বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তিতে জিপিএ–৫ এর হিসাব যখন ‘অভিশাপ’

এইচএসসির ফলাফলে গত এক দশকে সবচেয়ে বেশি জিপিএ–৫ এর রেকর্ড হয়েছে এবার
ছবি: প্রথম আলো

মহামারি কাঁধে নিয়ে কয়েক দিন আগে এইচএসসি ও সমমানের ফলাফল প্রকাশিত হয়েছে। বলা হচ্ছে, ঘরে থাকা শিক্ষার্থীরা যখন কলেজের মুখ দেখতে পারেনি, সেসব শিক্ষার্থীরাই এবার স্মরণকালের সেরা ফলাফল করেছে। সংক্ষিপ্ত সিলেবাসে লিখিত ও সেমি অটোপাসের আদলে পাওয়া জিপিএ ফলাফল স্বস্তি দিলেও মূল প্রতিযোগিতা শুরু হবে বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষায়।

প্রথম আলোয় প্রকাশিত খবরে বলা হচ্ছে, এবার এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষায় ১৩ লাখ ৬ হাজার ৭১৮ জন শিক্ষার্থী উত্তীর্ণ হয়েছেন, যেখানে কেবল জিপিএ-৫ পেয়েছেন ১ লাখ ৮৯ হাজার ১৬৯ জন। আর এই বিশালসংখ্যক শিক্ষার্থী দেশের ৫২টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রায় ৬০ হাজার আসনের বিপরীতে ভর্তি পরীক্ষার জন্য লড়বেন। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে অধীন ৮৮১টি কলেজে স্নাতকে ৪ লাখ ৩৬ হাজার ২৮৫টি আসন রয়েছে।

প্রতিবছর এসব ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নেওয়ার জন্য সুনির্দিষ্টভাবে একক কোনো নিয়ম না থাকায় বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় তাদের নিজস্ব ভর্তি যোগ্যতা ও নিয়মের বলয়ে ভর্তি পরীক্ষা নেয়। ফলে কাঙ্ক্ষিত বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় টিকতে হলে নির্দিষ্ট প্রশ্নপত্রের কাঠামো ঘিরে শিক্ষার্থীদের প্রস্তুতি নিতে হয়। তুমুল প্রতিযোগিতাপূর্ণ এসব ভর্তি পরীক্ষায় প্রাপ্ত নম্বরে মাত্র ০ দশমিক ১ পার্থক্য থাকলেই কেউ সুযোগ পাচ্ছেন আবার কেউ ছিটকে পড়ছেন (অকৃতকার্য)। টিকে যাওয়া শিক্ষার্থীদের আমাদের এই একাডেমিক সমাজ মেধাবী বলছে, আর মেধাতালিকা থেকে ছিটকে যাওয়াকে তুলনামূলক কম মেধাবী বলে শ্রেণিকরণ করে বসছে। অধিকাংশ সময় দেখা যায়, এসব ভর্তি পরীক্ষায় টিকে যাওয়া শিক্ষার্থীরা মূল পরীক্ষায় ছিটকে পড়া শিক্ষার্থীর চেয়ে কম নম্বর পেয়েও মেধাক্রম স্কোরকে এগিয়ে নেন।

বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের উদাসীন ও বৈষম্যপূর্ণ আচরণের খেসারতে প্রতিবছর হাজারো মেধাবী শিক্ষার্থীরা কাঙ্ক্ষিত উচ্চশিক্ষালয়ে ভর্তি হতে ব্যর্থ হচ্ছেন। হাতে গোনা কয়েকটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ব্যতীত আমাদের দেশের অধিকাংশ বিশ্ববিদ্যালয়ে দুই দশকেরও বেশি সময় ধরে এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষায় প্রাপ্ত জিপিএ স্বয়ংক্রিয়ভাবে ভর্তি পরীক্ষার স্কোরে যোগ হচ্ছে। ফলে কম জিপিএ পাওয়া শিক্ষার্থী মূল ভর্তি পরীক্ষায় অনেক সময় বেশি নম্বর পেয়েও মেধা স্কোরে টিকতে পারছেন না। কিন্তু কেন এই নিয়ম, তার সুনির্দিষ্ট সন্তোষজনক ব্যাখ্যা আমি কোথাও পাইনি। বরং এসব জিপিএ স্কোর থাকার কারণে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো একটি নির্দিষ্ট গ্রুপকে উচ্চশিক্ষার সুযোগ করে দিচ্ছে। ফলে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ক্রমেই অসাড় হতে চলছে।

