বাংলাদেশ যেভাবে চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের মডেল হতে পারে

চতুর্থ শিল্পবিপ্লব এখন একটি বাস্তবতা। এটিকে আর অস্বীকার করার উপায় নেই। আমরা কেমন অনুভব করি, কীভাবে কাজ করি, কীভাবে থাকি, ভ্রমণ করি—সবকিছুই বদলে যাবে। প্রথম শিল্পবিপ্লব হলো বাষ্পীয় ইঞ্জিন নিয়ে, দ্বিতীয় বিপ্লবটি বিদ্যুতের, তৃতীয়টি ইন্টারনেট ও কম্পিউটারবিষয়ক। চতুর্থ শিল্পবিপ্লব ঘটছে ইন্টারনেটের সঙ্গে বুদ্ধিমত্তা যোগের মাধ্যমে।

একটি উদাহরণ দিয়ে শুরু করা যাক। কোম্পানির একজন প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) সকালে গুগল অ্যাসিস্ট্যান্ট বা অ্যাপল সিরি দিয়ে আবহাওয়ার পূর্বাভাস কিংবা যানজট চেক করতে পারেন, স্বচালিত গাড়ি ব্যবহার করে অফিসে যেতে পারেন, সেখানে রোবট তাঁকে স্বাগত জানাতে পারে, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহার করে ব্যবসার ভবিষ্যৎ সম্পর্কে ধারণা নিতে পারেন, মেশিন লার্নিং ব্যবহার করে ব্যবসায়িক মডেল ডিজাইন করতে পারেন, ইন্টারনেট অব থিংসের মাধ্যমে বাসাবাড়ির ইলেকট্রনিকস ও অ্যাপ্লায়েন্স নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন এবং আরও অনেক কিছু করতে পারেন।

বাংলাদেশে শিগগিরই চালু হতে যাচ্ছে ফাইভ-জি ইন্টারনেট। এটি ব্যবসার মডেল, জীবনযাত্রার মান, শিক্ষাপদ্ধতি, ডিজিটাল ও সোশ্যাল মিডিয়া, যা গত এক দশক ধরে দেখে আসছি, তার ব্যাপক পরিবর্তন করতে পারে। চতুর্থ শিল্পবিপ্লব উচ্চমানের শিক্ষা ও গবেষণার মাধ্যমেই প্রকৃত অর্থে বাস্তবায়ন করা সম্ভব। বিশ্বের অনেক জায়গায়, যেমন স্ক্যান্ডিনেভিয়ান দেশগুলো চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের( ফোরআইআর) সুবিধা নেওয়ার জন্য তাদের জনশক্তি প্রস্তুত করছে। এ কারণেই এই দেশগুলো তাদের শিক্ষায় কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ও রোবটিকসকে একীভূত করেছে, প্রাথমিক স্তর থেকে শুরু করে উচ্চশিক্ষা পর্যন্ত তাদের মানবসম্পদের জ্ঞানীয় মনকে ফোরআইআরের নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য কাজ শুরু করেছে।

এখন বিশ্লেষণ করা যাক বাংলাদেশ কীভাবে বিশ্বে চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের একটি উদীয়মান রোল মডেল হতে পারে। প্রথমত, ডিজিটাল বাংলাদেশের ভিত্তি শক্ত। গত ১৩ বছরে ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ বাস্তবায়নের ফলে সারা দেশে, প্রায় প্রতিটি খাতের পাশাপাশি মানুষের দৈনন্দিন জীবনে আইসিটি খাত প্রভাব ফেলেছে। ইউনিয়ন ডিজিটাল সেন্টার (ইউডিসি) এখন ফাইবার অপটিক্যাল তারের মাধ্যমে সংযুক্ত করা হচ্ছে; স্কুলগুলো এখন শেখ রাসেল ডিজিটাল ল্যাব দিয়ে সজ্জিত; হাজার হাজার ইন্টারঅ্যাকটিভ কনটেন্ট এবং ই-বুক ডিজাইন ও ডেভেলপ করা হয়েছে; ১০০টি অর্থনৈতিক অঞ্চল তৈরি করা হচ্ছে ইত্যাদি। এভাবে ডিজিটাল বাংলাদেশ আমাদের দেশে ফোরআইআর চালু করার জন্য একটি উপযুক্ত প্ল্যাটফর্ম তৈরি করেছে।

