বাঙালির আতিশয্য ও পরিমিতিবোধ

শিহাবুর রহমান ও টিটোন আলীকে সংবর্ধনা দিয়েছে বাংলাদেশ রেলওয়ে
শিহাবুর রহমান ও টিটোন আলীকে সংবর্ধনা দিয়েছে বাংলাদেশ রেলওয়ে

মূলধারার মানুষের দৈনন্দিন ছোট কাজেই একটি জাতির স্বভাব ও চরিত্রের প্রকাশ পায়। কোনো একটি খুব বড় ঘটনা জাতির স্বভাব ও চরিত্রের পরিচয় বহন করে না। যেমন কোনো দেশে খুব বড় একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলন হয়ে গেল, তা খুব জাঁকজমক করে অনুষ্ঠিত হলো, তাতে ওই জাতির বৈশিষ্ট্যের পরিচয় পাওয়া যাবে না। ওটা একটা অতি পরিকল্পিত ব্যাপার। অন্যদিকে প্রতিদিন সারা দেশে সাধারণ মানুষের বাড়িতে যে বিয়ের অনুষ্ঠান, সেখানে যে আনন্দ-ফুর্তি, খানাপিনা তার মধ্যেই জাতীয় চরিত্রের সত্যিকারের প্রকাশ ঘটে। সব সময় ঘটা এবং স্বতঃস্ফূর্তভাবে ঘটা কাজকর্মের মধ্যে বাঙালির রুচি ও মেধার পরিচয় পাওয়া যায়। রবীন্দ্রনাথ, নজরুল ইসলাম, মুহাম্মদ কুদরাত-এ-খুদা, অমর্ত্য সেনকে দিয়ে বাঙালির মেধা পরিমাপ করা যাবে না। তাঁদের আচার-ব্যবহার দিয়েও বাঙালির স্বভাব ও চরিত্র বোঝা যাবে না।

একটি জাতি কতটা মেধাসম্পন্ন, তার চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ তারা কতটা পরিমিতিবোধসম্পন্ন। একটি ভালো কাজও কতটা এবং কী মাত্রায় করা উচিত, সে বোধ থাকা চাই। কেউ কোনো ব্যাপারে কৃতিত্বের পরিচয় দিয়েছে অথবা একজন একটি ভালো কাজ করেছে, তাকে অভিনন্দিত করা বা প্রশংসা করা কিংবা পুরস্কৃত করা খুবই আবশ্যক। বরং তা না করাই দীনতার পরিচয়।

১৮ ডিসেম্বর রাজশাহীর বাঘা উপজেলার আড়ানি স্টেশনের ৪০০ মিটার দূরে ঝিনা রেলগেটে রেললাইন ভাঙা দেখে দুটি শিশু লাল মাফলার উঁচু করে ওড়াতে থাকে। তা দেখে তেলবাহী ট্রেনের চালক ট্রেন থামান। তাতে ইঞ্জিনসহ ৩২টি বগির তেলবাহী ট্রেন দুর্ঘটনা থেকে রক্ষা পায়। শিশু দুটির নাম শিহাব ও টিটোন। তারা যথাক্রমে প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির ছাত্র। শুভবুদ্ধি মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি। পরিবেশ পরিস্থিতির কারণে মানুষের মধ্যে অশুভবুদ্ধি প্রাধান্য পেয়ে থাকে।

পরদিন রাজশাহী প্রতিনিধির পাঠানো প্রতিবেদন ‘লাল মাফলারে ট্রেন রক্ষা’ শিরোনামে প্রথম আলোর প্রথম পাতায় গুরুত্ব দিয়ে দুই শিশুর ছবিসহ প্রকাশিত হয়। চমৎকার পরিবেশন ছিল প্রতিবেদনটির। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘শিশু দুটির এই বুদ্ধিতে খুশি হয়ে তাদের দায়িত্ব নিয়েছেন স্থানীয় সাংসদ ও পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম। তিনি ঘোষণা দিয়েছেন, দুই শিশুকে প্রতি মাসে শিক্ষার জন্য এক হাজার টাকা করে বৃত্তি দেবেন। তারা যদি স্কুল-কলেজ শেষ করে উচ্চশিক্ষার জন্য পড়তে চায়, সেই দায়িত্বও প্রতিমন্ত্রী নিতে চান।’ খুবই উপযুক্ত ও প্রশংসার কাজ করেছেন তিনি।

