বিশ্বজুড়ে টিকা বিতরণে অসমতা কি মানবতাবিরোধী অপরাধ নয়

শুধু সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ ও তার ফলে সৃষ্ট মৃত্যু প্রতিরোধই নয়, দেশব্যাপী দীর্ঘমেয়াদি হার্ড ইমিউনিটি অর্জনের জন্য দ্রুততম সময়ের মধ্যে দেশের বেশির ভাগ মানুষের মধ্যে কোভিড-১৯-এর টিকার ব্যাপক প্রসার অত্যন্ত জরুরি। তা না হলে স্বাস্থ্য খাত তো বটেই, অর্থনৈতিকভাবে বাংলাদেশসহ সব উন্নয়নশীল দেশই শিগগির মুখ থুবড়ে পড়তে বাধ্য। অর্থনৈতিক মন্দা, রাজনৈতিক ও সামাজিক অনিরাপত্তার দুষ্টচক্র থেকে বেরিয়ে আসা ওই সব দেশের জন্য একরকম অসম্ভবই হয়ে পড়বে।

দ্রুত সময়ের মধ্যে একাধিক ব্র্যান্ডের করোনার টিকা উদ্ভাবন নিঃসন্দেহে আমাদের সবার মনেই মহামারির কার্যকর নিয়ন্ত্রণের ব্যাপারে অনেক আশার আলো জাগিয়েছে। করোনার সংক্রমণ ও এই মহামারির তীব্রতা কমানো এবং তার ফলে সৃষ্ট মৃত্যুহার রোধের ব্যাপারে টিকাগুলোর কার্যকারিতা নিয়ে কারও মনেই তেমন বড় কোনো প্রশ্ন নেই। এখন পর্যন্ত জানা তথ্যমতে, আমেরিকা, চীন অথবা রাশিয়াতে তৈরি সব টিকাই কমবেশি কার্যকর। কিন্তু প্রশ্ন হলো, পৃথিবীর সব দেশের ব্যাপক জনগোষ্ঠীকে কীভাবে স্বল্প সময়ের মধ্যে টিকাদানের আওতায় আনা যায়, এ ব্যাপারে সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধকতা হলো টিকার মূল্য ও প্রাপ্যতা।

এ ছাড়া টিকাসম্পর্কিত ভুল ধারণা, টিকা প্রদানে অব্যবস্থাপনা আর সামগ্রিকভাবে স্বাস্থ্যব্যবস্থার ওপর সাধারণের আস্থাহীনতা সফলভাবে দ্রুত টিকাদান কর্মসূচিকে বাধাগ্রস্ত করছে।

নানাবিধ প্রতিকূলতার মধ্যেও বাংলাদেশ সরকার ২০২১ সালের জানুয়ারি মাসের ২৭ তারিখে করোনার টিকাদান কর্মসূচি শুরু করে। এই কর্মসূচিতে প্রাথমিকভাবে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে যাঁদের অন্তর্ভুক্ত করা হয়, তাঁদের মধ্যে অন্যতম হলেন চিকিৎসক, নার্স ও সরকারি কর্মচারী। অন্যদের মধ্যে যাঁরা টিকা পেতে আগ্রহী, তাঁদের মোবাইল অ্যাপের মাধ্যমে নিবন্ধন করতে বলা হয়, যা অনেকের অন্তর্ভুক্তির জন্যই সহায়ক ছিল না। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, ইন্টারনেটের ব্যবহার জানেন না অথবা এর আওতায় নেই, এমন জনগোষ্ঠী, যেমন বৃদ্ধ, পঙ্গু ও যাঁরা গ্রামাঞ্চলে বসবাস করেন।

