বাংলাদেশের দুই অদ্ভুত কূটনৈতিক কাণ্ড

মিয়ানমারের জান্তাবিরোধী বিক্ষোভ

২৯ মার্চ প্রথম আলোতে প্রকাশিত একটি খবর আমাকে হতবিহ্বল করেছে। মিয়ানমার সেনাবাহিনীর প্রতিরোধ দিবস উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানে সামরিক কর্তৃপক্ষ সব দেশের দূতাবাসকে নিমন্ত্রণ করেছিল। সশস্ত্র বাহিনী দিবসে আমাদের দেশেও এটা ঘটে। আমাদের যেসব দূতাবাসে প্রতিরক্ষা উইং আছে, তারাও অনেক সময় এ রকম সংবর্ধনার আয়োজন করে। এটা খুবই সাধারণ ও স্বাভাবিক একটি রেওয়াজ। তবে আজকের দিনে মিয়ানমার এবং মিয়ানমার সেনাবাহিনী সাধারণ ও স্বাভাবিক কোনো ব্যাপার নয়। গত ১ ফেব্রুয়ারি বেসামরিক সরকারকে হটিয়ে সরাসরি ক্ষমতা দখলের পর সেখানে জান্তাবিরোধী ব্যাপক বিক্ষোভ চলছে। বিক্ষোভ নিয়ন্ত্রণে সেনা-পুলিশ গুলি করে নির্বিচার মানুষ মারছে। সারা দেশে মোট মৃতের সংখ্যা চার শতাধিক। যেদিন এ অনুষ্ঠান করে সেনারা, সেদিনই গুলিতে নিহত হয়েছেন ১১৪ জন। এ পরিস্থিতিতে সেনাদের এ অনুষ্ঠানে মাত্র আটটি দেশের প্রতিনিধিরা অংশ নেন। তার মধ্যে বাংলাদেশের মিলিটারি অ্যাটাশে একজন।

বাংলাদেশ ছাড়া যে সাতটি দেশের প্রতিনিধিরা অনুষ্ঠানে যোগ দেন, সেগুলো হচ্ছে চীন, ভারত, রাশিয়া, পাকিস্তান, থাইল্যান্ড, লাওস ও ভিয়েতনাম। মিয়ানমারের সব সুকর্ম-দুষ্কর্মে চোখ বুজে সমর্থনের রেকর্ড এ দেশগুলোর আছে। রোহিঙ্গা গণহত্যা প্রসঙ্গেও দেশগুলো প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে মিয়ানমারেরই পক্ষ নিয়েছে। তাদের এ উপস্থিতি তাই কোনো বিস্ময়ের সৃষ্টি করে না। কিন্তু মোটা দাগে পৃথিবীর অন্যান্য দেশ এই অনুষ্ঠান বর্জন করেছে। এমনকি আশিয়ানভুক্ত ইন্দোনেশিয়া ও মালয়েশিয়ার কোনো প্রতিনিধিও এতে যোগ দেননি। সেখানে বাংলাদেশের মিলিটারি অ্যাটাশের এ উপস্থিতি কী বার্তা দিল?

আটটি দেশের নাম উল্লেখ করে এ ঘটনার ব্যাপক ও তীব্র সমালোচনা হয়েছে গণমাধ্যমসহ বিভিন্ন মহল থেকে, সেগুলোর মধ্যে আছে সু চির দল, মিয়ানমারের গণতন্ত্রকামীদের জোট, জাতিসংঘের সাবেক এক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা এবং রোহিঙ্গারা। বাংলাদেশের মিলিটারি অ্যাটাশে কি অগ্রপশ্চাৎ চিন্তা না করে সরল বিশ্বাসে এ নিমন্ত্রণ রক্ষা করেছে, নাকি এটি সুচিন্তিত সিদ্ধান্তের ভিত্তিতে নেওয়া পদক্ষেপ, আমরা জানি না। প্রথমোক্তটি যদি কারণ হয়, তবে এর নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া কী করে দূর করা যায়, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে তা ভেবে দেখতে হবে। ভুল যারই হোক, সামাল দেওয়ার দায়িত্ব শেষ অবধি পররাষ্ট্রসচিবের কাঁধেই চাপে।