বঙ্গীয় সমাজে বহু বয়স্ক মানুষেরই যখন শুভবুদ্ধির অভাব, তখন শিশু দুটি অত্যন্ত সুবুদ্ধির পরিচয় দিয়েছে। ভবিষ্যতে ওরা ভালো মানুষ হোক ও সমাজের কল্যাণ করুক-ওদের জন্য এই আমাদের প্রার্থনা। তা ছাড়া ওদের ও ওদের সমবয়সীদের উৎসাহিত করতে কিছু উপঢৌকন বা পুরস্কারও ওদের প্রাপ্য। সবচেয়ে ভালো পুরস্কার হয় ছোটদের সচিত্র গল্পের বই। তার পরিবর্তে খেতাব সংবর্ধনা পুরস্কার প্রভৃতি যা ওদের দু-তিন দিনে জুটেছে, দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের পুত্রের ভাষায় ওদের গাইতে হয়, এই মনিহার আমায় নাহি সাজে।

পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর ঘোষণার পরে রেলমন্ত্রী বসে থাকতে পারেন না। কারণ ঘটনাটি ঘটেছে রেললাইনের ধারে এবং মালবাহী ট্রেনকে কেন্দ্র করে। রেলমন্ত্রীর নির্দেশে পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়ের রাজশাহীর মহাব্যবস্থাপক দুই শিশুকে ‘বীর সৈনিক’ উপাধিতে ভূষিত করেন এবং উপাধিপ্রাপ্তি উপলক্ষে আয়োজন করেন সংবর্ধনার। সে সংবর্ধনাও তাঁর অফিসকক্ষে অনাড়ম্বরে নয়। বড় হলঘরে। ত্বরিত তৈরি করা হয় ডিজিটাল ব্যানার। তাতে লেখা ‘সংবর্ধনা ও পুরস্কার প্রদান অনুষ্ঠান’ ইত্যাদি। একটি পত্রিকার প্রতিবেদনে দেখা যাচ্ছে, ‘তাদের ৫০ হাজার করে টাকা এবং ক্রেস্ট দেওয়া হয়। তা ছাড়া রেলওয়ের “বীর সৈনিক” উপাধির পাশাপাশি ফুল দিয়ে বরণ করে নেওয়া হয় তাদের।’

বঙ্গীয় কোনো অনুষ্ঠানে সভাপতি এবং প্রধান অতিথি ও বিশেষ অতিথি থাকতেই হবে। ওই অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন পশ্চিমাঞ্চল রেলের মহাব্যস্থাপক। সভাপতিত্ব করেন অতিরিক্ত মহাব্যবস্থাপক। বিশেষ অতিথি ছিলেন দুজন প্রধান প্রকৌশলী ও প্রধান বাণিজ্য কর্মকর্তা (সিসিএম)। ভাষণ দান করেন রেলওয়ে শ্রমিক লীগের ওপেন লাইন শাখার সভাপতি, সদর দপ্তর শাখার সভাপতি, বি আর শাখার বিভাগীয় ব্যবস্থাপক এবং অনুষ্ঠান সঞ্চালনায় ছিলেন দুই নেতা-সদর দপ্তর শ্রমিক লীগের সাধারণ সম্পাদক ও ওপেন লাইন শাখার সাধারণ সম্পাদক। এই জাতীয় সংবর্ধনা সভায় একজনকে রেখে অন্যকে বাদ দিলে গোটা অনুষ্ঠানের ওপরই পড়তে পারে মারাত্মক প্রভাব। অ্যাম্বুলেন্স ডাকারও প্রয়োজন হতে পারে।