বাংলাদেশে এ পর্যন্ত বিনা মূল্যে সাধারণের কাছে টিকা পৌঁছে দেওয়া হলেও ভবিষ্যতে এই ধারা অব্যাহত থাকবে কি না, তা নিয়ে অনেকের মধ্যেই সন্দেহের সৃষ্টি হয়েছে। বাংলাদেশের মতো দেশে টিকা বিতরণের ক্ষেত্রে অতিমাত্রায় বাণিজ্যিকীকরণের চাপ সরকার কত দিন সহ্য করতে পারবে, সেটাই দেখার বিষয়। বিশেষ করে যে প্রসঙ্গটি নিয়ে বাংলাদেশসহ সব উন্নয়নশীল দেশই অতিমাত্রায় উদ্বিগ্ন তা হলো, বিশ্বব্যাপী টিকার অসম বিতরণ এবং এর ফলে সৃষ্ট টিকাপ্রাপ্তির অনিশ্চয়তা। টিকা প্রস্তুতকারক কোম্পানিগুলোর সীমাহীন লোভ এবং মাত্রাতিরিক্ত মুনাফা অর্জনের বিষয়টি ইতিমধ্যেই সবার নজর কেড়েছে।

করোনা মহামারি শুরুর প্রথম দিকেই বিশ্বখ্যাত ওষুধ কোম্পানি ফাইজার সাফল্য আর অধিক মুনাফা অর্জনের ঘোষণা দিয়েই টিকা তৈরির কাজ শুরু করে।শেয়ারহোল্ডারদের আস্থা আর আনুকূল্য অর্জনই ছিল এ ধরনের আগাম ঘোষণার মূল কারণ। ২০২১ সালের প্রথম ৩ মাসেই ফাইজার ৩ দশমিক ৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার সমমূল্যের করোনার টিকা বিক্রয় করে, যা থেকে কোম্পানিটি শত শত মিলিয়ন মার্কিন ডলার মুনাফা করে। অন্যান্য কোম্পানিও শুধু করোনার টিকা বিক্রয় করে অতীতের যেকোনো মুনাফার অঙ্ককে ছাড়িয়ে গেছে। মডার্না জনগণের টাকায় করোনার টিকা উদ্ভাবন করলেও আগামী কয়েক মাসের মধ্যেই এই টিকা বিক্রি করে কোম্পানিটি কয়েক বিলিয়ন মার্কিন ডলার আয় করার পথ পরিষ্কার করেছে। এমনকি অ্যাস্ট্রাজেনেকাও মুনাফা অর্জনের এই পথেই রয়েছে, যদিও টিকা তৈরির প্রথম দিকে তারা মুনাফা অর্জনের পথ থেকে দূরে থাকার জন্যই প্রতিজ্ঞাবদ্ধ ছিল।

বড় বিস্ময়ের ব্যাপার হলো, কোনো ধনী দেশই অপেক্ষাকৃত গরিব দেশগুলোর সঙ্গে দ্রুত ও সমতার ভিত্তিতে টিকা ভাগাভাগি করে নেওয়ার জন্য মোটেই আগ্রহী নয়। যেখানে যুক্তরাজ্যের ৬০ শতাংশের চেয়ে বেশি মানুষ টিকার সব কটি ডোজ পেয়েছে, সেখানে আফ্রিকা মহাদেশের উগান্ডায় টিকা গ্রহণকারীর হার শুধু ১।

এর চেয়েও বড় বিস্ময়ের ব্যাপার হলো, কোনো ধনী দেশই অপেক্ষাকৃত গরিব দেশগুলোর সঙ্গে দ্রুত ও সমতার ভিত্তিতে টিকা ভাগাভাগি করে নেওয়ার জন্য মোটেই আগ্রহী নয়। যেখানে যুক্তরাজ্যের ৬০ শতাংশের চেয়ে বেশি মানুষ টিকার সব কটি ডোজ পেয়েছে, সেখানে আফ্রিকা মহাদেশের উগান্ডায় টিকা গ্রহণকারীর হার শুধু ১। গরিবতম ৫০টি দেশ, যেখানে পৃথিবীর মোট জনসংখ্যার ২০ শতাংশ মানুষ বাস করে, সেখানে এখন পর্যন্ত প্রস্তুত করা মোট টিকার মাত্র ২ শতাংশ ডোজ পৌঁছতে পেরেছে। এই লজ্জার দায়ভার কি ধনী দেশগুলোর ওপর একটুও বর্তায় না? টিকার প্রাপ্যতা বাড়াতে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বারবার ধনী দেশগুলোকে বুস্টার ডোজ না দেওয়ার জন্য আহ্বান করলেও ফাইজারের মতো বড় টিকা প্রস্তুতকারী কোম্পানিগুলো শুধু অধিক মুনাফার আশায় এই আহ্বানে কর্ণপাত না করার জন্য রাজনৈতিক নেতাদের প্রলুব্ধ করছে। এর কারণ, তারা পূর্বপ্রতিশ্রুতি অনুযায়ী ৩৩ দশমিক ৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের সমমূল্যের টিকা দ্রুত সময়ের মধ্যে বিক্রি করতে চায়।

