বিজয়ের সুবর্ণজয়ন্তী এবং এখনকার ভাবনা

স্বাধীনতা ও বিজয়ের সুবর্ণজয়ন্তী হয়তো স্বাভাবিক সময়ে আরও জাঁকজমকের সঙ্গেই উদ্‌যাপিত হতো। কিন্তু করোনা অতিমারির কারণে এ দুই উপলক্ষ এবং বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষও পরিকল্পনা অনুযায়ী উদ্‌যাপন করা সম্ভব হয়নি। তবে সীমাবদ্ধতার মধ্যেও রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে, বিভিন্ন সংস্থার পক্ষ থেকে এবং বেসরকারি নানা আয়োজনে উদ্‌যাপন কম হয়নি। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ছাড়াও এসব উপলক্ষে প্রচুর বই প্রকাশিত হয়েছে, হচ্ছে এবং পত্রপত্রিকায় বিস্তর লেখা ছাপা হয়েছে বা হয়ে চলেছে।

টেলিভিশনেও অনেক কথা বলা হয়েছে এবং স্বভাবতই তা চলমান। হয়তো কেউ জিজ্ঞাসা করতে পারেন, এসব প্রকাশনা ও অনুষ্ঠানে কি আশানুরূপ মানের লেখা প্রকাশিত হয়েছে, চিন্তা জাগানোর মতো কথা শোনা গেছে? নাকি অভ্যস্ত ধারায় গতানুগতিক পথেই আবদ্ধ ছিল আমাদের চিন্তা।

৫০ বছর হয়তো একটি দেশের ইতিহাসে দীর্ঘ সময় নয়, আবার ইতিহাসে কোনো কোনো কাল নানা কারণে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে ওঠে। গত ৫০ বছরে পৃথিবীর ইতিহাসে যুগান্তকারী ঘটনা হলো তথ্যপ্রযুক্তির বিস্ময়কর বিকাশ, যার সূত্র ধরে চতুর্থ শিল্পবিপ্লব ঘটে চলেছে। যে বিজ্ঞান বিংশ শতাব্দীতে মানুষের জীবনে ও মানসে ক্রমেই তার ভূমিকা বাড়িয়ে চলেছিল, সে ভূমিকা আরও স্পষ্ট ও ব্যাপক হয়েছে এ সময়ে, বিশেষ করে একবিংশ শতাব্দীতে। পুঁজিবাদী বিশ্ব নিজেদের স্বার্থেই বিশ্বায়নের এবং মুক্তবাজার অর্থনীতির পথ খুলে দিলেও রাজনীতিতে একই সঙ্গে জাতীয়তাবাদী সংকীর্ণতার পথে হাঁটছে। উভয় দিক থেকেই তারা চলমান ঘটনাবলির ওপর নিজেদের নিয়ন্ত্রণ রাখতে চাইছে। এর ফলে বাংলাদেশের মতো উদীয়মান অর্থনীতির দেশগুলোর সামনে চ্যালেঞ্জ বাড়ছে।

স্বাধীনতার পর থেকেই বাংলাদেশ আদতে কঠিন সময়ই পার করেছে। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বের পরিপূর্ণ বিকাশ ঘটেছিল ছয় দফা আন্দোলনের সূত্রে ১৯৬৬ সাল থেকে। এ দেশের মানুষ তাঁর মধ্যেই প্রথম এমন এক নেতার সাক্ষাৎ পেল, যাঁর ওপর সম্পূর্ণ আস্থা রাখা যায়। বঙ্গবন্ধু মানুষের আস্থার প্রতিদান দিয়েছেন নিজের জীবনকে সর্বোচ্চ ঝুঁকিতে নিয়ে—একবার আগরতলা মামলার সময়, আরেকবার একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের সময়। এ সময় তাঁর জাদুকরি নেতৃত্বের গুণে বাঙালি তার স্বভাবের বাইরে গিয়ে অভূতপূর্ব ঐক্য গড়ে তুলেছিল এবং সর্বোচ্চ ত্যাগের ঝুঁকি নিয়ে বীরের ভূমিকা পালনে অগ্রসর হয়েছিল। কিন্তু স্বাধীনতার পরপর যেন অধিকাংশ মানুষ পূর্বাবস্থায় ফিরে গেল—একদল ব্যক্তিগত স্বার্থের চিন্তায় তৎপর হলো, অন্য দল বাস্তবতাকে ঝুঁকিতে ফেলে একদেশদর্শী বিপ্লবের স্বপ্নে তৎপরতা চালাতে শুরু করে। বঙ্গবন্ধুর সামনে তখন পাহাড়সমান কাজ—শরণার্থী পুনর্বাসন, খাদ্যঘাটতি মোকাবিলা, ধ্বংসপ্রাপ্ত যোগাযোগব্যবস্থা পুনর্নির্মাণ, আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি আদায়, প্রশাসনে শৃঙ্খলা এনে সরকারের কাজ এগিয়ে নেওয়া, তাঁর নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি পূরণে সংবিধান রচনা ও নির্বাচিত সরকার গঠন, শিক্ষাব্যবস্থা যুগোপযোগী করে আবার চালু করা ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা, পাকিস্তানে আটক সব বাঙালির প্রত্যাবর্তনের ব্যবস্থা ইত্যাদি বহুমুখী কাজের চাপ তখন তাঁর সরকারকে সামলাতে হচ্ছে।

