বাজারে তেলের দাম বাড়ল কেন

বাজারে তেলের দাম বেড়েছে। এটা কোনো ইয়ার্কি নয়। সত্যিই ভয়াবহভাবে বেড়েছে। জিনিসপত্রের দাম কেন বাড়ে? অর্থনীতির ক্লাসে প্রথম সপ্তাহে এটা শেখানো হয়। ডিমান্ড সাপ্লাই রেশিও। যদি চাহিদা বাড়ে, সরবরাহ স্থির থাকে—জিনিসের দাম বাড়বে। যদি চাহিদা বাড়ে, সরবরাহও বাড়ে, তাহলে দাম স্থির থাকবে। যদি সরবরাহ বাড়ে, চাহিদা কমে—দাম কমবে। তেলের দাম বেড়েছে, এর পেছনে অবশ্যই কারণ আছে—হয় চাহিদা বৃদ্ধি, নয়তো সরবরাহ হ্রাস। চালের দামও বেশি। বাংলার মানুষ বড় বেশি চাল খায়। পৃথিবীর অন্য দেশে গড়ে খায় ২০০ গ্রাম, বাংলার মানুষ খায় ৪০০ গ্রাম।

বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির পরিচালক ডেভিড বিসলি বলেছেন, বিশ্বে ৪ কোটি ২০ লাখ মানুষ চরম খাদ্যসংকটে ভুগছে। তাদের সাহায্যে ৬০০ কোটি মার্কিন ডলার প্রয়োজন। তাদের সাহায্যে বিশ্বের ধনকুবেরদের এগিয়ে আসতে হবে। প্রথম আলো ২৮ অক্টোবর লিখেছে, টেসলার মালিক ইলন মাস্কের ২৮৯ বিলিয়ন ডলারের সম্পদ আছে। তিনি যদি তাঁর সম্পদের ২ ভাগ দান করে দেন, পৃথিবীর চরম খাদ্যসংকট মিটে যাবে। আরও জানা যাচ্ছে, করোনার সময়ে আমেরিকার শতকোটি ডলারের মালিকদের সম্পদ বেড়ে দ্বিগুণ হয়েছে। আমেরিকানস ফর ট্যাক্স ফেয়ারনেস নামের প্রতিষ্ঠান এ হিসাব জানাচ্ছে। বাংলাদেশে ট্যাক্স ফেয়ারনেস নামে কোনো প্রতিষ্ঠান নেই। থাকার প্রশ্নই আসে না। থাকলে দেখা যেত বাংলাদেশেও করোনাকালে শতকোটিপতি এবং লুটেরা শতকোটিপতিরা আরও বড়লোক হয়েছেন। তাঁরাও যদি দেশের ধনী-গরিব বৈষম্য, আঞ্চলিক বৈষম্য, ক্ষুধা দূর করতে তাঁদের সম্পদের কিছু অংশ ব্যয় করতেন, অনেকটাই উন্নতি হতো পরিস্থিতির। কিন্তু আমরা তো দান চাই না, ব্যাংকের ঋণ ফেরত চাই, অবৈধ আয়ের পথ বন্ধ করতে বলি আর বৈধ আয়ের ওপরে আইনানুগ কর-শুল্ক আদায় করতে বলি। বলতে পারি, বকা মিয়া বলে যাবে, শোনা মিয়া শুনে যাবে। চোরা না শোনে ধর্মের কাহিনি। ঘুষখোরেরা ঘুষ খেয়ে যাবে, মাদক কারবারিরা মাদক বেচে যাবে, ক্যাসিনোওয়ালারা ক্যাসিনো চালিয়ে যাবে, ব্যাংক লুটেরারা ব্যাংক লুটে নেবে, ভূমিদস্যুরা জমি দখল করে যাবে, বনখেকোরা বন–জঙ্গল–নদী খেতেই থাকবে।

আমার মনে আছে, বিচারপতি সাত্তার তখন রাষ্ট্রপতি। ইত্তেফাক–এ সংবাদ শিরোনাম হলো, ‘আমাদের খাদ্য-অভ্যাস পরিবর্তন করিতে হইবে—রাষ্ট্রপতি।’ আর খবর পত্রিকায় শিরোনাম হয়েছিল, ‘ভাতের বদলে আলু খাও—সাত্তার।’ এখনো অবশ্য ভাতের বদলে আলু খাওয়া যেতে পারে। আলুর কেজি টিসিবি বলছে, ২০ থেকে ২৫ টাকা।

যাক, অর্থনীতির প্রাথমিক সূত্রে আসি। আমরা তেল বেশি ব্যবহার করছি, তাই দেশে তেলের দাম বেড়ে গেছে। যাঁরা বেশি ইন্টেলেকচুয়াল, আদার ব্যাপারী নন, জাহাজের খবর ভালোমতো রাখেন, তাঁরা বলবেন, বিশ্বব্যাপী করোনাকালে জাহাজের জট পেকে গেছে, পণ্য ওঠানো–নামানো শ্লথ হয়ে গেছে, এই কারণে বিশ্বব্যাপী পণ্যের সংকট ও মূল্যবৃদ্ধি ঘটেছে। আর বিশ্ববাজারে শুধু যে ভোজ্যতেলের দাম বেড়ে গেছে, তা নয়; জ্বালানি তেলের দামও বেড়ে গেছে।

