বিধবার কান্না, বিচারহীনতার লজ্জা এবং অধরা হেলমেট বাহিনী  

দোকানি-কর্মচারীদের বিপক্ষে লড়ছিল ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থীরা, তাদের সঙ্গেই অজস্র হেলমেটধারী দেখা যায়
ছবি: প্রথম আলো

এ না হলে অদ্ভুত বাঙালি জাতি! দুই পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ লাগল, টিভি-অনলাইন চ্যানেল লাইভ সম্প্রচার করতে লাগল, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ভেঙে পড়ল, সরকার-প্রশাসন-মেয়র-পুলিশও দীর্ঘক্ষণ দূরে দাঁড়িয়ে তামাশা দেখল—একটি ‘উপভোগ্য’ রণক্ষেত্রই বটে। দিন শেষে একজনের মৃত্যুর খবর এল, অমনি সবাই তখন ‘ইমোশনের ডিব্বা’ হয়ে গেল। নিহত কুরিয়ার সার্ভিসের ডেলিভারিম্যান নাহিদ হোসেনের নাম ও ছবি নিশ্চয়ই এখনই কারও ভোলার কথা নয়। কয়েকটি দিন বা আরেকটা ইস্যু আসার আগপর্যন্ত তো নয়ই। বাঙালির মাথাকে তো অতটা গোল্ড ফিশ মেমোরি বলা যায় না!  গত মঙ্গলবার নিউমার্কেট এলাকার ব্যবসায়ী ও ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থীদের মধ্যে ভয়াবহ সংঘর্ষে নিষ্ঠুরভাবে বলি হয়েছেন নাহিদ। তাঁর পরিবার ও বিধবা স্ত্রী ডালিয়ার কান্না দেখে অনেকে তাঁর বাসাতে ছুটে গেল সমবেদনা জানাতে। অনেকে দুঃখ প্রকাশ করল। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের চিত্রও পাল্টে গেল। দিনে ‘বীরত্বের সঙ্গে লড়ে যাওয়া’ পক্ষের আর তামাশা দেখে যাওয়া অনেক মানুষও রাতে হয়ে গেল ‘মানবতার ফেরিওয়ালা’!

কামরাঙ্গীরচরের বিধবার কান্না

কবি শহীদ কাদরীর ‘সংগতি’ কবিতাই যেন নাহিদ ও ডালিয়ার গল্প হয়ে গেল। তাঁদের প্রেমের সম্পর্ক মধুর পরিণতি বিয়েতে গড়াল। কয়েক মাস যেতে না যেতেই নেমে এল করুণ পরিণতি। এ জন্যই কি কবি লিখেছিলেন, ‘প্রেমিক মিলবে প্রেমিকার সাথে ঠিক-ই/ কিন্তু শান্তি পাবে না, পাবে না, পাবে না...।’ নাহিদ চলে গেছেন শান্তি-অশান্তির ঊর্ধ্বে। আর ডালিয়ার জীবনে অশান্তির মহাকাব্যই রচিত হলো। ডালিয়া প্রথম আলোকে বলছেন, ‘যেদিন আমাদের বিয়ে হয়। সেদিন ছিল মঙ্গলবার। আর সে (নাহিদ) মারাও গেল মঙ্গলবারে। সাহ্‌রিতে মাংস রান্না হয়েছিল। নাহিদ মাংস দিয়ে ভাত খেয়েছিল। রোজামুখেই নাহিদ মারা গেল।’ আহা, ‘শাদা ভাত ঠিক উঠবেই ফুটে তারাপুঞ্জের মতো’, কিন্তু সারা দিন মানুষের জিনিস ডেলিভারি দিয়ে ক্লান্ত-পরিশ্রান্ত হয়ে সেই ভাত আর কখনো খাওয়া হবে না নাহিদের। ডালিয়ার সামনে এখন ঘোর অন্ধকার। প্রতি মুহূর্ত ‘পুরোনো গানের বিস্মৃত-কথা ফিরবে’ প্রিয়তমর স্বরে।