দেড় দশক আগেও যেখানে জিপিএ-৫ দশ হাজারের ঘরে থাকত, সেটি প্রায় ২০ গুণ বৃদ্ধি পেয়ে ঘরে ঘরে জিপিএ-৫ এ ঠেকছে, যা দেশের শিক্ষার মানকে সংকুচিতই করছে না, বরং রাষ্ট্রকে ভুল পথে পরিচালিত করার প্রয়াস জোগাচ্ছে। ব্যাপারটি এমন দাঁড়িয়েছে, পাবলিক পরীক্ষায় জিপিএ-৫ না পেলে তাঁকে ছাত্র হিসেবে গণ্যই করা হচ্ছে না। বিষয়টি আসলে সেদিকে যাওয়ার কথা ছিল না। জিপিএ-৫ কে যে বা যাহারা মেধার ওজনস্কেল মনে করছেন, তাঁরা হয়তো জানেন না, এই জিপিএ-৫ পাওয়া মানেই তুখোড় মেধাবী নয়। এটি কেবল একটি প্যারামিটার অথবা নির্দেশক হতে পারে, সেটি কিছুতেই একজন শিক্ষার্থীর মেধা যাচাইয়ের মাধ্যম হতে পারে না। সৃজনশীল চিন্তাধারায় বিশ্বাসী শিক্ষার্থী গড়ায় নজর না দিয়ে কেবল নিয়মতান্ত্রিক প্রশ্ন আয়ত্ত করে পরীক্ষার খাতায় উগরে দিয়ে জিপিএ-৫ বাগিয়ে নেওয়া গেলেও আমাদের শিক্ষার্থীরা কতটা কম জানেন, তা নিয়ে যেমন প্রশ্ন থাকছে, তেমনি দেশের বাইরে যখন উচ্চশিক্ষায় আসছেন তখন তাঁরা ঠিকই টের পাচ্ছেন।

জিপিএ-৫ যখন ক্রমেই আমাদের কাছে অভিশাপ হয়ে উঠছে, তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষার মানবণ্টনে পূর্ব থেকে সংরক্ষিত থাকায় আমাদের ছেলেমেয়েদের পড়াশোনার মানোন্নয়নের চেয়ে জিপিএ বাড়ানোয় প্রত্যক্ষভাবে উৎসাহ প্রদান করা হচ্ছে। ফলে যত্রতত্র জিপিএ-৫–এর ছড়াছড়িতে যখন বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় তাঁদের মধ্যেই অন্তত সাড়ে তিনজনের মতো প্রতিযোগিতায় লড়তে হচ্ছে, তখন অন্য জিপিএ পাওয়া শিক্ষার্থীরা তাঁদের দাপটে পেরে উঠছেন না।

