যাংকার, অযোগ্য ব্যক্তি ও ব্রেক্সিটপন্থীদের অন্ধ এক জোট। তাদের নিজস্ব কোনো চিন্তা নেই। তারা থ্যাচারিজমের (মার্গারেট থ্যাচার ছিলেন যুক্তরাজ্যের নয়া উদারবাদের প্রবক্তা) অন্ধ অনুকরণই তাঁরা করে চলেছেন।

বরিস জনসন একজন বিশৃঙ্খল নেতা। আর তাঁর পেছনে রয়েছেন একঝাঁক নির্লজ্জ সংসদ সদস্য, কাপুরুষ মিডিয়া এবং সুচতুর দাতা। তারা অনেক কিছু ধ্বংস করেছে, যা কিছু সম্ভব সবকিছুই লুটে নিয়েছে; কিন্তু কিছুই সৃষ্টি করেনি।

আরও পড়ুন

এই লোকগুলো সরকারে গিয়ে খারাপ করে, কারণ তাঁরা মনে করেন সরকার খারাপ। তকমা দেওয়া তাঁদের কাছে চমৎকার এক স্লোগান। তাঁদের প্রকৃত উদ্দেশ্য হচ্ছে, ব্যক্তিগত সুবিধা অর্জন। তাঁরা সরকারের দায়িত্ব ছেড়ে গেলে কোনো শাস্তির মুখে পড়তে হয় না।

যুক্তরাজ্যে সরকার পরিচালনার জন্য নতুন কোনো ব্যবস্থাপক দরকার নেই। যুগের পর যুগ ধরে যাঁরা বঞ্চিত, তাঁদের জন্য ক্ষমতা ও সম্পদের ভিন্ন এক ব্যবস্থাপনা যাতে তৈরি হয়, সেই প্রত্যাশাই এখন জনগণের। যুক্তরাজ্যের জনগণের প্রতিদিনকার জীবনযাপনে ইতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে এ রকম অর্থনৈতিক ব্যবস্থা ও সরকার এখন সময়ের দাবি। বরিস জনসনের সঙ্গে তাঁর অনুসারীদের বিদায়ের মধ্য দিয়ে প্রকৃত উদ্‌যাপন হতে পারে।

আদিত্য় চক্রবর্তী দ্য গার্ডিয়ানের কলামিস্ট

ইংরেজি থেকে অনূদিত, দ্য গার্ডিয়ান থেকে নেওয়া