পত্রিকায় যে প্রাঞ্জল ছবি দেখেছি, তাতে শিশু দুটিকে চোখে পড়ে না, কর্মকর্তা ও শ্রমিক নেতারাই আসল। তাঁদের কোমরের সমান বাচ্চা দুটির বিব্রতকর অবস্থা। বৃত্তি হোক, পদক-পুরস্কার হোক, গ্রহীতা গুরুত্বপূর্ণ নয়, উপলক্ষমাত্র দাতারাই আসল। পুরস্কৃত যে হচ্ছে তার চেয়ে পুরস্কারদাতা এবং যার হাত দিয়ে পুরস্কার প্রদান করা হচ্ছে তিনিই প্রধান। পুরস্কারদাতাদের মুখনিঃসৃত উপদেশ বর্ষিত শুধু পুরস্কারগ্রহীতার ওপর নয়, সমগ্র জাতির ওপর। প্রধান অতিথি বলেন, ‘ওই শিশুরা দেশের সব নাগরিককে দেশপ্রেমের কথা বুঝিয়ে দিয়েছে। দেশের প্রতিটি জিনিস জাতীয় সম্পদ। এগুলো রক্ষায় সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে।’

শিশু দুটি থেকে দেশের সব নাগরিককে শিক্ষা নিতে হবে, তাতে কারও দ্বিমত নেই। দেশের প্রতিটি জিনিসের মধ্যে রেলওয়ের জিনিসপত্রও জাতীয় সম্পদ, তাতেও কেউ দ্বিমত করবে না। এসব জাতীয় সম্পদ রক্ষায় সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে-এ নির্দেশও শিরোধার্য। তবে রেলের জাতীয় সম্পদ রক্ষায় রেলের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দায়িত্ব অন্যান্য নাগরিকের চেয়ে বেশি।

যা হোক, ‘বীর সৈনিক’ উপাধি পাওয়ার পরদিন ওরা আরও দুটি খেতাব পায় ‘মাফলার বীর’ এবং ‘আড়ানির নায়ক’। বিষয়বস্তুর সঙ্গে সংগতি রেখে এই দুই উপাধি। মাফলার দুলিয়ে ট্রেন থামানোর কারণে ‘মাফলার বীর’ আর ঘটনাটি ঘটেছে আড়ানি নামক জায়গায়, সেই কারণে ‘আড়ানির নায়ক’। উল্লেখ্য, ঘটনাটি ঘটার পর প্রথম আলো ছাড়া আর কোনো পত্রিকা প্রতিবেদন করেনি। ওই রিপোর্ট হওয়ার পর থেকে শিশু দুটিকে নিয়ে বিচিত্র সব ব্যাপার ঘটছে।

আগামী ১৩ জানুয়ারি থেকে ঢাকায় শুরু হচ্ছে রেইনবো আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব। পত্রিকার খবরে জানা গেল, সেই উৎসবে শিশু বিভাগের চলচ্চিত্রও প্রদর্শিত হবে। শিশু বিভাগের শ্রেষ্ঠ পুরস্কারটি ‘আড়ানির নায়ক’ দুই শিশুর হাত দিয়ে ‘বিজয়ীদের হাতে তুলে দেওয়া হবে।’ গত শুক্রবার পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী ‘মাফলার বীর’দের বাড়িতে যান। ‘এ সময় ওই দুই শিশুর পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে তিনি কিছু সময় কাটান’-পরে তাদের ছবি দিয়ে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী ফেসবুকে এই স্ট্যাটাস দেন। যেখানে ‘আড়ানির নায়ক’ হ্যাশ ট্যাগ দিয়ে লিখেছেন, জানুয়ারির ১৩ তারিখ থেকে ঢাকায় শুরু হওয়া রেইনবো আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে শিশু বিভাগের শ্রেষ্ঠ পুরস্কারটি টিটোন ও শিহাব দুজন মিলে বিজয়ীদের হাতে তুলে দেবে।
শিশু দুটির বয়স ১০ বছর হতে আরও দেরি। বেঁচে থাকলে একদিন ওরা কিশোর হবে, তারপর হবে পেশিবহুল যুবক। তখন সৈনিক হওয়ার শারীরিক যোগ্যতা অর্জন করবে। বীরত্ব প্রদর্শনের দৈহিক শক্তি অর্জন করবে। লাল মাফলার উঁচু করে ধরার মধ্যে বীরত্ব যতটা ছিল ভালোত্ব এবং শুভবুদ্ধিই ছিল মূলত। বীরত্ব জিনিসটি কী, সৈনিক কাকে বলে, নায়ক শব্দের অর্থ কী, তা বোঝার বয়স এখনো ওদের হয়নি।

