
যা করার কথা বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের, তা-ই করেছে পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইনস (পিআইএ)। ঘটনাটি ঘটেছে ১৮ ডিসেম্বর রাওয়ালপিন্ডির বেনজির ভুট্টো আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে। পিআইএর পুরোনো বিমানের নিরাপদ যাত্রার জন্য আল্লাহর রহমত কামনায় সদকা হিসেবে একটি কালো ছাগল বিমানবন্দর টারমাকেই জবাই করা হয়েছে। মানুষের জীবন রক্ষায় হতভাগ্য ছাগলের জীবন উৎসর্গ করার প্রয়োজন হলো।
৭ ডিসেম্বর পিআইএর এটিআর-৪২ নামের ফ্রান্সে নির্মিত টার্বোপ্রোপ একটি বিমান বিধ্বস্ত হলে ৪৭ আরোহীর সবারই মৃত্যু হয়। তারপর থেকেই ওই সিরিজের সব বিমান উড্ডয়ন স্থগিত করা হয় পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য। পিআইএর একজন কর্মকর্তা ইংরেজি দৈনিক ডনকে জানান, নতুন করে এটিআর বিমান উড্ডয়নের অনুমতি পাওয়ায় শুকরিয়া হিসেবে রোববার ছাগলটিকে সদকা দেওয়া হয়। ছাগল সদকা দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে একটি এটিআর-৪২-৫০০ বিমান পিন্ডি থেকে মুলতানের উদ্দেশে ছেড়ে যায়। সদকার ছাগল জবাই করার দৃশ্য মিডিয়ায় দেখা গেছে। অবুঝ প্রাণীর গলায় ছুরি চালানোর পর ফিনকি দিয়ে রক্ত বেরোচ্ছে। তা দেখে পাকিস্তানি কর্মকর্তারা দাঁত বের করে হাসছেন।
বিশ্বের বিভিন্ন অংশে উড়োজাহাজ বিধ্বস্ত হওয়ার খবর হামেশাই পাওয়া যায়। এই নিবন্ধটি যখন লিখছি, তখনই সংবাদ পাওয়া গেল রাশিয়ার একটি সামরিক বিমান রোববার কৃষ্ণসাগরে বিধ্বস্ত হয়েছে, তাতে ৯২ আরোহীর সবাই নিহত হয়েছেন। আরোহীদের মধ্যে ছিলেন সেনাসদস্য ৮ জন, সাংবাদিক ৯ জন, সামরিক সংগীত দলের সদস্য ৬৪ জন। অতি সেরা এয়ারলাইনসের বিমানও বিধ্বস্ত হয়ে থাকে। দুর্ঘটনা হলো দৈবদুর্বিপাক। তবে নিকৃষ্ট বিমান সংস্থাগুলোর ভয় বেশি। একসময় পিআইএ একটি নির্ভরযোগ্য বিমান সংস্থা হিসেবে স্বীকৃত ছিল, বিশেষ করে ১৯৭১-এর আগে। ’৭১-এর ২৮ ফেব্রুয়ারির আগে অর্জিত পাকিস্তানের যেকোনো সাফল্যে বাঙালির হিস্যা রয়েছে। তখনকার অর্জনে পশ্চিম পাকিস্তানিদের কৃতিত্ব ৪৪ ভাগ আর পূর্ব বাংলার বেঁটেখাটো বাঙালির কৃতিত্ব ৫৬ ভাগ। এই সত্য তারাও অস্বীকার করতে পারবে না। বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনস পিআইএরই উত্তরাধিকার। এখন পিআইএর ব্যবস্থাপনা খুব খারাপ। আর আমাদের বিমান বাংলাদেশ?
গত ২৭ নভেম্বর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সরকারি সফরে হাঙ্গেরি যাচ্ছিলেন। যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে তাঁর বিমানটি তুর্কমেনিস্তানের আশখাবাদে জরুরি অবতরণ করে। ওই দিনই ব্রিটেনের ডেইলি টেলিগ্রাফ এক প্রতিবেদনে বিশ্বের নিকৃষ্টতম ২১টি বিমান সংস্থার নাম প্রকাশ করে। তাতে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের নামটিও জ্বলজ্বল করছে। ওই প্রতিবেদনের শিরোনাম ছিল ‘দ্য টোয়েন্টি ওয়ান ওয়ার্স্ট এয়ারলাইনস ইন দ্য ওয়ার্ল্ড’। দুর্নীতিতে চ্যাম্পিয়নের তালিকায় নাম উঠেছে অনেক আগেই বাংলাদেশের, এবার নাম উঠল বিমানের। বিমানের সঙ্গে ওই তালিকায় আরও আছে নাসাউয়ের ‘বাহামাসেইর’, উত্তর কোরিয়ার ‘কোরিয়ান এয়ার’, সুদানের ‘এয়ারওয়েজ’, নেপালের ‘নেপাল এয়ারলাইনস’, ইরানের ‘মাহান এয়ার’, ইয়েমেনের ‘ইমেনিয়া’ প্রভৃতি।
প্রধানমন্ত্রীকে বহনকারী উড়োজাহাজের যান্ত্রিক ত্রুটি ধরা পড়ার পর বিমানের আরও কয়েকটি ফ্লাইটে বিপত্তি দেখা দেয়। ওমানের রাজধানী মাস্কাট থেকে চট্টগ্রামগামী বিমানের বোয়িং-৭৩৭ উড়োজাহাজটি উড্ডয়নের পরই এর চাকা থেকে একটি অংশ খুলে পড়ে বিমানবন্দরের রানওয়েতে। ঘটনাটি মাস্কাট বিমানবন্দর কন্ট্রোল টাওয়ারের নজরে এলে তখনই তা পাইলটকে জানানো হয়। ক্যাপ্টেন মাস্কাট বিমানবন্দরে ফিরে যাবেন, নাকি চট্টগ্রামের পথেই থাকবেন—তা নিয়ে সিদ্ধান্তহীনতায় পড়েন। পরে ঝুঁকি নিয়েই ১৫৯ জন যাত্রীসহ তিনি বাংলাদেশের আকাশসীমায় আসেন, তবে চট্টগ্রামে অবতরণ না করে ঢাকা বিমানবন্দরে জরুরি অবতরণ করেন। কারণ হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের নিরাপত্তাব্যবস্থা অপেক্ষাকৃত উন্নত চট্টগ্রামের শাহ আমানতের তুলনায়। আল্লাহর রহমত ও ক্যাপ্টেনের দক্ষতায় ওই ফ্লাইটের যাত্রী ও ক্রুরা বেঁচে গেছেন।
প্রধানমন্ত্রীর হাঙ্গেরিগামী ফ্লাইটে উড়োজাহাজের ইঞ্জিনের নাকি কোনো একটি নাট ঢিলা ছিল, যে কারণে ইঞ্জিনে জ্বালানির পরিমাণ হ্রাস পেয়েছিল। ফলে ক্যাপ্টেন আশখাবাদে জরুরি অবতরণ করতে বাধ্য হন। ঝুঁকি না নিয়ে পাইলট অত্যন্ত দায়িত্বশীলতারই পরিচয় দিয়েছেন। ওই ঘটনার পরপরই কাঠমান্ডুগামী বিমানের একটি ফ্লাইটে যান্ত্রিক ত্রুটি ধরা পড়ায় তা ঘুরিয়ে ঢাকায় জরুরি অবতরণ করানো হয়। ওই ফ্লাইটে অক্সিজেনের ঘাটতি দেখা দিয়েছিল। আতঙ্কে হোক বা যে কারণেই হোক যাত্রীদের কেউ কেউ অসুস্থ হয়ে পড়েন।
বাংলাদেশ বিমানের পাইলট ও প্রকৌশলীদের দক্ষতার প্রশংসা আমি একাধিকবার বিদেশিদের মুখে শুনেছি। শুনে ভালো লেগেছে। তা ছাড়া, আমি বিমানে ভ্রমণ করে দেখেছি সেই পুরোনো ঝরঝরে ডিসি-১০ উড়োজাহাজ তাঁরা কীভাবে নিরাপদে চালিয়েছেন বহু বছর। অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক রুটে আমি অনেকবার ডিসি-১০-এর যাত্রী হিসেবে দেখেছি দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ায় আমাদের বাঙালি পাইলটরা দক্ষতার সঙ্গে বিমান নিরাপদে গন্তব্যে নিয়ে গেছেন। বিমানের অব্যবস্থাপনা ও দুর্নীতি এক জিনিস আর পাইলট ও প্রকৌশলীদের দক্ষতা আরেক জিনিস।
প্রধানমন্ত্রীকে বহনকারী হাঙ্গেরিগামী উড়োজাহাজের নাট ঢিলার ঘটনা নিয়ে এ পর্যন্ত দায়িত্বশীলদের মুখ থেকে ১০-১২ রকমের বক্তব্য শোনা গেছে। বিভিন্ন ধর্মীয় উপাসনালয়ে প্রার্থনা হয়েছে। তার একটি আধ্যাত্মিক মূল্য থাকতে পারে। কিন্তু আমি যদি বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটনমন্ত্রী অথবা সরকারের দায়িত্বশীল পদে থাকতাম, তাহলে সভা-সমাবেশে হইচই না করে, অনুমানপ্রসূত কথাবার্তা বাজারে না ছড়িয়ে, মানুষের মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টি না করে, যাকে-তাকে বলির পাঁঠা না বানিয়ে নীরবে একটি বা একাধিক উচ্চপর্যায়ের তদন্ত দল গঠন করতাম। তাতে শুধু আমাদের লোক নয়, ওই উড়োজাহাজ নির্মাতা কোম্পানির একজন ইঞ্জিনিয়ারকেও আমন্ত্রণ জানাতাম তদন্ত দলকে সহযোগিতা দিতে।
প্রধানমন্ত্রীকে বহনকারী বিমানের ত্রুটি একটি ছেলেখেলা নয়। যান্ত্রিক ত্রুটি থাকলে সেটাও ভয়ংকর, কোনো ষড়যন্ত্র হয়ে থাকলে সেটাও ভয়ংকর। নানা রকম দায়িত্বজ্ঞানহীন বায়বীয় উক্তির ফল হয়েছে এই যে দুনিয়ার মানুষ বিমানের নাম শুনলেই আঁতকে উঠছেন এবং বিমানের টিকিট না কেটে তাঁরা ভাবছেন মরি তো মাটিতেই মরব, বিমানে উঠে মাঝ-আকাশে নয়।
কোনো ব্যক্তি বা জাতি দুভাবে অন্যের চোখে ছোট বা হেয় হয়—বোকামির জন্য এবং অতিচালাকির কারণে। বাংলায় প্রবাদ রয়েছে—অতি চালাকের গলায় দড়ি। বাংলাদেশিদের একটি গোত্র অতি চালাক হতে গিয়ে হয় নিজের গলায় নিজে দড়ি বেঁধে ফাঁস লাগায়, অথবা দোকান থেকে কুড়াল কিনে নিজের পায়ে নিজেই মারে কোপ। বাংলাদেশিদের ক্ষতি করার জন্য অন্যের প্রয়োজন নেই। ইতিহাসে যতবার বাঙালি উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করেছে, ততবার সে দড়ি ও কুড়ালের সদ্ব্যবহার করেছে। আগে থেকেই বদনাম ছিল, গত কয়েক সপ্তাহে বিমানের ভাবমূর্তি এমন জায়গায় গেছে যে কোনো বিদেশি বিমান দেখলেই দৌড় দেবে।
বিমানের যখন সর্বনাশ, তখন অন্যান্য দেশের এয়ারলাইনসগুলোর পৌষ মাস। বিমানের ভাগ্যবিপর্যয়ে সৌভাগ্যের দরজা খুলে গেছে অন্য দেশের বিমান সংস্থাগুলোর। হয়তো এসব সুপরিকল্পিতভাবেই হচ্ছে। বিমানের এই দশা থেকে পরিত্রাণ পেতে খুব বেশি যাঁরা দেশপ্রেমিক তাঁরা বলবেন, আর পারছি না বাপু, একেবারে বন্ধ করে না দিয়ে, লোকসান না পোহায়ে বরং কোনো বিদেশি এয়ারলাইনসকে লিজ দিয়ে দিই। ইজারা দিলে লোকসান দেওয়ার ল্যাঠা চুকে যাবে।