দ্বিতীয়ত, আমাদের দারুণ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জিত হচ্ছে। ২০২০-২১ অর্থবছরে বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় ৩২৭ ডলার থেকে বেড়ে ২ হাজার ৫৫৪ ডলার হয়েছে। ২০২১ সালের নভেম্বরে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে স্বল্পোন্নত দেশ (এলডিসি) ক্যাটাগরি থেকে বাংলাদেশকে উন্নীত করার একটি প্রস্তাব গৃহীত হয়েছে। সরকার ২০৪১ সালের মধ্যে ১৫ হাজার ডলারের মাথাপিছু আয়ের পাশাপাশি জনগণকে সমানভাবে ক্ষমতায়ন করে একটি ধনী দেশে পরিণত হওয়ার পরিকল্পনা করেছে। চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের সম্ভাবনাকে কোনো বিলম্ব ছাড়াই শুরু করা উচিত। দেশের জিডিপির আকার আজকের ২২৫ বিলিয়ন ডলার থেকে ২০৪১ সালে ২ দশমিক ৬ ট্রিলিয়ন ডলারে পরিণত হবে। এখন সরকার উচ্চশিক্ষা ঋণ কর্মসূচি চালু করতে পারে। করদাতার আয় ও চাকরির সুযোগের ওপর ভিত্তি করে সম্পূর্ণ বিনা মূল্যে, সরকার ভর্তুকি এবং সম্পূর্ণ ফি প্রদানের মতো উচ্চশিক্ষার প্রকল্পগুলো থাকা উচিত। সরকার ফোরআইআর-সম্পর্কিত কোর্স ও প্রোগ্রামগুলোতে আরও বেশি ভর্তুকি প্রদান করতে পারে।

এখন আমাদের নীতিনির্ধারকদের উচিত চতুর্থ শিল্পবিপ্লব-সম্পর্কিত গবেষণা ও উদ্ভাবনকে অগ্রাধিকার দিয়ে শিক্ষানীতি পুনর্বিবেচনা করা, যাতে বৈশ্বিক পর্যায়ে আমরা একটি প্রতিযোগিতামূলক, উদ্ভাবনী ও দক্ষ দেশ হিসেবে টিকে থাকতে পারি। তাই চলুন উদ্ভাবন করি, অনুকরণ নয়।

তৃতীয়ত, কর্মক্ষম বয়সের জনসংখ্যার অনুপাত। আয়তনের দিক থেকে বাংলাদেশের অবস্থান ৯৩তম। কিন্তু জনসংখ্যার দিক থেকে আমরা বিশ্বের অষ্টম বৃহত্তম দেশ। আমাদের এখন কাজের বয়সের লোক (১৫-৬৪ বছর) আগের যেকোনো সময়ের তুলনায় অনেক বেশি রয়েছে। এটি এখন ৬৬ শতাংশ এবং ২০৩০ সাল নাগাদ তা ৭০ শতাংশে উন্নীত হবে। চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের আবির্ভাবের ফলে অনেকের চাকরি চলে যাবে, এটা সত্য। কিন্তু আরও বেশি নতুন চাকরির সৃষ্টি হবে। তাই যদি এই বৃহৎ জনসংখ্যাকে ফোরআইআরের জন্য একটি দক্ষ কর্মশক্তিতে রূপান্তর করা যায়, তাহলে এটি আমাদের চলমান অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নকে আরও শক্তিশালী করবে।

চতুর্থত, ব্লেন্ডেড, অনলাইন ও ডিজিটাল শিক্ষার বিস্তার। ব্লেন্ডেড লার্নিং হতে পারে সারা দেশের উচ্চ প্রযুক্তি, নিম্ন প্রযুক্তি ও প্রযুক্তিহীন জনগণকে সংযুক্ত করে বাংলাদেশের অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়নের একটি ভালো সমাধান। ইউজিসি সম্প্রতি ন্যাশনাল ব্লেন্ডেড লার্নিং পলিসি ২০২১ নীতিগতভাবে অনুমোদন দিয়েছে এবং এখন সরকার এটিকে প্রাক্‌-প্রাথমিক থেকে স্নাতকোত্তর পর্যন্ত বিস্তৃত করছে। পরবর্তী ধাপ হলো অনলাইন ডিজিটাল শিক্ষা। বাংলাদেশ এখনো বৈশ্বিক অনলাইন শিক্ষা শিল্পে তার উপস্থিতি বোঝাতে পারেনি, যার মূল্যমান ২০২৬ সালের মধ্যে ৩৭৫ বিলিয়ন ডলার হতে পারে। এটি সহজেই রেমিট্যান্স এবং তৈরি পোশাকশিল্পের পর তৃতীয় সর্বোচ্চ আয়ের উৎস হতে পারে, যদি ফোরআইআর প্রযুক্তি শিক্ষাব্যবস্থার সঙ্গে কার্যকরভাবে সংহত করা যায়।

