বাংলাদেশের অর্থনীতির সামগ্রিক চিত্রসমেত নির্ভরযোগ্য ও মানসম্মত বই বাজারে বিরল। সদ্য সমাপ্ত ৫০ বছর পূর্তি তথা সুবর্ণজয়ন্তীতে আলাপ-আলোচনা ও সেমিনার-সিম্পোজিয়ামে এই গতিধারা নিয়ে গতানুগতিক লেখাজোখা লক্ষণীয়; কিন্তু উপযুক্ত উপাত্তসহ বই আকারে ঐতিহাসিক ও বর্তমান প্রেক্ষাপট ব্যক্ত হয়েছে—এমন কোনো সংবাদ আপাতত কাছে নেই। তবে এই খরার মধ্যে একপশলা বৃষ্টির মতো যে কজন এগিয়ে এসেছেন বাংলাদেশের অর্থনীতির ওপর বাংলা ভাষায় বই লিখতে, তাঁদের মধ্যে রুশিদান ইসলাম রহমান, রিজওয়ানুল ইসলাম ও কাজী সাহাবউদ্দিন অন্যতম। তাঁদের সদ্য প্রকাশিত বইয়ের নাম ‘বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের গতিধারা: সুবর্ণজয়ন্তীতে ফিরে দেখা’ (ইউপিএল, মার্চ, ২০২২)। কথায় বলে, প্রচ্ছদ নয়, বই বিচার করতে হয় তার আধেয় দিয়ে। কিন্তু আমার কাছে মনে হয়েছে, প্রায় সাড়ে তিন শ পৃষ্ঠা ও দশটি অধ্যায় নিয়ে এ বইয়ের প্রচ্ছদ ও আধেয় উভয়ই যেমন আকর্ষণীয়, তেমনি উপভোগ্য।
শিরোনাম থেকে বইটির সঠিক অবস্থান প্রতিফলিত হয় বলে মনে হয় না। এর কারণ, লেখকত্রয় সুবর্ণজয়ন্তীতে বাংলাদেশের উন্নয়নের গতিধারা শুধু ফিরে দেখেননি, বস্তুত সামনের দিকে কী ঘটতে যাচ্ছে বা ঘটার সম্ভাবনা আছে, তার প্রতিও ইঙ্গিত করেছেন। সব মিলিয়ে বইটি যেমন অতীতের, তেমনি ভবিষ্যতের কথা বলে। বর্তমান আছে এই দুয়ের মাঝে সেতুবন্ধ হিসেবে। ‘স্বাধীনতা অর্জনের সময় বাংলাদেশের অর্থনীতি ছিল টালমাটাল অবস্থায়। পরের পাঁচ দশকে উন্নয়নের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় দেশটি কেমন করেছে, সে বিষয় নিয়ে এই বই। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে সাফল্য, ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা এবং সম্ভাব্য ঝুঁকির বিশ্লেষণ রয়েছে এতে। রয়েছে শিল্পায়ন, সেবা খাত এবং কৃষির বিবর্তনের মাধ্যমে অর্থনীতির কাঠামোতে রূপান্তর, খাদ্যনিরাপত্তা, দারিদ্র্য, অসাম্য, কর্মসংস্থান, বেকারত্ব এবং নারীর ক্ষমতায়নের প্রবণতা ও সম্ভাবনা সম্পর্কে উপাত্তভিত্তিক বিশ্লেষণ। পাওয়া যাবে ভবিষ্যতের জন্য পথনির্দেশ।’
একটা বইয়ের পর্যালোচনা দুভাগে বিভক্ত করা সমীচীন বলে মনে হচ্ছে। প্রথম ভাগে বইয়ের বৈশিষ্ট্য এবং নির্বাচিত কিছু অধ্যায়ের সংক্ষেপিত বিষয়বস্তুর ওপর আলোকপাত করা আর দ্বিতীয় ভাগে বই সম্পর্কে নিবন্ধকারের নিজস্ব মতামত।