যে দেশের এক কোটি মানুষ মধ্যপ্রাচ্য ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন দেশে প্রবাসী শ্রমিক, যাঁদের কষ্টার্জিত টাকায় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সিন্দুক বৈদেশিক মুদ্রায় ঠাসা, সে দেশের জাতীয় বিমান সংস্থা লোকসান দেয়, এ কথা কেউ বিশ্বাস করতে চাইবে না। বিমানের টিকিট কিনতে গেলে কাউন্টার থেকে ধমকের সুরে বলা হয় ‘টিকিট নাই’। তারপর কাকুতি-মিনতি করলে ওই ধমকদাতাই নরম সুরে বলেন, ‘অমুক এয়ারলাইনসের টিকিট জোগাড় কইরা দিবার পারি।’ আমার নিজের অভিজ্ঞতা থেকে দেখেছি, প্রথমে টিকিট চেয়ে পাইনি। বহু ধরাধরি করে পেয়েছি বটে, প্লেনে উঠে দেখেছি অর্ধেক সিট খালি। বহুদিনের দুর্নীতিতে বিমানের ভেতরটা যক্ষ্মা রোগীর ফুসফুসের মতো ঝাঁঝরা হয়ে গেছে। যার ফুসফুস ঝাঁঝরা তার দেহে বল ও চেহারায় চাকচিক্য কোনোটাই থাকবে না।
প্রধানমন্ত্রীর বিমানের ইঞ্জিনের নাট ঢিলায় দায়িত্বে অবহেলার জন্য নয়জন প্রকৌশলীর বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। তাঁদের বরখাস্ত করা হয়েছে। গ্রেপ্তার হয়েছেন কয়েকজন। যেকোনো অনিয়ম ও কর্তব্যে অবহেলার অভিযোগে ত্বরিতগতিতে এক দল কর্মচারী-কর্মকর্তার কোমরে দড়ি দিয়ে রিমান্ডে নিলেই সংস্থার উন্নতি ঘটানো যায় না। প্রথমে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ তদন্ত প্রয়োজন। অভিযুক্ত ব্যক্তি দোষী প্রমাণিত হলে কঠোর শাস্তি তাঁর প্রাপ্য। অপরাধ করবে একজন, তার জন্য ভুগবে ১১ জন, তা খুবই অগ্রহণযোগ্য ব্যবস্থা। তার ফলে অন্য সব কর্মকর্তা–কর্মচারীর মধ্যে আতঙ্কের সৃষ্টি হয়।
ওয়াকিবহাল মহলের ধারণা, বিমানের প্রশাসনিক দক্ষতার অভাব কল্পনার বাইরে। ভেতরে চেইন অব কমান্ড ভেঙে পড়েছে অনেক আগেই। কারও ওপর কারও নিয়ন্ত্রণ নেই। সংস্থায় সিবিএ নামক যে পরাক্রান্ত বস্তুটি রয়েছে, তার ক্ষমতা যে কী পরিমাণ, তা রাষ্ট্রের কেউ জানে না। প্রজাতন্ত্রের সব প্রতিষ্ঠানের মতো বিমানেও অসীম ক্ষমতাবান সিন্ডিকেট গড়ে উঠেছে। তার নেতৃত্বে ক্ষমতাসীন দলের লোক। তাদের কাছে জনগণ ও রাষ্ট্র জিম্মি।
যে মধ্যম আয়ের দেশের জাতীয় পতাকাবাহী বিমান সংস্থা নিকৃষ্ট মানের, যে সংস্থার উড়োজাহাজে চড়তে মানুষ ভয় পায়, সে মধ্যম আয়ের দেশ নিয়ে অহংকার করা যায় না। বদনাম শুধু বিমানেরই নয়, আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর ব্যবস্থায় যে অদক্ষতা ও দুর্নীতি, তার সংবাদ সারা দুনিয়ার লোক জানে। বিমানবন্দর ও বিমানের সব নাট টাইট দিতে হলে সরকারকে অপ্রীতিকরভাবে কঠোর হতে হবে। তা হওয়া কি আমাদের কোনো সরকারের পক্ষে সম্ভব?
সৈয়দ আবুল মকসুদ: লেখক ও গবেষক।