পঞ্চমত, ফলিত গবেষণা ও উদ্ভাবনের প্রবণতা বৃদ্ধি। যদিও বিভিন্ন বৈশ্বিক সূচকে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের র‌্যাঙ্কিং ততটা ভালো নয়, কিন্তু আমরা কৃষি, অটোমেশন, ফ্রিল্যান্সিং, এসএমই সেক্টর, নারীর ক্ষমতায়ন, দারিদ্র্য বিমোচন ইত্যাদি ক্ষেত্রে ক্রমবর্ধমান উন্নতি করছি। সরকার সাম্প্রতিক বছরগুলোতে তার বিভিন্ন বিভাগের মাধ্যমে তৃতীয় ও চতুর্থ শিল্পবিপ্লব-সম্পর্কিত গবেষণা ও উদ্ভাবনের জন্য আরও বেশি তহবিল বরাদ্দ করছে।

ষষ্ঠত, কারিগরি শিক্ষার ওপর জোর দেওয়া। ৩০০ মিলিয়ন ডলার মূল্যের ত্বরান্বিত এবং অর্থনৈতিক পরিবর্তনের জন্য দক্ষতা শক্তিশালীকরণ ‘এসেট’ প্রকল্পটি ১ মিলিয়নের বেশি যুবক ও কর্মীদের ভবিষ্যতের কাজের জন্য প্রয়োজনীয় দক্ষতা দিয়ে তৈরি করবে। প্রতিটি উপজেলায় একটি করে টেকনিক্যাল স্কুল অ্যান্ড কলেজ থাকবে এবং উপজেলা আইসিটি ট্রেনিং অ্যান্ড রিসোর্স সেন্টার ফর এডুকেশন প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। কারিগরি শিক্ষায় গ্র্যাজুয়েটদের চাকরির জন্য অপেক্ষা করতে হয় না; বরং তাঁরা অন্যদের চাকরির সুযোগ তৈরি করে।

সর্বশেষে, ইন্ডাস্ট্রি-একাডেমিয়া সংযোগের গুরুত্ব অনুধাবন। প্রতিবছর প্রায় দুই মিলিয়ন নতুন প্রবেশকারী শ্রমশক্তিতে যোগদান করে, কিন্তু এখনো ৩৮ দশমিক ৬ শতাংশ স্নাতক বেকারত্ব প্রকারান্তরে দক্ষতার অমিল নির্দেশ করে। ফলে বিভিন্ন ইন্ডাস্ট্রি, করপোরেট সংস্থা এবং বহুজাতিক কোম্পানিগুলোতে প্রযুক্তিগত ও ব্যবস্থাপনা স্তরে বিদেশিরা আমাদের চাকরির বাজারে আধিপত্য বিস্তার করে। জাতীয় দক্ষতা উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের মতে এ প্রবণতা বাংলাদেশ থেকে প্রতিবছর ছয় বিলিয়ন ডলার রেমিট্যান্স নিয়ে যায়। এখন সরকার এটা ভুলভাবে বুঝতে পেরেছে এবং প্রয়োজনভিত্তিক কারিকুলাম, আউটকাম বেজড শিক্ষা, বিভিন্ন পর্যায়ের ইন্টার্নশিপ প্রোগ্রাম ইত্যাদির ওপর জোর দিয়েছে।

ভবিষ্যৎ কাজগুলো হবে এমন, যা মেশিন করতে পারে না, একই সঙ্গে সৃজনশীল প্রচেষ্টা, সামাজিক মিথস্ক্রিয়ার মতো ক্ষেত্রগুলো যেখানে মানুষ মেশিনকে হারাতে পারে, সেই ক্ষেত্রগুলো চাকরি সৃষ্টির জন্য উন্মুক্ত থাকবে। এখন আমাদের নীতিনির্ধারকদের উচিত চতুর্থ শিল্পবিপ্লব-সম্পর্কিত গবেষণা ও উদ্ভাবনকে অগ্রাধিকার দিয়ে শিক্ষানীতি পুনর্বিবেচনা করা, যাতে বৈশ্বিক পর্যায়ে আমরা একটি প্রতিযোগিতামূলক, উদ্ভাবনী ও দক্ষ দেশ হিসেবে টিকে থাকতে পারি। তাই চলুন উদ্ভাবন করি, অনুকরণ নয়।

মো. আকতারুজ্জামান ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক