বাংলাদেশের জয়, ক্রিকেট–সাংবাদিকতা ও অস্ট্রেলীয় সংবাদমাধ্যমের কপটতা

বাংলাদেশ–অস্ট্রেলিয়া টি২০ সিরিজের কোনো খবরই ঠাঁই পায়নি অস্ট্রেলীয় গণমাধ্যমে। গত মঙ্গলবার তোলা।
ছবি: লেখক

অস্ট্রেলিয়ার ক্রিকেট দলের বাংলাদেশ সফর এক নতুন ইতিহাস। পাঁচ ম্যাচের সিরিজে চারটিতেই বাংলাদেশের টাইগারদের কাছে হেরেছে দানবীয় দল অস্ট্রেলিয়া। আর বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের এ জয়ে সবচেয়ে বেশি আনন্দিত মনে হয় অস্ট্রেলিয়ার প্রবাসী বাংলাদেশিরা। এর বেশ কিছু কারণ রয়েছে।

ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়ার দেওয়া নানান শর্ত আর বিধিনিষেধের চাপের মুখেও দলটিকে স্বাগতম জানায় বাংলাদেশ। তবে এত ঝক্কিঝামেলা করেও শেষ রক্ষা হয়নি দলটির। অল্পের জন্য হোয়াইটওয়াশ থেকে রেহাই দিয়েছে বাংলাদেশ। আর এর মধ্যে বাংলাদেশ নামটি আবারও পরিচ্ছন্ন হয়ে উঠেছে বিশ্ব দরবারে। ফলে প্রবাসীদের জন্য আমাদের সংস্কৃতি ফলাও করে গর্বের সঙ্গে প্রচার করার পথ আরও সহজ হয়েছে। এই অতিমারির মধ্যেও বাংলাদেশের এ সিরিজ জয় অতিমাত্রার আনন্দ নিয়ে এসেছে, এটা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।

অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে পুরোনো দ্বৈরথ ইংল্যান্ডের। ক্রিকেট থেকে শুরু করে অনেক কিছুতেই ‘চিরশত্রু’। সে অর্থে আমাদের সঙ্গে এমন কিছুই নেই। দ্বৈরথ হলে অসুবিধার পাশাপাশি সুবিধাও আছে। সম্মান-গুরুত্ব পাওয়া যায় যথাযথ। তাই সে আশায় বাংলাদেশের কাছে অস্ট্রেলিয়ার এই মহাপরাজয় প্রবাসী অস্ট্রেলীয় বাংলাদেশিদের কাছে বেশি আনন্দের।

এর আগে আমরা দেখেছি মাস্টারশেফ অস্ট্রেলিয়া। রান্নাবিষয়ক রিয়্যালিটি শো। রান্নার এ প্রতিযোগিতা কেবল অস্ট্রেলিয়াতেই জনপ্রিয়তার তুঙ্গে, তা নয়। বিশ্বের আরও প্রায় ৪০টি দেশেও রয়েছে তাদের নিজস্ব মাস্টারশেফের আয়োজন। এর মধ্যে অস্ট্রেলিয়ার এ প্রতিযোগিতা অধিকতর জনপ্রিয় সারা বিশ্বে। এমন একটি আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশি খাবারকে তুলে ধরেছেন বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত প্রতিযোগী কিশোয়ার চৌধুরী। আসরের বাছাইপর্ব থেকে শুরু করে চূড়ান্ত পর্ব পর্যন্ত একাধারে দর্শক, অন্য প্রতিযোগী ও বিচারকদের কাছে আলোচিত ও সমাদৃত হয়ে থেকেছেন কিশোয়ার। হয়েছেন এবারের আসরের দ্বিতীয় রানারআপ। তাঁর এ গৌরবোজ্জ্বল যাত্রায় তিনি বাংলাদেশি খাবারের উপকরণ, ফ্লেভার কিংবা কেবল নাম ব্যবহার করেছেন, একদমই এমন নয়। একদম বাংলাদেশের অতিসাধারণ খাবার, যেমন মাছ ভাজা, মাছের ঝোল, শিমভর্তা, বেগুনভর্তা, খিচুড়ি, খাসির রেজালা, নেহারি, এমনকি পান্তা আর আলুভর্তার মতো বাঙালি খাবার। প্রতিবার রান্নায় খাবারগুলো যে বাঙালির ঐতিহ্যবাহী খাবার, সেটি উল্লেখ করেছেন কিশোয়ার গুরুত্বসহকারে।

