বিমানবন্দর, সমুদ্রবন্দর ও রেলপথকে যে কারণে বেসরকারি খাতে দেওয়া যাবে না

চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দর
ফাইল ছবি: প্রথম আলো

প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় ও বিল্ডের যৌথ উদ্যোগে আয়োজিত ‘লজিস্টিকস ইনফ্রাস্ট্রাকচার ডেভেলপমেন্ট ওয়ার্কিং কমিটি’র দ্বিতীয় সভায় ব্যবসায়ীরা দেশের বিমানবন্দর, সমুদ্রবন্দর ও রেলপথ ব্যবস্থাপনা বেসরকারি খাতে ছেড়ে দেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন। লজিস্টিকস বা ব্যবসার আনুষঙ্গিক সুবিধা বাড়ানোর উদ্দেশ্যে গত বছর কমিটিটি গঠন করা হয়। এমন পরিস্থিতিতে টিআইবি প্রতিবেদনটি স্মরণ করা যেতে পারে যেখানে আমরা দেখতে পাই, একাদশ জাতীয় সংসদের সদস্যদের মধ্যে ৬১ শতাংশই ব্যবসায়ী, ১৩ শতাংশ আইনজীবী, রাজনীতিক ৫ শতাংশ এবং অন্যান্য পেশার ২১ শতাংশ, যাঁদের অনেকেই পরোক্ষভাবে ব্যবসায় যুক্ত। দশম সংসদেও প্রায় ৮৪ শতাংশ সদস্য প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে ব্যবসায়ী ছিলেন।

ব্যবসার আনুষঙ্গিক লজিস্টিকস সুবিধা বাড়ানোর অর্থটা খাত ভিত্তিতে নিখুঁতভাবে ব্যাখ্যা করা যায়। সাধারণভাবে ঘনবসতিপূর্ণ দেশে অত্যাধুনিক দক্ষ ভূমি ব্যবস্থাপনা, নিরবচ্ছিন্ন সাশ্রয়ী জ্বালানির নিশ্চয়তা, পরিবেশ শোধনাগার, দ্রুততম কন্টেইনার হ্যান্ডেলিংয়ে সক্ষম উচ্চক্ষমতার বন্দর, যানজটমুক্ত সড়ক-রেল-নৌ কার্গো পরিবহন সেবা ইত্যাদির বাইরে বাংলাদেশের ব্যবসা সহজীকরণ পথে বাধা দক্ষ মানবসম্পদপ্রাপ্তি, চাঁদাবাজি, বিদ্যুৎ ও গ্যাস সংযোগ, উচ্চ জ্বালানি শুল্ক, নানাবিধ প্রশাসনিক হয়রানি ইত্যাদি। বাংলাদেশের ব্যবসা ও বিনিয়োগ বন্ধ্যার টেকনিক্যাল কিছু কারণ বিশ্বব্যাংকের ডুয়িং বিজনেস কান্ট্রি রিপোর্টে (২০২০) ব্যাখ্যা করা ছিল। ‘গেটিং ইলেকট্রিসিটি’ সূচকে বাংলাদেশের স্কোর ১০০-তে মাত্র ৩৫ ছিল, সহজ শর্তের ঋণপ্রাপ্তিতে ৪৫, প্রোপার্টি রেজিস্ট্রেশনে ২৯, ব্যবসায়িক অঙ্গীকার বাস্তবায়নে ২২, অর্থ ও ব্যবসায়িক মামলা নিষ্পত্তিতে স্কোর মাত্র ২৮। এসব সমাধান চেষ্টাকে ছাপিয়ে আমাদের বড় ব্যবসায়ীদের মনোযোগ পড়ল বিমানবন্দর, সমুদ্রবন্দর ও রেলপথ বেসরকারীকরণে। সরকারের কাছে যথাযথ জ্বালানি ও অবকাঠামোগত সুবিধা, বিচারকি, রেগুলেটরি এবং লজিস্টিকস সাপোর্ট না চেয়ে বিমানবন্দর, সমুদ্রবন্দর ও রেলপথ বেসরকারীকরণ করে ফেললে দেশের ব্যবসা ও বিনিয়োগের পরিবেশ ঠিক হয়ে যাবে?

