বাংলাদেশে সহিষ্ণুতা

বাংলাদেশে একটি প্রচলিত ধারণা হলো, ধর্মীয় সম্প্রদায়গুলো শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানে একত্রে বসবাস করে এবং এই সংস্কৃতি প্রাচীনকাল থেকেই চলে আসছে। বিভিন্ন ধর্মীয় অনুষ্ঠান ও উৎসব উদ্যাপনের মধ্যে এর প্রমাণ রয়েছে। ঈদ, দুর্গাপূজা, বুদ্ধপূর্ণিমা ও বড়দিনের মতো ধর্মীয় অনুষ্ঠান ও উৎসবগুলোয় এ দেশের সব জনসাধারণের অংশগ্রহণ রয়েছে। বাংলাদেশের জনগোষ্ঠীর শতকরা ৯০ ভাগই মুসলমান। বাকিদের মধ্যে হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টানসহ অন্য নৃগোষ্ঠীর মানুষ রয়েছে। এমন একটি ধর্মীয় সংখ্যাগরিষ্ঠতার দেশে এটি একটি উল্লেখযোগ্য অর্জন। একই ধরনের পরিস্থিতিতে বিশ্বের অন্যান্য অনেক স্থানে ধর্মীয় বৈচিত্র্যকে সম্মান দেখানোর ক্ষেত্রে বাংলাদেশের মতো আচরণ লক্ষ করা যায় না। এই অর্জনের জন্য বাংলাদেশের সাধারণ জনগোষ্ঠী প্রশংসা পাওয়ার যোগ্য। দেশটির সংবিধানে সব ধর্মের সমমর্যাদার নিশ্চয়তা দেওয়া হয়েছে, যা অসহিষ্ণুতার বিরুদ্ধে একটি রক্ষাকবচ হিসেবে কাজ করে।
এসব নানা কারণে বাংলাদেশ একটি সহিষ্ণু সমাজ হিসেবে স্বীকৃত। কিন্তু এরপরও কিছু লক্ষণে এটা বোঝা যায় যে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের ক্ষেত্রটি অনেক চাপের সম্মুখীন হচ্ছে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, ভূমি দখলের কিছু দৃষ্টান্ত রয়েছে, যেখানে ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায় মনে করে, তাদের সম্পত্তির মালিকানা হুমকির সম্মুখীন। এ ছাড়া ২০১২ সালে রামুতে বৌদ্ধধর্মাবলম্বীদের উপাসনালয়গুলোয় হামলা ও ধ্বংসযজ্ঞের যে ঘটনা ঘটেছিল, তা এখনো মানুষের মনে সজীব রয়েছে। উপরন্তু, গত ৩০ বছরে হিন্দু জনগোষ্ঠীর সংখ্যা ৫০ শতাংশে নেমে এসেছে। প্রকৃত অথবা ধারণাগত কারণে এটা মনে করা হয় যে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ব্যাপারে বাংলাদেশ তার সহিষ্ণুতার বৈশিষ্ট্য কিছুটা হারাচ্ছে।
এসব নেতিবাচক বিষয় সত্ত্বেও ধর্মীয় অসহিষ্ণুতা ও চরমপন্থা বাংলাদেশের সমাজে এখনো সাধারণভাবে পরিলক্ষিত হয় না। দুঃখজনকভাবে বিশ্বের অন্যান্য প্রান্তের ক্ষেত্রে বিষয়টি তেমন নয়। বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্যে আমরা গত কয়েক বছরে চরমপন্থী মতবাদের প্রসার দেখেছি। এমনকি যেসব দেশকে সহনশীলতার আদর্শ বলে মনে করা হতো, তারাও এ ক্ষেত্রে বর্তমান বাংলাদেশের মতো সহনশীল হতে পারেনি। এ কথাগুলো মনে রেখেই এটা অস্বীকার করা যায় না যে বাংলাদেশ সাম্প্রতিক কালে এমন কিছু ঘটনার মুখোমুখি হয়েছে, যা দেশটিকে এর ঐতিহ্যগত সহিষ্ণুতার বৈশিষ্ট্যের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ নয়। ধর্মীয় সংখ্যালঘু ব্যক্তি ও তাদের উপাসনালয়ের ওপর কিছু সহিংস আক্রমণের ঘটনা ঘটেছে, যাতে জীবনহানি ও সম্পত্তি বিনষ্ট হয়েছে। এই ঘটনাগুলোর মধ্যে রয়েছে দিনাজপুরে হিন্দু মন্দিরে বোমা হামলা, পঞ্চগড়ের কাছে এক হিন্দু পুরোহিতকে হত্যা, পাবনা ও দিনাজপুরে খ্রিষ্টান যাজকের ওপর সহিংস সশস্ত্র হামলা ও অন্যান্য কয়েকজন ধর্মগুরুকে হত্যার হুমকি, ঢাকায় শিয়া মিছিলে ও শিবগঞ্জে শিয়া মসজিদে সশস্ত্র আক্রমণ এবং এ কারণে মুয়াজ্জিনের মৃত্যু। এ ছাড়া গত বেশ কয়েক বছরে অনলাইন অ্যাকটিভিস্টদের ওপর বেশ কিছু আক্রমণের ঘটনা ঘটেছে, সে ব্যাপারেও আমরা সবাই অবহিত।