অবাক করার মতো ব্যাপার হলেও সত্যি, ২০২০ সালের সেপ্টেম্বর মাসের মধ্যেই বিশ্বের সবচেয়ে ৩০টি ধনী দেশ তখন পর্যন্ত প্রাপ্ত সব ভ্যাকসিন আগাম ক্রয়ের মাধ্যমে কিনে নেয়। যা সবার কাছে আজ ‘ভ্যাকসিন বর্ণবাদ’ নামেই পরিচিত বেশি। কানাডা তার প্রয়োজনের পাঁচ গুণ বেশি ভ্যাকসিন কিনেছে, আর যুক্তরাজ্য কিনেছে প্রয়োজনের তুলনায় চার গুণ বেশি। বর্তমানে ধনী দেশগুলো আনুমানিক এক বিলিয়ন ডোজ অতিরিক্ত টিকার ওপর বসে আছে, যেখানে গরিব দেশগুলো সরবরাহের জন্য এখন পর্যন্ত বেশির ভাগ মানুষকেই টিকাদানের আওতায় আনতে পারেনি। বর্তমানের এই অবস্থাকে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রধান ইতিহাসের সবচেয়ে বড় নৈতিক অবক্ষয় বলে আখ্যায়িত করেছেন।

টিকা বিতরণের ক্ষেত্রে এ ধরনের অসম অবস্থা আসতে পারে, সেটা হয়তো টিকা উদ্ভাবনের প্রথম দিকেই আঁচ করা হয়েছিল। তারই পরিপ্রেক্ষিতে কোভ্যাক্স নামে টিকা ক্রয় এবং বিতরণের জন্য একটি আন্তর্জাতিক প্ল্যাটফর্ম করা হয়েছিল। উদ্দেশ্য ছিল, এই প্ল্যাটফর্ম দাতাদেশগুলোর সহায়তায় পর্যাপ্ত পরিমাণ টিকা ক্রয় এবং মজুত করবে, যাতে দরিদ্রতম ৯২টি দেশে অন্ততপক্ষে মোট চাহিদার ২০ শতাংশ টিকা সরবরাহ করতে পারে। টিকাসমতার উদ্দেশ্য নিয়ে কোভ্যাক্সের মহান যাত্রা শুরু হলেও মূলত ধনী দেশগুলোর অসহযোগিতার কারণেই সেটা আলোর মুখ দেখেনি। যেখানে প্রয়োজন কয়েক বিলিয়ন ডোজ, সেখানে তারা এখন পর্যন্ত মাত্র ১৬৩ মিলিয়ন ডোজ টিকা সংগ্রহ করতে পেরেছে। এই লজ্জা কার?

এই যদি হয় বিশ্বব্যাপী টিকা বিতরণের অবস্থা, তাহলে আফ্রিকা, এশিয়া ও লাতিন আমেরিকার দেশগুলোতে টিকার মাধ্যমে প্রতিরোধযোগ্য কোভিড-১৯-এর ফলে সৃষ্ট অসুস্থতা ও মৃত্যুর জন্য দায়ী কে?

ড. জিয়াউদ্দিন হায়দার হেলথ সিস্টেম ইমপ্রুভমেন্ট ফোরামের প্রতিষ্ঠাতা