দু-একটি দিকে বিশেষ নজর দিতে পারলে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অভিযাত্রার গল্পটা হয়তো আরও অনেক বেশি হৃদয়গ্রাহী হতে পারত। যেমন বাংলাদেশের বিভিন্ন খাত ও উপখাতে শুধু করোনার প্রভাব নিয়ে একটা আলাদা অধ্যায় থাকলে ভালো হতো, যদিও বইয়ের বিভিন্ন অংশে এর আংশিক উপস্থিতি লক্ষণীয়। আসলে এমন আচমকা অভিঘাতের অভিজ্ঞতা এবং সমস্যা ও সমাধান নিয়ে তথ্য-উপাত্ত নির্ভরশীল নির্ভেজাল নিরীক্ষা নেই বললেই চলে। তেমনি তথ্যপ্রযুক্তি তথা চতুর্থ শিল্পবিপ্লব নিয়ে আলাদা আলোচনা একটা নতুন মাত্রিকতা এনে দিতে পারত।
লেখকত্রয়ের প্রারম্ভিক বক্তব্য বেশ ব্যতিক্রমধর্মী। তাঁরা মনে করেন, তিন দশকের অগ্রগতিতে বিনিয়োগ, নীতিমালা, এনজিও এবং অন্যান্য উপাদান তো আছেই, ‘কিন্তু সেই সঙ্গে উন্নয়নের প্রক্রিয়ায় কেন্দ্রীয় একটি ভূমিকা রেখেছে এ দেশের জনগণের অংশগ্রহণের আগ্রহ। শিক্ষার অভাবে যাদের ধ্যানধারণা ছিল সংকীর্ণ, যাদের নিত্যসঙ্গী ছিল কুসংস্কার, আধুনিকতার প্রতি যারা ছিল বিরূপ, তাদের মানসিকতায় এসেছে পরিবর্তন। সেই পরিবর্তন বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিদ্যমান...এসবই আসলে এ দেশের অনুপ্রাণিত জনগণের অভ্যন্তরীণ শক্তির প্রতিফলন...। সম্মুখে প্রয়োজন হবে এই শক্তিকে নতুন করে উজ্জীবিত করা...তবে এই উজ্জীবনের পথে বাধা...যদিও গত কয়েক দশকে অর্থনৈতিক উন্নয়নে যথেষ্ট গতি এসেছে, তবুও আরও অনেক পথ বাকি’ (অধ্যায় ১)।
মোট দশটি অধ্যায়ে চোখ বুলালে মনে হবে অধ্যায়গুলোয় যা বলা আছে, তা যেন চর্বিতচর্বণ, যেমনটি আছে অন্যান্য গ্রন্থে, পত্রিকার পাতায় কিংবা প্রবন্ধে। কিন্তু অনুসন্ধানে বেরিয়ে আসে যে এক অন্তর্নিহিত শক্তি বইটাকে আলাদা করে অন্য বই থেকে, যেখানে কঠিন অর্থমিতিক সূত্রের সাহায্যে পাওয়া ফলাফলের বিদগ্ধ বিশ্লেষণ পাঠকের নজর কাড়ে। যেমন শনৈঃশনৈঃ ঊর্ধ্বমুখী অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির প্রেক্ষাপটে কর্মসংস্থান কেন নিম্নমুখী, এ প্রশ্নের উত্তর জটিল অঙ্কের মাধ্যমে খুব সহজভাবে পাঠকের সামনে উপস্থিত করেছেন লেখকেরা একসময় উৎপাদন বৃদ্ধির প্রায় তিন-চতুর্থাংশ আসত শ্রমশক্তি বা কর্মসংস্থান থেকে আর এক-চতুর্থাংশ উৎপাদিকা বা দক্ষতা বৃদ্ধি থেকে। সাম্প্রতিক সময়ে ঘটছে তার ঠিক উল্টোটা, ফলে উৎপাদন বৃদ্ধির হার বাড়লেও কর্মসংস্থান বৃদ্ধির হার কমে গিয়েছে (অধ্যায় ৪)। ক্ষেত্রবিশেষে করোনার মতো আচমকা আঘাতে অর্থনীতির ওপর বিরূপ প্রভাব নিয়ে আলোচনা বইটির প্রতি আকর্ষণ বাড়ায় (অধ্যায় ২)।