পশ্চিম ইউরোপীয় উদার গণতান্ত্রিক ও সাম্যবাদী পুঁজিবাদী দেশগুলোর অবকাঠামো দর্শন যদি আমরা বিশ্লেষণ করি, তাহলে দেখি—কৌশলগত পরিকল্পনা, রেগুলেশন এবং স্ট্র্যাটেজিক অবকাঠামো সরকারি খাতে থাকে, তবে ব্যবসা বেসরকারি খাতে থাকে। উন্মুক্ত প্রতিযোগিতার জন্য ন্যায্য রেগুলেশন, বেসরকারি ব্যবসা বিকাশের উপযোগী মৌলিক অবকাঠামো, লজিস্টিকস সাপোর্ট অবকাঠামো তৈরি রক্ষণাবেক্ষণ ও বিকাশের দায়িত্ব সরকারের। কৌশলগত খাত বেসরকারি খাতে ঢালাওভাবে ছাড়া হয় না। কারণ, তাতে ব্যবসায়ীদের মধ্যে স্বার্থের দ্বন্দ্ব তৈরি হয়, একে অপরের ব্যবসা বিকাশে সচেতন কিংবা অসচেতন প্রতিবন্ধকতা তৈরি করে। যাবতীয় ব্যবসা যথাসম্ভব বেসরকারি খাতে যাবে। সরকার ব্যবসা করবে না, দরকার হলে মৌলিক পণ্যমূল্য, ভাড়া, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের স্বার্থে অলাভজনক সমাজসেবা করবে। কিন্তু সমাজসেবার নামে সরকার কোনো ধরনের ক্রয়-বিক্রয়ের একচেটিয়া ব্যবসা করবে না। দুর্নীতির মাধ্যমে ব্যবসা করে পাবলিক মানি ভর্তুকির নামে ঢালবে না, অর্থাৎ অন্যায্য বেইল আউট করবে না।

তাই দেশের বিমানবন্দরগুলো নয়, বরং বিমান পরিবহন কোম্পানি বেসরকারি খাতে থাকবে। বাংলাদেশ বিমানকেও বেসরকারি খাতে দেওয়ার সময় হয়েছে। বাংলাদেশ বিমান সীমাহীন দুর্নীতি এবং চোরাচালানের বড় কেন্দ্র। প্রতিবছর বিমান লোকসানে থাকে, কালেভদ্রে ঋণ পরিশোধ না করে কিছু লাভ দেখায়। করোনাকালে উড়োজাহাজ ভাড়া, কর্মীদের বেতন, পর্যটন রক্ষার বিভিন্ন কৌশলে বিমানকে কয়েক হাজার কোটি টাকা বেইল আউট বা ভর্তুকি দেওয়া হয়েছে। ন্যাশনাল ফ্লাগ ক্যারিয়ারের নামে মানুষের করের টাকা বিমানের লোকসানের পেছনে ঢোকানো অন্যায্য। সরকারপ্রধান থেকে শুরু করে প্রশাসনের সব আমলা-কর্মকর্তা চাইলে বেসরকারি বিমানে চড়তে পারেন। বিমানবন্দর জাতীয় নিরাপত্তার কৌশলগত বিষয়, এটা সরকারের কারিগরি এবং স্ট্র্যাটেজিক পরিকল্পনার অংশ বলে পাবলিক ডোমেইনে থাকবে।

বেসরকারি কোম্পানিগুলো ব্যবসা সহজের জন্য আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের সেবামান, ফ্লাইট সক্ষমতা, এয়ার-কার্গো হ্যান্ডেলিং সক্ষমতা বাড়াতে, গ্রাউন্ড সার্ভিস সময়োপযোগী ও শুল্ক সাশ্রয়ী করতে যৌক্তিক চাপ দেবে সরকারকে। বিমানবন্দরের অবকাঠামো ব্যবহার করে ব্যবসায়ীরা প্রতিযোগিতামূলক আইনে, সহনীয় শুল্ক সুবিধায়, উচ্চমান সেবায় অতি সহজে ব্যবসা করার কিংবা ফ্লাইট চালানোর অধিকার জানাবেন, কিন্তু বিমানবন্দরই বেসরকারিতে ছাড়ার চাপ দেবেন না।