এই ধরুন, মেডিকেল কলেজগুলোতে ভর্তি প্রক্রিয়ার কথা। প্রতিবছর দেশের নির্দিষ্টসংখ্যক পরীক্ষার্থীকে ভর্তি পরীক্ষায় অংশ গ্রহণের নিমিত্তে এসএসসি ও এইচএসসি জিপিএ স্কোর থাকার বাধ্যবাধকতা থাকলেও সেখানে মূল ভর্তি পরীক্ষার স্কোরের চেয়ে দ্বিগুণ স্কোর রাখা হয়েছে সেই জিপিএতে। ২০২০-২১ শিক্ষাবর্ষের ভর্তি বিজ্ঞপ্তি বলছে, মেডিকেলে ভর্তি পরীক্ষায় এসএসসিতে প্রাপ্ত জিপিএকে ১৫ গুণ, এইচএসসিকে ২৫ গুণ করে মোট জিপিএতে নম্বর রাখা হয়েছে ২০০। আর মূল ভর্তি পরীক্ষায় নম্বর রাখা হয়েছে মাত্র ১০০। মোট ৩০০ নম্বরের এই প্রতিযোগিতাপূর্ণ ভর্তি পরীক্ষায় কেউ যদি কেবল ভর্তি যোগ্যতার জন্য প্রাপ্ত এসএসসি এবং এইচএসসির জিপিএ–৯ (৪ দশমিক ৫ করে) হয়, তাহলে দেখা যাচ্ছে একজন শিক্ষার্থী জিপিএতে প্রাপ্ত ২০০ নম্বরের মধ্যে তাঁর থাকছে (৬৭ দশমিক ৫ + ১১২ দশমিক ৫) = ১৮০। অর্থাৎ মূল ভর্তি পরীক্ষায় জিপিএ–৫ প্রাপ্ত শিক্ষার্থীরা যদি ১০০ নম্বরের মধ্যে ৮২ নম্বর পান, তাহলে ওই শিক্ষার্থীকে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে হলে পেতে হবে ১০০ মধ্যে ১০২, যা কখনোই সম্ভব নয়। ঠিক কী কারণে, কারা নিয়ম চালু করেছেন, তা আমার কাছে বোধগম্য নয়, তবে মনে হচ্ছে, এটি শুধু বৈষম্যমূলক হঠকারী সিদ্ধান্ত নয়, বরং ভর্তি পরীক্ষায় ভালো করেও কেবল জিপিএর দোহাই দিয়ে অনেক মেধাবী শিক্ষার্থী টিকে থাকতে পারছেন না অথবা তাঁদের ছাড়া কেবল জিপিএ-৫ প্রাপ্ত শিক্ষার্থীদের মেডিকেল কলেজের উঠানে দেখতে চায় আমাদের রাষ্ট্র।

মেডিকেল ছাড়াও এই দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বিভিন্ন নিয়মের মারপ্যাঁচে স্কুল–কলেজের প্রাপ্ত জিপিএকে মেধা স্কোরে ঠাঁই দিচ্ছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা ১০০ মধ্যে হলেও এসএসসি ও এইচএসসিতে প্রাপ্ত জিপিএতে (দ্বিগুণ করে) রাখা হয়েছে ২০ নম্বর। অর্থাৎ ১২০ নম্বরের এই প্রতিযোগিতায় কেবল জিপিএ–৫ প্রাপ্তদের বোনাস হিসেবে এই ২০ নম্বর জোগাড় করতে একজন জিপিএ–৩ দশমিক ৫ প্রাপ্তকে ৬ নম্বর বেশি তুলতে হচ্ছে।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে মূল পরীক্ষায় ৮০ নম্বরের সঙ্গে ২০ নম্বর যোগ হয়েছে স্কুল–কলেজের জিপিএ। ২০২০-২১ শিক্ষাবর্ষের ভর্তি বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে এই বিশ্ববিদ্যালয়ে এসএসসি জিপিএকে ১ দশমিক ৫ গুণ এবং এইচএসসিতে ২ দশমিক ৫ গুণ করে মোট স্কোরে যোগ হয়ে মেধাক্রম নির্ণয় করা হচ্ছে।

গুচ্ছভিত্তিক যে ২০টি বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষা নিচ্ছে, তারাও এসএসসি ও এইচএসসি জিপিএকে ২ গুণ করে সেখানে ২০ নম্বর সংরক্ষিত রেখেছে। ফলে অনেকটাই ঘোষিত যে জিপিএ-৫ প্রাপ্ত এই ধরনের প্রতিযোগিতাপূর্ণ পরীক্ষায় বড় ধরনের সফলতা পাচ্ছে।
পাবলিক পরীক্ষায় বিভিন্ন কারণে একজন শিক্ষার্থীর ফলাফল খারাপ হতে পারে, তবে মেধায় সে খারাপ নয়। তবে আমাদের বর্তমান ভর্তি ব্যবস্থা সেই কম জিপিএ পাওয়া শিক্ষার্থীর মেধার যাচাই করতে ব্যর্থ হচ্ছে। জিপিএ-৫ না পাওয়া শিক্ষার্থীরাও কঠিন পরিশ্রম করেন, ভর্তি পরীক্ষায় ভালো করার চেষ্টা করলেও আমরা তাঁদের সুযোগ দিতে পারছি না।