খেলার সরাসরি বা হাইলাইটস সম্প্রচার তো দূরের কথা, দেশটির কোনো পত্রপত্রিকায়ও তেমন কোনো সংবাদ আসেনি। তবে যেদিন অস্ট্রেলিয়ার উদীয়মান ক্রিকেটার অ্যালিস হ্যাটট্রিক হাঁকালেন, সেদিনই তাঁকে প্রচার করে সংবাদমাধ্যম কিছুটা চাঙা ছিল। এ ছাড়া ঢাকার এই সিরিজ নিয়ে একটা রাখঢাক চোখে পড়েছে সব সময়।

অন্যদিকে মানুষ একসময় ‘এশিয়ান টাইগার্স’ বা ‘এশিয়ার বাঘ’ বলতে সাধারণত হংকং, সিঙ্গাপুর, দক্ষিণ কোরিয়া ও তাইওয়ানকে বোঝাত। ২০১৭ সাল থেকে বাংলাদেশকে বলা শুরু করল ‘এশিয়ার নতুন বাঘ’। ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের (ডব্লিউইএফ) ওয়েবসাইটে প্রকাশিত ‘দেয়ার কুড বি আ নিউ এশিয়ান টাইগার, হেয়ারস হোয়াই’ শীর্ষক এক নিবন্ধে তুলে ধরা হয়েছিল এশিয়ার অর্থনীতির নতুন বাঘ হিসেবে বাংলাদেশের আবির্ভাবের সম্ভাবনার কথা। সম্প্রতি শ্রীলঙ্কার অর্থনৈতিক সংকটের সময় ঋণসহায়তা দিয়ে বাংলাদেশ নিজেদের অর্থনৈতিক উত্থানের জানান দিয়েছে। এর পরপরই অস্ট্রেলিয়ান ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির ন্যাশনাল সিকিউরিটি কলেজের জ্যেষ্ঠ গবেষক ডেভিড ব্রিউস্টার এক নিবন্ধে লিখেছেন, আঞ্চলিক প্রভাবশালী দেশ হওয়ার পথে এটি বাংলাদেশের জন্য একটি ‘টার্নিং পয়েন্ট’। অস্ট্রেলিয়ান এই গবেষকের মতে, বাংলাদেশের ধারাবাহিক উচ্চ প্রবৃদ্ধি ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে গুরুত্ব বাড়িয়েছে। ফলে অস্ট্রেলিয়াকে পরামর্শ দিয়েছে যেন বাংলাদেশের মতো উদীয়মান শক্তির সঙ্গে সম্পর্ক জোরদার করে দ্রুত।

অস্ট্রেলিয়াকে ৪-১ ব্যবধানে সিরিজ হারিয়েছে বাংলাদেশ।
ছবি: শামসুল হক

এসব মিলিয়ে অস্ট্রেলিয়ার চোখে বাংলাদেশ কিছুটা বাঘা দেশ তো হয়ে উঠবেই। আর এ সময়ে অস্ট্রেলিয়া দলের বাংলাদেশ সফর। এ নিয়ে বাংলাদেশি কিংবা প্রবাসী বাংলাদেশি—সবার মধ্যেই বেশ উত্তেজনা কাজ করেছে সিরিজ নিয়ে। তার ওপর বাংলাদেশ ক্রিকেট দল এমন বাজিমাত করেছে, সেটা কেবলই একটা অন্য রকম অনুভূতি সবার কাছে। তবে এত ভালো একটা খেলা নিয়েও মনভাঙা কষ্ট বাংলাদেশিদের, বিশেষ করে অস্ট্রেলিয়ার প্রবাসী বাংলাদেশিদের। কারণ, খেলাটি প্রচারিত হয়নি অস্ট্রেলিয়ার কোনো টেলিভিশন চ্যানেলেই। মূলধারার কোনো সম্প্রচারমাধ্যমই খেলাটির প্রচারে আগ্রহ দেখায়নি শুরু থেকেই। এ নিয়েও প্রচুর সমালোচনার সৃষ্টি হয় অস্ট্রেলিয়ায়। ক্ষোভ জানিয়েছিলেন খোদ অস্ট্রেলিয়ার ওয়ানডে ও টি-টোয়েন্টি অধিনায়ক অ্যারন ফিঞ্চ। ফিঞ্চসহ অস্ট্রেলিয়ার তারকা ক্রিকেটাররা খেলা সম্প্রচার না করাতে অভিযোগ জানিয়েছেন।