বাংলাদেশ বর্তমানে একটি অর্থনৈতিক অবকাঠামো উত্তরণের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। তবে বন্দর, সড়ক, রেল, নৌপথের সামঞ্জস্যপূর্ণ মহাপরিকল্পনা অনুপস্থিত। চট্টগ্রাম বন্দরের গড় পণ্য খালাসের সময় এখনো ১২০ ঘণ্টার বেশি, গভীর সমুদ্রবন্দরের নাম করে পায়রায় অযথা সময় ও অর্থ অপচয় হয়েছে, মাতারবাড়ি সর্বসাধারণের ব্যবসায়িক বন্দর করার পরিকল্পনা এখনো সুস্পষ্ট নয়, চট্টগ্রাম বে-পোর্ট নিয়ে সুস্পষ্ট রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত ছিল না বলে এক দশক সময় নষ্ট হয়েছে।

সমুদ্রবন্দরে কোম্পানি, ব্র্যান্ড কিংবা মালিক দেখে আগে-পরে পণ্য খালাস হবে না। বন্দরে জাহাজ ভেড়ার সর্বোচ্চ ৪৮ থেকে ৭২ ঘণ্টার মধ্যে কনটেইনার খালাস এবং পণ্য ডেলিভারির জন্য সরকারকে চাপ দেবে ব্যবসায়ীরা। অর্থাৎ বন্দরের কনটেইনার হ্যান্ডেলিং এর দ্রুততা এবং কনটেইনার ধারণক্ষমতা হালনাগাদ রাখতে হবে সরকারকে। বন্দরের সেবা দক্ষ, দুর্নীতিমুক্ত ও সাশ্রয়ী করার দাবিগুলো হবে ন্যায্য। সরকার শিপিং লাইনের ব্যবসা করবে না, ব্যবসা করবে বেসরকারি খাত। দলীয় কিংবা প্রভাবশালী কাউকে অন্যের ওপর দাঁড়া করাতে, প্রভাবশালী কাউকে বেশি বন্দর সুবিধা দেবে না সরকার। নৌ, সমুদ্র ও বিমানবন্দর বেসরকারি খাতে দিলে একদিকে বিশেষ শিল্পগোষ্ঠী, করপোরেট মহল কিংবা বড় ব্যবসায়ীর পক্ষে স্বার্থের দ্বন্দ্ব তৈরি হবে। অন্যদিকে ব্যবসায়ীরা বিদেশি সংস্থা কিংবা ভিনদেশি সরকারের স্বার্থে কাজ করার মতো নিরাপত্তার ঝুঁকিও তৈরি হবে।

এভাবে রেলপথও সরকারি খাতে থাকবে, তবে রেলগাড়ি সরকারি-বেসরকারি উভয় ধরনের হবে। কোথায় রুট হবে বা হবে–না, সেটা বেসরকারি ব্যবসা এবং লভ্যাংশ ঠিক করে দেবে না, বরং ঠিক করবে জনগণের মৌলিক গণপরিবহন চাহিদা। অর্থাৎ যাত্রী ও পণ্য পরিবহনের চাহিদামতে লাভহীন রুটেও পণ্য ও যাত্রীবাহী ট্রেন চালাতে হবে, নৌ রুটের ক্ষেত্রে ড্রেজিং করে রুট বাঁচাতে হবে সরকারকে। সরকারের তৈরি রেলপথে বেসরকারি ট্রেন সরকারি ট্রেনের সঙ্গে পাল্লা দেবে। সরকার সেখানে বেসরকারি বিকাশের কোনো সচেতন ও অচেতন বাধা তৈরি করবে না। ইউরোপে সরকারি ট্রেনের সঙ্গে সেবামানে পাল্লা দিয়ে চলে বেসরকারি ট্রেন, আছে বেসরকারি আন্তনগর ও লোকাল উভয় ট্রেন। জলবায়ু পরিবর্তনের সচেতনতার যুগে, ঘনবসতিপূর্ণ বাংলাদেশে রেলকেই জাতীয় গণপরিবহন বিবেচিত করতে হবে।