অন্যদিকে এটা যদি সচেতন সিদ্ধান্ত হয়ে থাকে, তবে কী প্রত্যাশায় এটা করা হয়েছে, সে প্রশ্ন থেকে যায়। ক্ষমতাসীন জান্তা এতে খুশি হবে সন্দেহ নেই। আমরা কি মনে করি, তাদের খুশি করে রোহিঙ্গাদের নিয়ে আমাদের যে লক্ষ্য, সেটা পূরণ করতে পারব? বিগত সাড়ে তিন বছর মিয়ানমারকে খুশি রেখেই সমস্যার সমাধান করার চেষ্টা আমরা করেছি, ফলাফল শূন্য। পুরো পশ্চিমা বিশ্ব যখন মিয়ানমারের সমালোচনা করেছে, তখনো আমরা সংযত ছিলাম। প্রথম অবস্থায় সেটা হয়তো সঠিক ছিল। এমনকি রোহিঙ্গাদের রোহিঙ্গা বলে সম্বোধনও করিনি। তড়িঘড়ি যে চুক্তি আমাদের তদানীন্তন পররাষ্ট্রমন্ত্রী সই করেছিলেন, তার প্রায় সব শর্তই ছিল মিয়ানমারের পক্ষে, জাতিসংঘে আমাদের প্রধানমন্ত্রীর দেওয়া ভাষণের প্রতিফলন তাতে দেখিনি। এত দিনে এটা দিবালোকের মতো স্পষ্ট যে অর্থবহ কোনো প্রত্যাবাসনে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী নিজে থেকে রাজি হবে না। জান্তাবিরোধী আন্দোলন সফল হলেও পরবর্তী সরকার যে এ বিষয়ে খুব ইতিবাচক ভূমিকা নেবে, তারও সম্ভাবনা ক্ষীণ। ন্যূনপক্ষে আমরা যা করতে পারি, তা হলো মিয়ানমারে গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের পক্ষে থাকা। রোহিঙ্গাদের মানবাধিকারের পক্ষে আমাদের নীতিগত অবস্থান বিশ্ব সম্প্রদায়ের সামনে তাতে যৌক্তিক প্রতিভাত হবে।

গত সপ্তাহের আরেকটি খবরও বেশ পীড়াদায়ক। মানবাধিকার কাউন্সিলে শ্রীলঙ্কার বিরুদ্ধে উত্থাপিত এক প্রস্তাবে শ্রীলঙ্কার পক্ষে ভোট দিয়েছে বাংলাদেশ। প্রস্তাবে শ্রীলঙ্কায় মানবাধিকার পরিস্থিতির অবনতিতে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়। মুসলিমপ্রধান দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ ছাড়া শ্রীলঙ্কার পক্ষে ভোট দিয়েছে শুধু পাকিস্তান ও উজবেকিস্তান। শ্রীলঙ্কা তামিলদের বিরুদ্ধে গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের দায়ে অভিযুক্ত। রাজাপক্ষের ভাইয়েরা গৃহযুদ্ধের শেষ পর্যায়ে যুদ্ধাপরাধ করেছিলেন বলেও অভিযোগ আছে। এ সরকারের বিরুদ্ধে শ্রীলঙ্কান মুসলমানদের প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণের অভিযোগও আছে। প্রস্তাবে ভারত ও নেপাল ভোটদানে বিরত ছিল।

মানবাধিকার কাউন্সিলের পরবর্তী নির্বাচনে শ্রীলঙ্কা বাংলাদেশের পক্ষে ভোট দেবে, এমনটা জানিয়েছেন আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী। কোনো নির্বাচনে বাংলাদেশ এক-দুই ভোটে হেরেছে, এমন উদাহরণ মনে পড়ছে না। আমরা হয় সহজে জিতেছি, নয়তো অনেক ভোটে হেরেছি। তা ছাড়া ব্রিটেনের উত্থাপিত এ প্রস্তাবের বিপক্ষে ভোট দিয়ে আমরা কিছু পশ্চিমা ভোট হারাব না, এমনও নিশ্চয়তা নেই। শ্রীলঙ্কায় আমাদের খুব জোরালো কোনো স্বার্থ নেই যে অবশ্যই তাদের খুশি রাখতে হবে; বরং উল্লেখযোগ্যসংখ্যক শ্রীলঙ্কান বাংলাদেশে কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করেন। রোহিঙ্গা প্রশ্নেও শ্রীলঙ্কা বরাবর পরোক্ষে মিয়ানমারেরই পক্ষ নিয়েছে। শ্রীলঙ্কার পক্ষে আমাদের এ অবস্থানের যৌক্তিকতা খুঁজে পাওয়া তাই কঠিন। সরাসরি বিপক্ষে না গিয়ে, ভারত, নেপালের মতো বাংলাদেশও সহজেই ভোটদানে বিরত থাকতে পারত।

মো. তৌহিদ হোসেন সাবেক পররাষ্ট্রসচিব