যদি ‘ছাগলের জন্য মাঠে ঘাস কাটা শেষে’ ওরা ‘ওই জায়গায় লাইন ভাঙা দেখতে না পেত’ এবং ওদের কাছে লাল মাফলার না থাকত, তাহলে কী হতো? হয়তো দুর্ঘটনা ঘটত। দেশের ও রেলের ক্ষতি হতো। তার দায়িত্ব কে নিত? দেশপ্রেমে উজ্জীবিত রেল কর্মকর্তা তখন কী কৈফিয়ত দিতেন? রেললাইন ভাঙা কি ভালো, তা দেখার দায়িত্ব তো রেলের কর্মচারীদের-লাইনের ধারের শিশুদের নয়।

বাংলাদেশ রেলওয়ের অবস্থা কী, তা পত্রপত্রিকার পাঠক ও ট্রেনের যাত্রীদের জানা। অব্যবস্থাপনা ও দুর্নীতিতে সয়লাব। নিয়োগ-বাণিজ্য সীমাহীন। রেলের জমি বেদখল হয়ে যাচ্ছে প্রতিদিন। এখন শুধু রেললাইন দখল করা বাকি। এসব অনাচার থামানোর কেউ নেই। অথচ ভারত ও থাইল্যান্ডের তুলনায় রেলপথ কিলোমিটার হিসাবে বাংলাদেশ রেলের জনবল কয়েক গুণ। এ বিভাগে রক্ষকের চেয়ে ভক্ষক বেশি।

আজ জেমস ওয়াটের আত্মা কাঁদছে এই মনে করে যে তাঁর আবিষ্কৃত ইঞ্জিনের গাড়ি বাংলাদেশে প্রায় প্রতিদিন মানুষ হত্যা করছে। উনিশ শতকের শেষ দিকে ভারতবর্ষে রেলগাড়ি চালু হওয়ার পর থেকে দেড় শ বছরে ট্রেনে কাটা পড়েছে যত মানুষ, গত চার-পাঁচ বছরে তার চেয়ে কম মারা যায়নি বাংলাদেশে। জেমস ওয়াটের ইঞ্জিনের গাড়ি চট্টগ্রামে লাইন অতিক্রম করে স্টেশনে ঢুকে যায়, রাজবাড়ী-কালুখালী লাইনে চালক ছাড়া ট্রেন মাইলের পর মাইল ছুটতে থাকে।

বাংলাদেশে আজ দরকার বেশি কাজের লোকের। দেশপ্রেমের প্রকাশ কাজের মাধ্যমে। মুখ ও জিহ্বা দিয়ে যে দেশপ্রেম উদ্‌গীরিত হয়, ট্রেনের ইঞ্জিনের ধোঁয়ার মতো তা ইথারে ভেসে থাকে। মাটির সঙ্গে তার কোনো সম্পর্ক নেই। যে যে অবস্থানে আছে তার দায়িত্ব সে ঠিকমতো পালন করলে রাষ্ট্র ভালো চলে, তখন দুর্বলতা আড়াল করতে নাটকীয়তার প্রয়োজন হয় না। তা করেই জাপান, কোরিয়া, থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম উন্নতি করেছে। তারা আতিশয্য, তামাশা বা নাটকীয়তার মধ্যে নেই। বাংলাদেশকে মর্যাদার জায়গায় প্রতিষ্ঠিত করতে হলে সব রকম নাটকীয়তা, কৃত্রিমতা, লোকদেখানো ভালোত্ব বর্জন করে সরল, সোজা ও সত্যের পথ বেছে নিতে হবে।
সৈয়দ আবুল মকসুদ: লেখক ও গবেষক।