অর্থাৎ ব্যবসা বেসরকারিতে যাবে, কিন্তু রেগুলেশন যাবে না। পরিবহন ব্যবসা বেসরকারিতে যাবে, কিন্তু বন্দর যাবে না। তবে রেগুলেশন বৈষম্যহীন হবে এবং কৌশলগত অবকাঠামোতে প্রবেশাধিকার ও ব্যবহার সুবিধা সব বেসরকারি কোম্পানির জন্য সমানভাবে উন্মুক্ত হবে। তবে সরকারের বাজে ব্যবস্থাপনা দুর্নীতির এবং অদূরদর্শী পরিকল্পনার বিহিত না করলে, সরকারি ব্যবস্থাপনাকে, পাবলিক রেগুলেশনকে বেসরকারীকরণের চাপ দিন দিন প্রবল হতে পারে। বিশ্বব্যাপী করপোরেশন শক্তিশালী হয়ে সরকারকে দুর্বল করছে। বাংলাদেশের ভঙ্গুর নির্বাচনী ব্যবস্থা সরকারের বৈধতা, নৈতিকতা, যোগ্যতা ও দক্ষতা সবকিছুকেই শক্তিহীন করেছে। এখানে অবকাঠামো পরিকল্পনাগুলোকে গবেষণা, তথ্য–উপাত্তনির্ভর প্রাক্কলন ও জ্ঞানগত ব্যবস্থাপনায় সংজ্ঞায়িত করা যাচ্ছে না। অর্থাৎ রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়ন ও আঞ্চলিক রাজনীতির পাশাপাশি অবকাঠামোর দূরদর্শী বিকাশে আধুনিক রেগুলেটরি জ্ঞানের অভাবও বড় সমস্যা। কোন খাতে ৫ শতাংশ (বিলাস পণ্য) শুল্ক বসবে আর কোন খাতে ৩৩ শতাংশ (জ্বালানি তেল), তা কোনোভাবেই গবেষণাজাত সিদ্ধান্ত নয়।

ব্যবসায়ীরা ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের আট লেনের এক্সপ্রেসওয়ে উন্নীতকরণ প্রকল্প এবং সড়কপথের ওপর অতি নির্ভরশীলতা কমিয়ে নৌপথের দিকে বেশি নজর দেওয়ার অসামঞ্জস্যপূর্ণ তাগিদ দিয়েছেন। অথচ এই ব্যবসায়ীরাই চট্টগ্রাম-পানগাঁও নৌ রুট এবং পানগাঁও কনটেইনার বন্দর ব্যবহারে আগ্রহ দেখায়নি, টার্মিনালটি ৭৫ শতাংশ অব্যবহৃত। বাংলাদেশ বর্তমানে একটি অর্থনৈতিক অবকাঠামো উত্তরণের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। তবে বন্দর, সড়ক, রেল, নৌপথের সামঞ্জস্যপূর্ণ মহাপরিকল্পনা অনুপস্থিত। চট্টগ্রাম বন্দরের গড় পণ্য খালাসের সময় এখনো ১২০ ঘণ্টার বেশি, গভীর সমুদ্রবন্দরের নাম করে পায়রায় অযথা সময় ও অর্থ অপচয় হয়েছে, মাতারবাড়ি সর্বসাধারণের ব্যবসায়িক বন্দর করার পরিকল্পনা এখনো সুস্পষ্ট নয়, চট্টগ্রাম বে-পোর্ট নিয়ে সুস্পষ্ট রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত ছিল না বলে এক দশক সময় নষ্ট হয়েছে। ঢাকা-চট্টগ্রাম সরাসরি রেলপথ হয়নি, এমনকি পুরোনো ট্রাক ব্রডগেজেও উন্নীত হয়নি। ঢাকা-চট্টগ্রাম কার্গো রেল এখনো গুরুত্ব পায়নি। ইপিজেড, এসইপিজেড এবং কৃষি উৎপাদনের কেন্দ্রগুলোকে পণ্যবাহী রেল এবং নৌ-কার্গো রুটের মাধ্যমে সংযুক্ত করার ভবিষ্যৎমুখী কোনো উদ্যোগ নেই।