এ গল্পে শুধু নাহিদই ‘নীলগাই’ নয়, মুরসালিন নামে আরেকজনকেও খেয়েছিল ‘ক্ষুধার্ত বাঘ’। সেদিনের ঘটনায় আহত হয়ে চিকিৎসাধীন দোকানের কর্মচারী মুরসালিন মারা গেছেন গতকাল। ডালিয়ার মতো বিধবা হলেন আরেকজন, মিতু আক্তার। শুধু তা–ই নয়, এতিম হয়ে গেছে তাঁদের দুই শিশুও। মুরসালিনও কামরাঙ্গীরচরের বাসিন্দা। সেদিন রাতে গোটা দেশে বয়ে যাওয়া কালবৈশাখী যেন কামরাঙ্গীরচরের ওপরেই সবচেয়ে বেশি আছড়ে পড়ল।

অপ্রতিরোধ্য হেলমেট বাহিনী

একটা সংঘর্ষ বাধাহীনভাবে ঘণ্টার পর ঘণ্টা চলতে দেওয়া হলো। যত সময় গড়াল, তত মানুষ যুক্ত হয়ে পড়ল। যার পরিপ্রেক্ষিতে সেই এলাকা রণক্ষেত্রই হয়ে উঠল। ধরে নিই, নাহিদ ও মুরসালিন দুজনই সংঘর্ষের মধ্যে জড়িয়ে পড়েছিলেন। যেহেতু সেই এলাকাতেই তাঁদের কাজকারবার। সেদিনের ঘটনার সিসিটিভি ও টিভি ক্যামেরার অজস্র ফুটেজ এখন ভাইরাল। যার একটির মধ্যে আমরা দেখতে পাচ্ছি, সংঘর্ষের একপর্যায়ে রাস্তায় আহত অবস্থায় পড়ে থাকা নাহিদকে লম্বা ছুরি দিয়ে নির্মমভাবে কোপানো হচ্ছে। আজকে ডেইলি স্টারের প্রথম পাতায় সেই ছবি ছাপানো হয়েছে। ভিডিওতে লম্বা কিরিচ হাতেও একজনকে সরে যেতে দেখা গেল, কিরিচটাতে রক্ত লেগে আছে মনে হলো।

নাহিদকে কুপিয়ে হত্যাকারীরা সবাই হেলমেটধারী। দোকানি-কর্মচারীদের বিপক্ষে লড়ছিল ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থীরা, তাদের সঙ্গেই অজস্র হেলমেটধারী দেখা যায়। দোকানিদের দিকে কেউ কেউ হাতে বানানো ককটেলও ছুড়ে দিচ্ছিল। সেদিন সংঘর্ষ চলাকালীন এক লেখায় লিখেছিলাম, ‘ওই এলাকায় যেকোনো সংঘর্ষে ঢাকা কলেজ থেকে হেলমেট পরা কারা বের হয়? আজকের সংঘর্ষেও ব্যবসায়ীদের বিপক্ষে হেলমেট পরা দেখা গেছে অনেককে। বিষয়টা এভাবে বললে অমূলক হবে না যে এ সংঘর্ষ মূলত ব্যবসায়ী বনাম ছাত্রলীগের। সেখানে কলেজের “বড় ভাইদের” চাপে পড়ে মাঠে নামতে বাধ্য হয়েছে সাধারণ শিক্ষার্থীরাও।’ ডেইলি স্টারের প্রত্যক্ষদর্শী প্রতিবেদক ও ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থীরাও হেলমেটওয়ালাদের কলেজের শিক্ষার্থী বলেই শনাক্ত করেছেন।

আরও পড়ুন
এ রাষ্ট্রের প্রতি ভরসা হারিয়ে ফেলছে মানুষ। আমাদের প্রতিষ্ঠানগুলো দিন দিন এতটাই অকার্যকর হয়ে পড়ছে, সেগুলোর ওপর মানুষ আস্থা রাখতে পারছে না। বিচারহীনতার সংস্কৃতি তাকে আরও বেশি নিরাপত্তাহীন করে তুলছে নিঃসন্দেহে। নাগরিকের অধিকার রক্ষা ও নিরাপত্তায় এ রাষ্ট্র যে সাংবিধানিক প্রতিজ্ঞা করেছিল, সেটি বরখেলাপ করে জনগণের সঙ্গে কি প্রতারণাপূর্ণ আচরণ করা হচ্ছে না?

গত বুধবারের প্রথম আলোর প্রতিবেদনও তেমনটা ইঙ্গিত দেয়। নিউমার্কেটকেন্দ্রিক ‘লেনদেনের’ সম্পর্ক থাকায় সেখানকার যেকোনো ঝামেলায় জড়িয়ে পড়তে দেরি করে না কলেজের ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা। আগের রাতে দুই দোকানের কর্মচারীর মধ্যে বিতণ্ডায় এক পক্ষের আহ্বানে নিউমার্কেটে হামলা করতে ছাত্রদের হল থেকে বের করেছিলেন ছাত্রলীগের বিলুপ্ত কমিটিরই কয়েকজন নেতা, যাঁদের নামও প্রতিবেদনে উঠে এসেছে। রাতের পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে যাওয়ার পর পরদিন আবার কেন সংঘর্ষের ঘটনা ঘটল, এমন প্রশ্নের জবাবে বেরিয়ে আসছে সেই এলাকার আধিপত্য, রাজনৈতিক প্রভাব ও কোটি কোটি টাকার চাঁদাবাজির কাহিনি। ‘সোনার ডিম পাড়া হাঁসের’ মতো মূল্যবান সেই এলাকা নিয়ন্ত্রণ নিয়ে ক্ষমতাসীন দলের দুই পক্ষের মধ্যে অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বও।

আগুন দিয়ে অনেক দোকান পুড়িয়ে দেওয়া হয়। অনেক দোকানের ক্যাশবাক্স লুটপাট করা হয়। ভিডিও ফুটেজেই সেসব প্রকাশ পেয়েছে। ধারালো অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে হেলমেট বাহিনী এতটা অপ্রতিরোধ্য হয়ে ওঠে যে তাদের থামাতে পুলিশ অনেক দেরি করে ফেলে। শুরুর কয়েক ঘণ্টা সংঘর্ষ থামাতে কারও কোনো প্রচেষ্টা দেখা যায়নি। এলাকার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে পর্দার আড়ালে সমঝোতা বা দর-কষাকষি চলছিল কি তাহলে? সেটির জন্য কি অপেক্ষা করছিল পুলিশ বা প্রশাসন? নাকি ক্ষমতাসীন দলের কোন পক্ষ নেবে বা এর আগে কয়েকটি ঘটনায় সঙ্গে থাকা হেলমেট বাহিনীর বিরুদ্ধে কীভাবে অ্যাকশন নেবে, সেই চিন্তায় পড়ে গিয়েছিল তারা? পুলিশের চরম ব্যর্থতা নিয়ে এমন অনেক প্রশ্নই এখন ঘুরপাক খাচ্ছে। ফলে নাহিদ-মুরসালিনের খুনের দায় পুলিশ ও প্রশাসনকেও কি নিতে হবে না?

এর আগে কোটা সংস্কার আন্দোলন, নিরাপদ সড়ক আন্দোলন, এমনকি হাফ পাস ভাড়ার আন্দোলনেও শিক্ষার্থীদের ওপর ছাত্রলীগের হামলার সময় আমরা হেলমেট বাহিনীকে দেখতে পাই। এমনকি পুলিশের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়েও তাদের দেখা যায় নানা ভিডিও ফুটেজে। এরপরেও হেলমেট বাহিনীর কেউ গ্রেপ্তার হয় না, তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয় না। নিউমার্কেট এলাকার ঘটনার দুই দিন পার হয়ে গেলেও সেটিই আমরা দেখছি। এবারও কি তাহলে তারা পার পেয়ে পরবর্তী কোনো ঘটনায় মাঠে নামার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে?