খেলার সরাসরি বা হাইলাইটস সম্প্রচার তো দূরের কথা, দেশটির কোনো পত্রপত্রিকায়ও তেমন কোনো সংবাদ আসেনি। তবে যেদিন অস্ট্রেলিয়ার উদীয়মান ক্রিকেটার অ্যালিস হ্যাটট্রিক হাঁকালেন, সেদিনই তাঁকে প্রচার করে সংবাদমাধ্যম কিছুটা চাঙা ছিল। এ ছাড়া ঢাকার এই সিরিজ নিয়ে একটা রাখঢাক চোখে পড়েছে সব সময়।

বাংলাদেশের সঙ্গে টি-টোয়েন্টি সিরিজের শেষ খেলায় অস্ট্রেলিয়ার ৬২ রান ক্রিকেটে অস্ট্রেলিয়ার ইতিহাসে সর্বনিম্ন সংগ্রহ। অস্ট্রেলিয়ার ক্রিকেট ১৪৪ বছরের পুরোনো। এই ১৪৪ বছরে এমন হয়নি আগে।

আমরা যতই অস্ট্রেলিয়ার গণমাধ্যমে সংবাদ খুঁজেছি, ততই নিরাশ হয়েছি। অজুহাত-অভিযোগ অনেক। অলিম্পিক গেমসের সাংঘর্ষিক সময়, প্যাট কামিন্স, স্টিভ স্মিথ ও ডেভিড ওয়ার্নারের মতো তারকার অনুপস্থিতি এবং পাঁচটি ম্যাচের সব কটিই অস্ট্রেলিয়া সময় রাত ১০টা থেকে প্রায় ২টা পর্যন্ত; আরও অনেক কিছু। তবে মনে হয়েছে, এসবের অজুহাতে অস্ট্রেলীয়রা এই প্রচণ্ড ধরাশায়ীর আতঙ্ক থেকে বাঁচতে চায়।

এর আগে অস্ট্রেলিয়ানদের চোখে এ আতঙ্ক দেখা গিয়েছিল ২০০৫ সালের জুন এবং ২০০৬ সালের এপ্রিলে বাংলাদেশের সঙ্গে অস্ট্রেলিয়ার ম্যাচে। বাংলাদেশের কাছে ভয়ানক হার হয়েছিল তখনকার বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন অস্ট্রেলিয়ার। স্পষ্ট মনে আছে, তখনো চুপসে গিয়েছিল অস্ট্রেলিয়ার মিডিয়া। পরদিন হাহুতাশ করে বড় বড় শিরোনামে খবর দিয়েছিল প্রধান প্রধান প্রায় সব সংবাদপত্র। কিন্তু এবার এই তথ্যপ্রযুক্তির আরও সহজ সময়ে এসে উল্টো স্রোতে চলল অস্ট্রেলিয়া। অনলাইন মাধ্যমে কিছু সংবাদ হলেও দেশের প্রধান কোনো সংবাদপত্রের প্রিন্ট কপিতে কোনো সংবাদ ছাপা হয়নি। আগেই বলেছি, অস্ট্রেলিয়ার ক্রিকেট দলের বাংলাদেশ সফর এক নতুন ইতিহাস। এটা শুধু বাংলাদেশের জন্য, এমন নয়; অস্ট্রেলিয়ার জন্য তো বটেই, ক্রিকেট-বিশ্বের জন্যও।