এর মধ্যে দুর্ভাগ্য হলো মুক্তিযুদ্ধকালে ঐক্য ও চেতনার দৃঢ়তা ধরে রাখা গেল না, খোদ আওয়ামী লীগেও ভাঙন দেখা দিল, এমনকি শীর্ষ দুই নেতা বঙ্গবন্ধু ও তাজউদ্দীনের মধ্যে মতভেদের মতো ঘটনা ঘটল, লুটপাট ও ক্ষমতার অপব্যবহার বন্ধ করা যায়নি। আমরা স্বাধীনতা-পরবর্তীকালে বঙ্গবন্ধুর বিভিন্ন ভাষণ পর্যালোচনা করলেই দেখব, বাস্তবতা তাঁকে কতভাবে ভোগাচ্ছিল। অধিকাংশ ভাষণে তাঁর বক্তব্যে ক্ষোভ, আক্ষেপ, ধমক, সমালোচনা, এমনকি কখনো কখনো হুমকিরও প্রকাশ ঘটেছে। এসব বক্তব্যের লক্ষ্য দলের নেতা-কর্মী, সরকারি কর্মী এবং শিক্ষিত মানুষ। এর মধ্যে আরও দুর্ভাগ্য হয়ে এল তাঁর নির্মম হত্যাকাণ্ড। বাংলাদেশ যেন প্রায় শুরুতেই হোঁচট খেল। জিয়া অনুসরণ করেছেন আইয়ুব খানকে। আওয়ামী লীগের প্রতিপক্ষ হিসেবে রাজনৈতিক অবস্থান দাঁড় করাতে তিনি ফিরিয়ে আনলেন পাকিস্তানপন্থী রাজনীতি। সেভাবে পরিবর্তন ঘটালেন সংবিধানে এবং সরকারি নীতি ও কাজে। গণমাধ্যম ও জনজীবনে এর প্রভাব পড়েছে স্বাভাবিকভাবেই। প্রতিবাদ-প্রতিরোধ যতটা হয়েছে, তা মূলত সাংস্কৃতিক-সামাজিক অঙ্গন থেকেই।

জিয়ার ধারাবাহিকতাই চালিয়ে গেছেন এরশাদ। তাঁর সময়ে আবার রাজপথে রাজনৈতিক শক্তির সঙ্গে সামাজিক-সাংস্কৃতিক শক্তির ঐক্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। এর মধ্যে আন্দোলনের ভেতর দিয়ে শেখ হাসিনাও রাজনীতিতে পোক্ত হয়ে উঠেছেন। শেষ পর্যন্ত রাজনৈতিক-সামাজিক-সাংস্কৃতিক শক্তির মিলিত প্রতিরোধে এরশাদকে ক্ষমতা ছাড়তে হয়েছে। কিন্তু দুই সামরিক শাসকের অগণতান্ত্রিক ব্যবস্থার প্রতিরোধে যেসব কার্যক্রম চলেছে, তা কেন্দ্রীভূত হয়ে পড়েছিল রাজধানী ও অন্য কয়েকটি নগরের সংকীর্ণ পরিসরে। বৃহত্তর নাগরিক সমাজ, যা মফস্বলে ও গ্রামেগঞ্জে ছড়িয়ে আছে, তা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিল নাগরিক-সমাজের তৎপরতা। কিন্তু বিপরীতে এ সময়ে সমাজে কার্যকর ছিল ধর্মীয় গোঁড়া রাজনৈতিক ও সামাজিক শক্তিগুলো। তারা সমাজকে প্রভাবিত করেছে ব্যাপকভাবে। এর পাশাপাশি এ সময়েই সমাজের নিম্নবর্গের মানুষ ব্যাপক হারে সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যে গেছে অধিকতর উপার্জনের আশায়। তারা সেখান থেকে অর্থও পাঠিয়েছে, সেই সঙ্গে আরবি-ইসলামি সংস্কৃতিও নিয়ে এসেছে। বাঙালি মুসলিম-সমাজে ব্যাপক রূপান্তরের প্রক্রিয়া চলেছে সেই থেকে। যে বাংলাভূমিকে রবীন্দ্রনাথ শাস্ত্রপন্থার বিপরীতে মানবপন্থী বলে আখ্যায়িত করেছিলেন, বাস্তবে তার বিপরীত প্রক্রিয়া ঘটতে দেখা গেল।