বিচারহীনতার লজ্জা

দেশে একের পর এক ঘটনা ঘটছে আর বাড়ছে বিচার না চাওয়া মানুষের সংখ্যাও। একটা রাষ্ট্রের বিচারব্যবস্থা ও সরকারের ওপর কতটা আস্থাহীন হলে নাগরিকেরা বিচারের আশা ছেড়ে দিতে পারেন, সেইটি কী জোরালোভাবে প্রতীয়মান হয় না? নাহিদকে হারিয়ে শোকাহত মা নার্গিস বলছেন, ‘আমরা বিচার চাই না। বিচার চেয়ে কী হবে। মামলা লড়তে গেলে তো অনেক টাকা লাগে। বিচার চাইলেই তো আর বিচার পাব না।’ মুরসালিনের মা–ও একই বললেন, ‘আমি কার কাছে বিচার দিমু, কে করবে বিচার, আমি আল্লাহর কাছে বিচার দিলাম।’ মর্গের বাইরে দাঁড়িয়ে মুরসালিনের কান্নারত ভাই বললেন, ‘এই দেশে কোনো বিচার নেই। কে করবে বিচার?’ দুই ভাইকে ‘জোড়া কই কইতর’ বলে ডাকতেন তাঁদের মা।

এর আগে রাজধানীতে ক্ষমতাসীন দলের বিরোধে এক নেতাকে হত্যার ঘটনায় রিকশায় গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান সামিয়া আফরান প্রীতি নামের এক কলেজছাত্রী। তাঁর বাবাও বলেছিলেন, ‘বিচার চাইতে গেলে নানা ধরনের হয়রানি শিকার হতে হয়। বিপুল অর্থ খরচ করতে হয়। আমাদের সেই সামর্থ্য নেই। আমরা নিরীহ মানুষ। আল্লাহর কাছে বিচার চাই।’ ‘বিচার চাই না’ লিখে গুগলে সার্চ দিলে আরও অনেক ঘটনা হাজির হবে। যেমন ধর্ষণ ও হত্যার শিকার তনুর মা বলেছিলেন, ‘এই দুনিয়ায় বিচার আশা করি না।’ একইভাবে সাগর-রুনি হত্যার বেলায়ও।

এ রাষ্ট্রের প্রতি ভরসা হারিয়ে ফেলছে মানুষ। আমাদের প্রতিষ্ঠানগুলো দিন দিন এতটাই অকার্যকর হয়ে পড়ছে, সেগুলোর ওপর মানুষ আস্থা রাখতে পারছে না। মানুষ কতটা নিরাপত্তাহীন হয়ে পড়েছে, সেটি নিশ্চয়ই উদাহরণ দিয়ে প্রমাণ করার কিছু নেই।বিচারহীনতার সংস্কৃতি তাকে আরও বেশি নিরাপত্তাহীন করে তুলছে নিঃসন্দেহে। নাগরিকের অধিকার রক্ষা ও নিরাপত্তায় এ রাষ্ট্র যে সাংবিধানিক প্রতিজ্ঞা করেছিল, সেটি বরখেলাপ করে জনগণের সঙ্গে কি প্রতারণাপূর্ণ আচরণ করা হচ্ছে না? এতে বিচার না চাওয়ার মানুষের সংখ্যা আরও বাড়বে, মানুষ নিজের বিচার নিজেই করার জন্য আরও বেশি উৎসাহী হবে, সমাজে সহিংসতা ও বিভাজন বাড়তে থাকবে। আরও নাহিদ, আরও মুরসালিনকে আমরা হারাব। আরও ডালিয়া বা মিতু বিধবা হবে, আরও মা–বাবা সন্তানহারা হবে, মুরসালিনের দুই শিশুর মতো এতিম হবে আরও শিশু। এ দেশের সরকার, প্রশাসন, বিচারব্যবস্থা কিছুই করবে না, করতে পারবে না। স্বাধীনতার ৫০ বছর পর এসে বাংলাদেশের জন্য এর চেয়ে বড় অশনিসংকেত আর কী হতে পারে।

  • রাফসান গালিব প্রথম আলোর সহসম্পাদক

আরও পড়ুন