কর্মসংস্থান, শ্রমবাজার ও বেকারত্ব নিয়ে রচিত অধ্যায়টি নিঃসন্দেহে নতুন এবং নবধারামূলক। সাধারণত বাংলাদেশের অর্থনীতির ওপর লেখা বিদ্যমান গ্রন্থগুলোয় এ বিষয় নিয়ে বহুমাত্রিক বিশ্লেষণ খুব কম। ‘শুধু রপ্তানিমুখী ও বড় শিল্পের প্রসার কিন্তু কর্মসংস্থান ও তার মান বৃদ্ধির ক্ষেত্রে ব্যাপক ভূমিকা রাখতে পারছে না। সুতরাং, এগুলোর সঙ্গে সঙ্গে ক্ষুদ্র, মাঝারি ও অতি ক্ষুদ্র উদ্যোগগুলোকে উৎসাহিত করতে হবে। শ্রমশক্তির শতকরা ৩৫ ভাগ এসব উদ্যোগে নিয়োজিত এবং এগুলোতে শ্রম ও পুঁজির অনুপাত বৃহৎ শিল্পের তুলনায় বেশি’ (অধ্যায় ৭)। তারপর কিছু সুপারিশ, যেমন এদের ঋণ, কর রেয়াত, প্রশিক্ষণ ইত্যাদি নানাভাবে উৎসাহিত করার প্রায়োগিক উপদেশ উল্লেখ করার মতো (অধ্যায় ১০)। মোটকথা, নীতি ও কার্যক্রমকে সাধারণ ও গতানুগতিক ছাঁচ থেকে বাইরে নিয়ে যেতে হবে, বিরাজমান প্রতিবন্ধকতাগুলোকে সরাসরি ধাক্কা দিয়ে উৎপাটন করে ভবিষ্যৎ রচনা করতে হবে।
বইটিতে কৃষি, শিল্প, দারিদ্র্য, বৈষম্য, সেবা খাতসহ প্রায় প্রচলিত সব খাতের ওপর কমবেশি তাত্ত্বিক আলোচনার পর তথ্যভিত্তিক বিশ্লেষণ উপস্থাপন করা হয়েছে। ‘বিগত পাঁচ দশকে মোট দেশজ উৎপাদনে কৃষির অবদান ক্রমান্বয়ে হ্রাস পেলেও মোট শ্রমশক্তির অর্ধেকের কাছাকাছি এখনো কৃষিতেই নিয়োজিত। আর তাই কর্মসংস্থান, খাদ্য নিরাপত্তা ও দারিদ্র্য নিরসনে কৃষি খাতের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ভুলে থাকার নয় এবং দেশে খাদ্যের লভ্যতা ও অধিগম্যতার ক্ষেত্রে যে সাফল্য অর্জিত হয়েছে, তা ধরে রাখতে বহুমুখী প্রচেষ্টার প্রয়োজন’ (অধ্যায় ৫)। বিশেষত অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির ও আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের অবস্থান এবং নারীর অর্থনৈতিক ক্ষমতায়ন নিয়ে তথ্যভিত্তিক পর্যালোচনা চলমান বিশ্লেষণে মূল্য সংযোজিত করবে বলে বিশ্বাস। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, রজতজয়ন্তীতে ফিরে দেখে মুখ ঘুরিয়েছেন সামনের দিকে, যা অতীত কিংবা বর্তমান কালের চেয়ে কম চ্যালেঞ্জিং নয় এবং সনাতনী চিন্তাভাবনায় এগোলে ২০৩১ সালের মধ্যে উচ্চমধ্যম এবং ২০৪১ সালের মধ্যে উচ্চ আয়ের স্তরে পৌঁছার স্বপ্ন অধরা থেকে যেতে পারে। যেমন শিক্ষাব্যবস্থা চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ করণ, অর্থনৈতিক কৌশলে পরিবর্তন আনয়ন, ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগ বৃদ্ধি যেমন দরকার, রূপান্তর দরকার বিনিয়োগের ধাঁচেও ইত্যাদি।
বাংলাদেশের গত পঞ্চাশ বছরের অর্জনে লেখকত্রয়ের লেখায় আনন্দের আভাস থাকলেও উচ্ছ্বাসে মাতামাতি নেই, কারণ মানুষের আর্থসামাজিক মুক্তি অর্জনে এখনো অনেক বন্ধুর পথ বাকি বলে তাঁরা মনে করছেন, ঠিক যে রকম রবার্ট ফ্রস্টের কবিতা (শামসুর রাহমানের অনুবাদে):