একাত্তরে, চিন্তাবিদ বদরুদ্দীন উমরের ভাষায়, বাঙালি মুসলমানের স্বদেশ প্রত্যাবর্তন ঘটেছিল; এখন বলতে হবে আশির দশক থেকে তার আরবীকরণ-ইসলামীকরণ ঘটেছে। আর যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে আফগানিস্তান, ইরাক, লিবিয়ায় পুঁজিবাদী বিশ্বের আগ্রাসনের ফলে ইসলামি রাজনীতির কঠোর প্রতিক্রিয়ার অবকাশ ঘটেছে ভালোভাবে। তার ফলে বাঙালি জাতীয়তাবাদের চিরায়ত অসাম্প্রদায়িক সাংস্কৃতিক চেতনার ভিত যেন প্রবলভাবে নাড়া খেল। এতে দিন দিন বাঙালির যেন আরেক রূপান্তর দৃশ্যমান হয়ে উঠছে।

বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, ধর্মীয় জাতীয়তার কট্টর রূপ, বিশ্বায়ন, মুক্তবাজার, ভোগ্যপণ্যের ব্যাপক সরবরাহ, আর্থিক সংগতি—সব মিলে এ এক জগাখিচুড়ি বাস্তবতা। কে কোন পথে চলছে, তা বলা মুশকিল। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বা ইসলামের দর্শন ও মুসলিম পণ্ডিতদের জ্ঞানবিজ্ঞানের চর্চা, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির বিস্ময়কর অগ্রগতি এবং অর্থনৈতিক বিকাশে সৃষ্ট সম্ভাবনা নিয়ে তাত্ত্বিক আলোচনা কিংবা এর দার্শনিক ভিত অন্বেষণের কোনো উদ্যোগ তেমন দেখা যায় না। কিন্তু এসবই তো বাস্তবতা এবং এ থেকেই ইতিবাচক পথও খুঁজে নেওয়ার দায় রয়েছে। কারণ, ইতিবাচক সম্ভাবনাকে যথাযথভাবে কাজে লাগিয়েই জাতীয় অগ্রগতির জন্য মোটামুটি ঐকমত্য প্রতিষ্ঠা সম্ভব এবং তার ভিত্তিতে শিক্ষা, রাজনীতি ও অন্যান্য কর্ম পরিচালনার জন্য প্রয়োজন ছিল বিভিন্ন পর্যায়ে মুক্ত আলোচনা।

বাংলাদেশে, দুর্ভাগ্যের বিষয়, মুক্ত আলোচনার পরিসর ছোট হয়ে আসছে। এ কারণে জাতীয় ইতিহাসের তাৎপর্যপূর্ণ উপলক্ষগুলো ক্রমেই বাগাড়ম্বরপূর্ণ কথাবার্তা এবং নিছক আনুষ্ঠানিকতায় পর্যবসিত হচ্ছে। সেটা একুশে ফেব্রুয়ারি থেকে বিজয় দিবস—সব ক্ষেত্রেই সত্য। ধর্মীয় চেতনার যেমন যুগোপযোগী ব্যাখ্যা প্রয়োজন, তেমনি একুশের তাৎপর্য বা মুক্তিযুদ্ধের চেতনারও নবব্যাখ্যা জরুরি। সে কাজ বাকি থেকে গেলে জাতীয় ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ দিনগুলো মানুষ যার যার অবস্থানে থেকে কেবল অনুষ্ঠান ও অন্তঃসারশূন্য কথাবার্তাতেই উদ্‌যাপন শেষ করবে। এভাবে চলতে থাকলে হয়তো রাষ্ট্রীয় বা সরকারি জবরদস্তির কারণে বাধ্য হয়ে এসব আনুষ্ঠানিকতায় যুক্ত হবে—এমন মানুষের সংখ্যাও বাড়তে থাকবে। আর বিপরীতে অন্তর থেকে যোগ দেওয়া মানুষের সংখ্যা কমবে। কিংবা জৌলুশপূর্ণ অনুষ্ঠান, অনেক মানুষের সমাবেশ যে ধরনের উত্তেজনা তৈরি করে, তাতেই গা ভাসাবে বেশির ভাগ মানুষ। এর ফল হবে দেশ অর্থনৈতিকভাবে এগিয়ে চললেও জাতি তার দিকনির্দেশনা হারিয়ে ফেলবে। বলা জরুরি, মুক্ত আলোচনার পরিসর বাড়ানো দরকার, প্রয়োজন চিন্তার সাহস, জটিল চিন্তনের দক্ষতা এবং সাহসী উত্তরণের মতো চারিত্রিক বলিষ্ঠতা।

  • আবুল মোমেন কবি, প্রাবন্ধিক ও সাংবাদিক