দেশে তেলের দাম বেড়ে গেছে। এটাই হলো কথা। আরও আরও নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বেড়ে গেছে। মানুষের মাথা গরম। করোনায় বড়লোকদের আয় বেড়েছে, গরিবের আয় কমেছে, মধ্যবিত্ত নিম্নবিত্ত হয়েছে, নিম্নবিত্ত হয়েছে গরিব, গরিব আরও গরিব। জিনিসপাতির দাম নিয়ন্ত্রণ করতে হবে আর গরিবের পাশে এসে দাঁড়াতে হবে সরকারকে। আবারও প্যাকেজ দিতে হবে গরিবকে। সরাসরি গরিবের হাতে। দেশটা কেবল শতকোটিপতির নয়, গরিবেরও। বা গরিবেরই।

এখন প্রশ্ন হলো, বাংলাদেশে কোন ধরনের তেলের দাম বেড়েছে। ভোজ্যতেল, জ্বালানি তেল ছাড়াও আরেক ধরনের তেল আছে। সেটা হলো প্রসাধনীর তেল। সহজ উদাহরণ: মাথায় মাখার নারকেল তেল। কিন্তু এর বাইরেও তেল আছে। যেটা গায়ে মাখতে হয়। মর্দন করতে হয়। ছোটবেলায় আমাদের মায়েরা আমাদের গায়ে শর্ষের তেল মাখিয়ে রোদে শুইয়ে রাখতেন। সেই কারণে আমাদের গায়ের রংটা কারিনা কাপুরের মতো গ্লো করে না, একটু ময়লার দিকেই থাকে। শ্যামলা আরকি!

তেল সম্পর্কে সর্বকালের সেরা রচনাটি লিখে গেছেন হরপ্রসাদ শাস্ত্রী। ‘তৈল’। তাতে তিনি লিখেছেন, ‘বাস্তবিকই তৈল সর্বশক্তিমান; যাহা বলের অসাধ্য, যাহা বিদ্যার অসাধ্য, যাহা ধনের অসাধ্য, যাহা কৌশলের অসাধ্য, তাহা কেবল একমাত্র তৈল দ্বারা সিদ্ধ হইতে পারে।

‘যে সর্বশক্তিময় তৈল ব্যবহার করিতে জানে, সে সর্বশক্তিমান। তাহার কাছে জগতের সকল কাজই সোজা। তাহার চাকরির জন্য ভাবিতে হয় না-উকিলীতে পসার করিবার জন্য সময় নষ্ট করিতে হয় না, বিনা কাজে বসিয়া থাকিতে হয় না, কোন কাজেই শিক্ষানবিশ থাকিতে হয় না। যে তৈল দিতে পারিবে, তাহার বিদ্যা না থাকিলেও সে প্রফেসার হইতে পারে। আহাম্মক হইলেও ম্যাজিস্ট্রেট হইতে পারে, সাহস না থাকিলেও সেনাপতি হইতে পারে এবং দুর্লভরাম হইয়াও উড়িষ্যার গভর্ণর হইতে পারে।’ তিনি আরও লিখেছেন, ‘তৈল সবাই দিয়া থাকেন-কিন্তু কেহই স্বীকার করেন না যে, আমি দেই। সুতরাং এ বিদ্যার অধ্যাপক জোটা ভার। এ বিদ্যা শিখিতে হইলে দেখিয়া শুনিয়া শিখিতে হয়। রীতিমত লেকচার পাওয়া যায় না। যদিও কোন রীতিমত কালেজ নাই, তথাপি যাঁহার নিকট চাকরীর বা প্রমোশনের সুপারিস মিলে, তাদৃশ লোকের বাড়ী সদাসর্বদা গেলে উত্তমরূপ শিক্ষালাভ করা যাইতে পারে। বাঙালীর বল নাই, বিক্রম নাই, বিদ্যাও নাই, বুদ্ধিও নাই। সুতরাং বাঙালীর একমাত্র ভরসা তৈল—বাঙালীর যে কেহ কিছু করিয়াছেন, সকলই তৈলের জোরে, বাঙালীদিগের তৈলের মূল্য অধিক নয়; এবং কি কৌশলে সেই তৈল বিধাতৃপুরুষদিগের সুখসেব্য হয়, তাহাও অতি অল্পলোক জানেন। যাঁহারা জানেন, তাঁহাদিগকে আমরা ধন্যবাদ দিই। তাঁহারাই আমাদের দেশের বড় লোক, তাঁহারাই আমাদের দেশের মুখ উজ্জ্বল করিয়া আছেন।’

দেশে তেলের দাম বেড়ে গেছে। এটাই হলো কথা। আরও আরও নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বেড়ে গেছে। মানুষের মাথা গরম। করোনায় বড়লোকদের আয় বেড়েছে, গরিবের আয় কমেছে, মধ্যবিত্ত নিম্নবিত্ত হয়েছে, নিম্নবিত্ত হয়েছে গরিব, গরিব আরও গরিব। জিনিসপাতির দাম নিয়ন্ত্রণ করতে হবে আর গরিবের পাশে এসে দাঁড়াতে হবে সরকারকে। আবারও প্যাকেজ দিতে হবে গরিবকে। সরাসরি গরিবের হাতে। দেশটা কেবল শতকোটিপতির নয়, গরিবেরও। বা গরিবেরই।

আনিসুল হক প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক ও সাহিত্যিক