এ ধরনের ঘটনাগুলো পরিবর্তিত সমাজের সুস্পষ্ট বহিঃপ্রকাশ। এটা এমন একটি পরিবেশের সূচনা ঘটাচ্ছে, যেখানে ভয়, সন্ত্রাস ও অসহিষ্ণুতা বিরাজ করে। এই প্রবণতা খুবই উদ্বেগজনক এবং এটা রাজনৈতিক ক্ষেত্রের সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গ ও বিভিন্ন ধর্মীয় নেতৃত্বের গুরুত্বসহকারে বিবেচনায় নেওয়া প্রয়োজন। এমন পরিস্থিতিতে যেখানে লোকজনের জীবনহানি হয়েছে এবং ধর্মীয় উপাসনালয়গুলো ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছে, সেগুলোর পরিষ্কারভাবে নিন্দা জানানো ও অপরাধীদের বিচারের আওতায় আনা প্রয়োজন। যদি এটি না হয়, ভবিষ্যতে এ ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটার আশঙ্কা প্রবল এবং দায়মুক্তির সংস্কৃতি বিরাজমান থাকতে পারে।
২০১৫ সালের এপ্রিলে অনুষ্ঠিত সহিষ্ণুতার উন্নয়ন ও পুনরেকত্রীকরণ শান্তিপূর্ণ, অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ লালন এবং সশস্ত্র চরমপন্থা দমন-বিষয়ক উচ্চপর্যায়ের বিষয়ভিত্তিক সম্মেলনে মহাসচিব মন্তব্য করেন, জাতিসংঘ ‘এর মৌলিক মূল্যবোধ শান্তি, ন্যায়পরায়ণতা ও মানুষের মর্যাদাকে চরমপন্থীদের ঘৃণা ও ভয়ের প্রকৃত বিকল্প হিসেবে তুলে ধরবে। সংস্থাটি ন্যায়সংগত প্রতিষ্ঠান, অন্তর্ভুক্তিমূলক শাসন এবং মানবাধিকার ও আইনের শাসনের প্রতি শ্রদ্ধা এগুলোর মাধ্যমে নিবারণমূলক ব্যবস্থার ওপর দৃষ্টিপাত করবে। এ ছাড়া আমরা অবশ্যই এই আন্দোলনে নারীদের তাদের ন্যায্য ও নেতৃত্বশীল ভূমিকা অনুধাবন করতে সক্রিয় করে তুলব।’
এগুলো মনে রেখেই বাংলাদেশে জাতিসংঘ এমন একটি সংস্কৃতি তৈরির প্রয়োজনীয়তাকে তুলে ধরতে চায়, যা চিন্তা, বিবেক ও ধর্মের স্বাধীনতাকে শ্রদ্ধা করে। মানবাধিকারের সুরক্ষা এ-জাতীয় কোনো নীতির কেন্দ্রবিন্দু হবে, যা সংশ্লিষ্ট আইন, নীতি ও প্রায়োগিক পদক্ষেপ দ্বারা সমন্বিত হওয়া প্রয়োজন। এ ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা, আইনের শাসন ও জনপ্রিয় অংশগ্রহণের বিষয়গুলোর সঙ্গে সংগতি রেখে নির্বাহী বিভাগ, আইন প্রয়োগকারী সংস্থা ও বিচার বিভাগের প্রয়োজনীয় প্রাতিষ্ঠানিক অবকাঠামোর বিস্তারিত বর্ণনা ও পরিকল্পনা উভয়ই হওয়া প্রয়োজন।
৯ মার্চ ধর্ম অথবা বিশ্বাসের স্বাধীনতা বিষয়ে জাতিসংঘের বিশেষ র্যা পোর্টিয়ার জেনেভায় জাতিসংঘ মানবাধিকার পরিষদে তাঁর প্রতিবেদন উপস্থাপন করবেন। উল্লেখ্য, ২০১৫ সালের সেপ্টেম্বর মাসে তিনি বাংলাদেশ সফর করে গেছেন। আশা করা যায়, এই প্রতিবেদন ও এর অন্তর্ভুক্ত সুপারিশগুলো বাংলাদেশে ধর্ম অথবা বিশ্বাসের স্বাধীনতা ভোগের বিষয়টিকে আরও শক্তিশালী করার ক্ষেত্রে ভূমিকা পালন করবে। এবং এই প্রতিবেদন ও সুপারিশগুলোকে এ-সংক্রান্ত আলোচনা ও কার্যক্রম গ্রহণের জন্য কাঠামো তৈরির একটি সুযোগ হিসেবে দেখা হবে। একই সঙ্গে তা এ দেশে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের অবস্থা উন্নয়নেরও একটি সুযোগ করে দেবে।
রবার্ট ওয়াটকিন্স: বাংলাদেশে জাতিসংঘের আবাসিক সমন্বয়কারী।