বাংলাদেশের সঙ্গে টি-টোয়েন্টি সিরিজের শেষ খেলায় অস্ট্রেলিয়ার ৬২ রান ক্রিকেটে অস্ট্রেলিয়ার ইতিহাসে সর্বনিম্ন সংগ্রহ। অস্ট্রেলিয়ার ক্রিকেট ১৪৪ বছরের পুরোনো। এই ১৪৪ বছরে এমন হয়নি আগে। ১৩.৪ ওভারে অলআউট হয়েও গড়েছে লজ্জার এক ইতিহাস। এর আগে এত কম সময়ের মধ্যে অস্ট্রেলিয়ার ইনিংস আর কখনোই গুটিয়ে যায়নি, এমনটিই বলছে ক্রিকেট পরিসংখ্যান। এর আগে ২০০৫ সালে সাউদাম্পটনে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে অস্ট্রেলিয়ার সর্বনিম্ন টি-টোয়েন্টি স্কোর ছিল ৭৯।

শুধু বাংলাদেশ-অস্ট্রেলিয়ার টি-টোয়েন্টি ম্যাচগুলো সম্প্রচারিত হয়নি অস্ট্রেলিয়ায়, এমনটি নয়; পাঁচটি টি-টোয়েন্টি সিরিজের কোনোটিই সরাসরি সম্প্রচার করেনি অস্ট্রেলিয়ার কোনো টেলিভিশন চ্যানেল। এমনকি সিরিজটি সম্প্রচারের প্রস্তাবে কোনো আলোচনাই করতে নারাজ ছিল দেশটির সব খেলার টিভি চ্যানেল। ফলে প্রায় ২৭ বছর পর অস্ট্রেলিয়ার কোনো ম্যাচের সম্প্রচার না করার ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি হলো, সঙ্গে না দেখতে পেরে ১৪৪ বছরের প্রথম এমন ইতিহাস থেকে বঞ্চিত হলেন দেশটির ক্রিকেটপ্রেমী লাখো দর্শক। প্রচার নাহয় না-ই হলো, সংবাদ তো হতে পারত ফলাও করে। তা-ও হয়নি।

কঠিন ক্রিকেটপ্রেমী ছাড়া অস্ট্রেলিয়ার তেমনভাবে কেউই উপভোগ করতে পারেননি বাংলাদেশের এ ঐতিহাসিক রেকর্ডভাঙা জয়। অস্ট্রেলিয়ার গণমাধ্যমে কোনো গুরুত্ব পায়নি এই সিরিজ ঠিক আছে, কিন্তু অস্ট্রেলিয়ার ক্রিকেট অধিনায়ক ম্যাথু ওয়েডের বেতার সাক্ষাৎকার আজ বেজেছে সারা দিন। ‘বাংলাদেশের স্লো পিচ কন্ডিশন খুবই কঠিন ও ভিন্ন; আমাদের ছেলেরা এখান থেকে যা শিখেছে, সেটা কোনো কাজেই লাগবে না অক্টোবরের টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে।’ হাস্যকর যে ওয়েডের দল এক মাস ধরে অস্ট্রেলিয়ার বাইরে এবং বাংলাদেশে যাওয়ার আগে তারা ওয়েস্ট ইন্ডিজের সঙ্গেও সিরিজ হেরেছে ৪-১-এ, তাদের মুখে এমন কথা কেমন করে মানায়।

সংবাদে দেখেছি, খেলা শেষ করে সরাসরি বিমানবন্দরে যাবে অস্ট্রেলিয়ার দল। সেখান থেকে দেশে। রাত একটায় ছেড়েছে ফ্লাইট। সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে এতক্ষণে ফ্লাইট অস্ট্রেলিয়ার মাটি ছুঁয়েছে। সিডনিতে কঠোর লকডাউন চলছে এখন। তা না হলে বিমানবন্দরে যেতাম বঙ্গদর্শনে অস্ট্রেলিয়ার দল মুখে যা-ই বলুক, তাদের চেহারায় কেমন ছাপ পড়েছে, দেখতে।

কাউসার খান অস্ট্রেলিয়াপ্রবাসী, অভিবাসন আইনজীবী ও সাংবাদিক। ই-মেইল: [email protected]