অনেকেই প্রশ্ন করতে পারেন, তাহলে এসএসসি ও এইচএসসি জিপিএর মূল্যায়ন কী হবে? কেন একজন শিক্ষার্থী জিপিএ বেশি পাবে? কেন তার পরিশ্রমের মূল্যায়ন করা হবে না? এসব প্রশ্নের সরাসরি উত্তর হলো, জিপিএ মূল্যায়ন শুধু বাংলাদেশ নয়, বিশ্বের বিভিন্ন দেশই করা হয়। সেটি বাংলাদেশের মতো মেধা স্কোরে প্রভাব দেখিয়ে নয়, বরং সিংহভাগ বিশ্ববিদ্যালয় জিপিএকে মূল্যায়ন করে ভর্তি পরীক্ষায় আবেদনের যোগ্যতা হিসেবে, প্রাথমিক স্ক্রিনিংয়ের মানদণ্ড হিসেবে, আবার নির্দিষ্ট বিভাগে ভর্তি হওয়ার যোগ্যতার মাপকাঠি এসব জিপিএ। আর সেটিই হয়ে আসছে, বাংলাদেশ প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় বা বুয়েটে। তারা জিপিএকে দেখছে কেবল ভর্তি পরীক্ষায় আবেদন ও বিভাগগুলোতে ভর্তির যোগ্যতা হিসেবে।

জিপিএ-৫ যখন ক্রমেই আমাদের কাছে অভিশাপ হয়ে উঠছে, তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষার মানবণ্টনে পূর্ব থেকে সংরক্ষিত থাকায় আমাদের ছেলেমেয়েদের পড়াশোনার মানোন্নয়নের চেয়ে জিপিএ বাড়ানোয় প্রত্যক্ষভাবে উৎসাহ প্রদান করা হচ্ছে। ফলে যত্রতত্র জিপিএ-৫–এর ছড়াছড়িতে যখন বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় তাঁদের মধ্যেই অন্তত সাড়ে তিনজনের মতো প্রতিযোগিতায় লড়তে হচ্ছে, তখন অন্য জিপিএ পাওয়া শিক্ষার্থীরা তাঁদের দাপটে পেরে উঠছেন না।

ঠিক একই ধরনের নিয়ম অনুসরণ করে আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারতও তাদের বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজগুলোতে শিক্ষার্থীদের ভর্তি করায়। ওয়েস্ট বেঙ্গল জয়েন্ট ইন্ট্রান্স এক্সাম (ডব্লিউবিজেইই) অধীন প্রদেশটির বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজগুলোতে ২০২২-২৩ সেশনে স্নাতক ভর্তি পরীক্ষা হবে আগামী ২৩ এপ্রিল। আর ভর্তি পরীক্ষা হবে দুই ধাপে (গণিত; রসায়ন ও পদার্থ) ২০০ নম্বরের পরীক্ষায় প্রাপ্ত স্কোর থেকে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ভর্তি হওয়ার জন্য সেখানে স্পষ্ট করে বলা হয়েছে কেবল সেকেন্ডারিতে (দশম শ্রেণি) ও উচ্চ মাধ্যমে (দ্বাদশ শ্রেণি) ৪৫ শতাংশ মার্কস পেয়ে পাস করতে হবে। আর বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ভর্তি হতে গেলে ভর্তি পরীক্ষায় শতকরা ৬০ (কিছু ক্ষেত্রে ৫০ শতাংশ) ওপর থাকতে হবে। চুয়াল্লিশ পৃষ্ঠার এই ভর্তি বিজ্ঞপ্তিতে দেখতি পাইনি, স্কুল–কলেজে প্রাপ্ত ফলাফল বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তির মেধাতালিকায় কোনো প্রভাব ফেলবে।

একই ধরনের নিয়মের বলয়ে ভর্তি পরীক্ষা নেয় নেপাল। দেশটির বেশ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক পর্যায়ের ভর্তির প্রক্রিয়া তথ্য ঘেঁটে যা পেলাম, তা হলো দেশটি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নিতে হলে স্কুল–কলেজের ফলাফলে ন্যূনতম জিপিএ–ডি পেতে হবে আর ১০০ নম্বরের ভর্তি পরীক্ষায় প্রাপ্ত নম্বরই প্রার্থীর মেধাক্রম নির্ধারণ করবে।