‘কাজল গভীর এ-বন মধুর লাগে
কিন্তু আমার ঢের কাজ বাকি আছে।
যেতে হবে দূরে ঘুমিয়ে পড়ার আগে
যেতে হবে দূরে ঘুমিয়ে পড়ার আগে’
এবার নিবন্ধকারের দু-একটি নিজস্ব মতামত।
এই বইয়ে মূলত সনাতনী বিষয়গুলো প্রাধান্য পেয়েছে, যা অবশ্যই প্রণিধানযোগ্য। তবে দু-একটি দিকে বিশেষ নজর দিতে পারলে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অভিযাত্রার গল্পটা হয়তো আরও অনেক বেশি হৃদয়গ্রাহী হতে পারত। যেমন বাংলাদেশের বিভিন্ন খাত ও উপখাতে শুধু করোনার প্রভাব নিয়ে একটা আলাদা অধ্যায় থাকলে ভালো হতো, যদিও বইয়ের বিভিন্ন অংশে এর আংশিক উপস্থিতি লক্ষণীয়। আসলে এমন আচমকা অভিঘাতের অভিজ্ঞতা এবং সমস্যা ও সমাধান নিয়ে তথ্য-উপাত্ত নির্ভরশীল নির্ভেজাল নিরীক্ষা নেই বললেই চলে। তেমনি তথ্যপ্রযুক্তি তথা চতুর্থ শিল্পবিপ্লব নিয়ে আলাদা আলোচনা একটা নতুন মাত্রিকতা এনে দিতে পারত যদিও স্বীকার করা হয়েছে যে ‘ভবিষ্যতে দেশের আধুনিক খাত বিকাশে উচ্চপর্যায়ের প্রযুক্তি ও উৎপাদনকৌশল গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে এবং বাংলাদেশকে এই চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের জন্য ব্যাপক প্রস্তুতি নিতে হবে।’ তথ্য ও প্রযুক্তিতে বাংলাদেশের গত পঞ্চাশ বছরের বৈপ্লবিক বিবর্তন এ বইয়ে স্থান পাওয়া যুক্তিযুক্ত ছিল। শ খানেক সারণি এবং তার সঙ্গে বহু রেখাচিত্রের ব্যবহার গবেষকের কাছে গ্রহণযোগ্য হলেও সাধারণ পাঠক অস্বস্তি বোধ করতেও পারেন।
তবে সব সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও আশা করা যায়, গ্রন্থটি আগ্রহী সব শ্রেণির পাঠকের কাছে আকর্ষণীয় হবে, কারণ এতে বিদ্যমান গবেষণা ও রচনা যেমন ব্যবহার করা হয়েছে, তেমনি এতে বিন্যস্ত আছে নতুন বিশ্লেষণ ও পর্যালোচনা। জটিল অর্থমিতিক পদ্ধতির পাশাপাশি সহজবোধ্য ব্যাখ্যা পাঠকের জন্য সুখকর প্রাপ্তি হবে বলে ধরে নেওয়া যায়। রাজনীতিবিদ, অর্থনীতিবিদ, গবেষক, এনজিওকর্মী ও ছাত্রছাত্রী—সবার জন্য সুপারিশকৃত এই বই নিঃসন্দেহে বাংলা ভাষায় লেখা বাংলাদেশের অর্থনীতির পুরোপুরি আলোচনার জগতে একটা মাইলফলক। এমন একটা বই বাজারে আনার জন্য লেখক ও প্রকাশক ধন্যবাদ পেতেই পারেন।
আব্দুল বায়েস সাবেক অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ এবং সাবেক উপাচার্য জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়; বর্তমানে ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটির খণ্ডকালীন শিক্ষক