ঢাকা-চট্টগ্রাম-খুলনায় সড়ক আছে, তবে সংযোগ-সড়ক, কম গতির যান চলাচরের আলাদা রাস্তা, বিরতিহীন প্রবেশ ও বাহির পথ নেই বলে বাংলাদেশের কোনো সড়কই এখনো আন্তর্জাতিক মানের মহাসড়ক হয়ে ওঠেনি। বিভাগীয় মহানগরীগুলোতে ট্রাম, বিআরটি ও মেট্রো রেলের সমন্বিত মাস্টারপ্ল্যান নেই, কিছু বিচ্ছিন্ন ফ্লাইওভার হচ্ছে শুধু। ঢাকা মেট্রোরেল রাজধানীর প্রবেশপথগুলোকে পরস্পর সংযুক্ত করছে না। চট্টগ্রাম নগরের ট্রাফিক থেকে সমুদ্র ও বিমানবন্দরের যানকে আলাদা করার বিষয় পরিকল্পনায় স্থান পায়নি বলে বাস্তবায়িত টানেলের উপযোগিতা কম হবে। অন্যদিকে বাংলাদেশের বিমানবন্দরের গ্রাউন্ড সার্ভিসের মান বাজে এবং অনিরাপদ। এয়ারপোর্ট ট্যাক্স বেশি হওয়ায়, ওয়েটিং টাইম বেশি বলে ইউরোপীয় অভ্যন্তরীণ বিমান যোগাযোগের তুলনায় বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক উভয় ফ্লাইটের খরচ বেশি।

সড়ক, রেল, নৌ, বিমানের একটি মাধ্যমকে কম গুরুত্ব দিয়ে অপরটিতে বেশি নজর দেওয়া অদূরদর্শী। বরং সব পথের অন্তত ৫০ থেকে ১০০ বছরের ভবিষ্যৎ যাত্রী ও পণ্য পরিবহন প্রবৃদ্ধি মাথায় রেখে অবকাঠামো পরিকল্পনা সাজাতে হবে। ব্যবসায়ীদের দাবিতে এসব গুরুত্ব পায় না, এই বড় ব্যবসায়ীদের এমন কাউকে দেখা যায় না, যাঁরা আমদানি কিংবা রপ্তানিতে শুল্ক ছাড়ের সুবিধা পেয়েও শুল্ক ও কর ফাঁকি দেন না।