আরও পড়ুন

শুধু ভারত বা নেপাল নয়, বিশ্বের সিংহভাগ বিশ্ববিদ্যালয় স্নাতক ভর্তি পরীক্ষায় পূর্বের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে প্রাপ্ত জিপিএ মূল ভর্তি পরীক্ষায় প্রাপ্ত স্কোরে ঢুকিয়ে দেয় না। অথচ আমাদের দেশে বছরের পর বছর এই বৈষম্যমূলক নিয়ম চালু রেখেছে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো। বিশ্ববিদ্যালয়ের মঞ্জুরি কমিশন কিংবা শিক্ষা মন্ত্রণালয় কেউ এই বিষয়টি নিয়ে কথা বলেনি। পরিষ্কার ভাষায় জানায়নি, আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো তাদের ভর্তি পরীক্ষায় ঠিক কেন জিপিএ কে প্রাধান্য দিয়ে মেধাক্রম সাজায়। এর মধ্য দিয়ে আমরা এক শ্রেণি শিক্ষার্থীদের সুবিধা প্রদান করছি, অন্যদিকে বঞ্চিত করছি কম জিপিএ প্রাপ্ত শিক্ষার্থীদের। অথচ এই উচ্চশিক্ষালয়গুলোতে প্রতিযোগিতা করার অধিকার সব শিক্ষার্থীদের হওয়া উচিত। যত বেশি ছেলেমেয়ে প্রতিযোগিতায় আসবে, সেখানে তত বেশি মেধার সম্ভার হওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হবে। মাঠে নামার আগেই যদি একপক্ষকে গোল দিয়ে দেওয়া হয়, তাহলে সেই খেলায় কখনো নিরপেক্ষতা থাকে না, বরং পক্ষপাত দুষ্টে ভরা থাকে। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ভর্তি পরীক্ষাগুলোতে সেটিই ঘটছে।

আমরা জিপিএ-৫ চাই না, জিপিএ–৪ চাই না, আমরা দেখতে চাই ভর্তি পরীক্ষায় কে, কতটা মেধাবী। এভাবে জিপিএ-৫ মুখী অন্তঃসারশূন্য প্রজন্ম আমরা দেখতে চাই না। সৃজনশীল প্রশ্নে গড়া ভর্তি পরীক্ষায় কতটা মেধার স্বাক্ষর রাখছে, তা বের করার দায়িত্ব বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে নিতে হবে। ভর্তি পরীক্ষার মূল মানবণ্টনে যদি এভাবে জিপিএ প্রভাব রাখা হয়, তাহলে আমাদের ছেলেমেয়েদের জিপিএ-৫ পাওয়ার যে অসুস্থ প্রতিযোগিতা, আমাদের অভিভাবকদের যে আকুতি, প্রশ্নব্যাংক চর্চায় জিপিএ বাড়ানোয় শিক্ষকদের স্বস্তির ঢেকুর আমাদের ভাবিয়ে তুলছে। এভাবে একটি দেশ কখনোই শিক্ষায় এগিয়ে যেতে পারে না।

এটি নিঃসন্দেহে পরিকল্পিত আত্মঘাতী পথ। আমি জিপিএ পাওয়াকে নিরুৎসাহী করছি না, আমি বলতে চাচ্ছি, আমাদের প্রকৃত মেধাবীদের বের করে আনার দায়িত্ব বিশ্ববিদ্যালয়গুলো নিক। তারা যে প্রতিযোগিতার ব্যবস্থা করে, সেই প্রতিযোগিতার আরও একটু আধুনিকায়নের সুযোগ নিক। এভাবে জিপিএ–নির্ভর মেধাবী যাচাইয়ের দায়িত্ব অন্তত বিশ্ববিদ্যালয়ের নয়। বরং সৃজনশীল ও মানসিক বিকাশে উদ্ভাসিত শিক্ষার্থীদের সামনে এনে আরও বেশি শাণিত করা হোক। এসএসসি ও এইচএসসি জিপিএ প্রভাবমুক্ত থাকুক আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষার মেধা স্কোর। জিপিএ হোক কেবল প্রাথমিক আবেদন যোগ্যতার মাপকাঠি। আমার বিশ্বাস, নীতিনির্ধারক পর্যায়ে যাঁরা আছেন কিংবা যাঁরা এই লেখাটি পড়েছেন তাঁদের মনে অন্তত একটি প্রশ্ন তৈরি হোক এবং আগামী ভর্তি পরীক্ষায় এই ধরনের বৈষম্য দূর হোক।

ড. নাদিম মাহমুদ জাপানের ওসাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক। [email protected]