সড়ক, রেল, নৌ, বিমানের একটি মাধ্যমকে কম গুরুত্ব দিয়ে অপরটিতে বেশি নজর দেওয়া অদূরদর্শী। বরং সব পথের অন্তত ৫০ থেকে ১০০ বছরের ভবিষ্যৎ যাত্রী ও পণ্য পরিবহন প্রবৃদ্ধি মাথায় রেখে অবকাঠামো পরিকল্পনা সাজাতে হবে। ব্যবসায়ীদের দাবিতে এসব গুরুত্ব পায় না, এই বড় ব্যবসায়ীদের এমন কাউকে দেখা যায় না, যাঁরা আমদানি কিংবা রপ্তানিতে শুল্ক ছাড়ের সুবিধা পেয়েও শুল্ক ও কর ফাঁকি দেন না। আশি ও নব্বই দশকের অবকাঠামোগুলোর ক্যাপাসিটি নির্ণয়ের ইনপুট হিসেবে নেওয়া যানবাহন সংখ্যা এবং লোডের প্রাক্কলন বর্তমান প্রয়োজনের মাত্র এক-চতুর্থাংশ ছিল। ১০০ বছরের লাইফ সাইকেলের এক–চতুর্থাংশ সময় পার হওয়ার পরই সড়ক ও সেতু পরিত্যক্ত হয়ে গেছে, ভেঙে নতুন করে নির্মাণের প্রয়োজন হয়েছে। ডিজাইন, ডাইমেনশনিং ও ফোরকাস্টগুলো এমনসব নির্দেশক, যার ওপর ভিত্তি করে বলা চলে, আশি ও নব্বই দশকে বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ অর্থনৈতিক উন্নয়নের যে প্রবৃদ্ধি হিসাব করা হয়েছিল, তা চরম ত্রুটিপূর্ণ, বর্তমান অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির পূর্ণ বিকাশের পথে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। অর্থাৎ ইন্টেলেকচুয়ালিটি দিয়ে আমরা দেশের ইকোনমিক পটেনশিয়াল নির্ণয় করতে ব্যর্থ হয়েছি সেসময়ে। এই সমস্যাগুলো এখনো রয়ে গেছে ব্যাপক হারে। সরকারের প্রকল্প বাস্তবায়নের অদক্ষতা, ভুল পরিকল্পনা, ব্যবসায়ী নেতাদের পরামর্শ, তারই ইঙ্গিত দেয়।

দেশের বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতার প্রায় অর্ধেক অব্যবহৃত, যে হারে উৎপাদন বাড়ানো হয়েছে, সে হারে সঞ্চালন এবং বিশেষভাবে বিদ্যুৎ বিতরণ অবকাঠামোর সক্ষমতা বাড়ানো হয়নি, ফলে অলস বিদ্যুতের বিপরীতে ভর্তুকি দিতে হয়েছে এক দশকে প্রায় ষাট হাজার কোটি টাকা। পদ্মা সেতু যে উচ্চতায় তৈরি হয়েছে তাতে অর্থনৈতিক সক্ষমতা বাড়ার সঙ্গে যদি নৌযানের আকার বাড়ে তা সেতুর নীচ দিয়ে যাতায়াত করতে পারবে না। কম উচ্চতায় নির্মিত হওয়ার কারণে অনেক সেতু ভেঙে নতুন করে গড়তে হবে। নতুন রেলপথ ইলেকট্রিক হচ্ছে না, কোনটি হয়নি ব্রডগেজও। রেলের ইঞ্জিন কেনায় ত্রুটি ছিল। পদ্মা রেল সংযোগ পরিকল্পনায় ভায়াডাক্ট ত্রুটি ছিল, উপরন্তু রেল সিঙ্গেল লাইন বলে তা ভবিষ্যতের প্রয়োজন মেটাবে না। যদি এক দশকের মধ্যে আলাদা পদ্মা রেলসেতুই করা লাগে, তাহলে পদ্মা সেতুতে রেলসংযোগ নিয়ে এতটা সময় ক্ষেপণ করে এতটা ব্যয়ের দায় নেওয়া হলো কেন? সড়ক, রেল ও বন্দরের একটি প্রকল্পও দেখানো যাবে না যার পরিকল্পনায় ত্রুটি ছিল না, ব্যাপক হারে নির্মাণ ব্যয় বাড়েনি এবং অতি দীর্ঘ সময় ক্ষেপণ হয়নি। আমাদের ব্যবসায়ীরা সেসব নিয়ে কথা বলতে নিদারুণ হীনম্মন্যতায় ভোগেন। তাঁরা উৎসাহ পান বেসরকারীকরণের নগদপ্রাপ্তিতে, সমন্বিত ভবিষ্যৎ অবকাঠামো মহাপরিকল্পনার পরিপ্রেক্ষিতেও তাঁদের চিন্তা ও দাবি গোষ্ঠী স্বার্থকেন্দ্রিক।

ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব টেকসই উন্নয়নবিষয়ক লেখক। ‘চতুর্থ শিল্পবিপ্লব ও বাংলাদেশ’, ‘বাংলাদেশ অর্থনীতির ৫০ বছর’ গ্রন্থের রচয়িতা। [email protected]