বিশ্ব আজ বড় ধরনের এক পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে এগোচ্ছে। পশ্চিমা বিশ্বের প্রতিষ্ঠান ও মূল্যবোধের ওপর ভর করে বর্তমান বিশ্বব্যবস্থা দীর্ঘদিন ধরে চলছিল। বিশ্বায়ন ছিল তার পরিণত রূপ। ২০০৮ সালের বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দার পর বিশ্বব্যাপী অস্থিরতা বেড়েছে। জাতীয়তাবাদ, সামাজিক ও অর্থনৈতিক রক্ষণশীলতা, ধর্মীয় উগ্রবাদ বিভিন্ন দেশে জেঁকে বসছে ধীরে ধীরে। ফলে যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের মতো বিশ্বায়নের জোরালো সমর্থকেরাও এখন বিশ্বায়নবিরোধী অবস্থান নিয়েছে। অর্থনীতিকে রক্ষা করার নামে তারা বিশ্বায়ন ও অভিবাসনবিরোধী পদক্ষেপ নিচ্ছে। সেসব পদক্ষেপের প্রতি সামাজিক সমর্থনও সৃষ্টি হয়েছে। জনগণের আকাঙ্ক্ষা কাজে লাগিয়ে ক্ষমতায় চলে আসছেন রক্ষণশীল ধারার রাজনীতিকেরা। ফলে পপুলিজম বা জনতুষ্টিবাদী ধারা ক্রমশই বিশ্বব্যাপী শক্তিশালী হয়ে উঠছে। প্রতিচিন্তার ১৯তম সংখ্যায় এই বিষয়ে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।
বিশ্বায়নের পক্ষে-বিপক্ষে অসংখ্য যুক্তি রয়েছে। পুঁজিবাদবিরোধীরাই মূলত বিশ্বায়নবিরোধী হিসেবে পরিচিত। পুঁজির ধর্মই হচ্ছে ছড়িয়ে পড়া। ফলে যেখানে পুঁজি সৃষ্টি হবে, সেই পুঁজি নতুন নতুন স্থানে ছড়িয়ে পড়ার সুযোগ খুঁজতে থাকে। বর্তমানে চীন বা ভারতের মতো দেশে পুঁজি পুঞ্জীভূত হচ্ছে। তাই তারাই এখন বিশ্বায়নের সমর্থক হয়ে উঠছে। একসময় ঠিক এই ভূমিকা পালন করেছিল যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে পশ্চিমা বিশ্ব।
আগেই বলেছি, চীন, রাশিয়া ও ভারতের মতো দেশগুলোয় আমরা আবার ভিন্ন চিত্র দেখতে পাচ্ছি। এসব দেশের নেতারা সবাই যদিও জাতীয়তাবাদী দুয়ো তুলেই ক্ষমতায় এসেছেন, তাঁরা আবার নিজেদের দেশকে এমনভাবে বহির্মুখী করছেন এবং বৈশ্বিক কৌশল গ্রহণ করছেন, যা বিশ্বায়নের ধারণার ওপরই প্রতিষ্ঠিত। চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি উভয়েই বাণিজ্য, অর্থনীতি, আন্তর্জাতিক জোট গঠন ও তথ্যপ্রযুক্তির সর্বোত্তম ব্যবহারে মনোযোগ দিয়েছেন। এশীয় অবকাঠামো ও বিনিয়োগ ব্যাংক তৈরি, এক অঞ্চল বা সিল্ক রোড উদ্যোগ, আঞ্চলিক সামগ্রিক অর্থনৈতিক অংশীদারি ইত্যাদি সবই বিশ্বায়নের দিকে চীনের ঝুঁকে পড়ার নিদর্শন। বৈশ্বিক এসব পরিবর্তনের সঙ্গে বাংলাদেশ তাল মিলিয়ে চলার চেষ্টা করছে। নতুন নতুন এসব সুযোগ গ্রহণে বাংলাদেশের সক্ষমতার বিষয়ে তাই আরও আলোচনা-পর্যালোচনা হওয়া দরকার।
আমাদের মতো উন্নয়নশীল সমাজে মাদ্রাসা ও ইংরেজি মাধ্যমের শিক্ষাব্যবস্থা রাষ্ট্রীয় তত্ত্বাবধানে পরিচালিত মূলধারার শিক্ষাব্যবস্থা থেকে ভিন্ন। ফলে তৈরি হচ্ছে বিরোধপূর্ণ মানসিকতার নাগরিক শ্রেণি, যারা মননের দিক থেকে একে অপরের চেয়ে সম্পূর্ণ ভিন্ন। প্রতিটি ধারাই বিশ্বায়ন দ্বারা প্রভাবিত এবং ক্রমে সক্রিয় হচ্ছে। তাই সামাজিক দ্বন্দ্ব ধীরে ধীরে বেড়ে চলেছে।
মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠানগুলো, বিশেষ করে কওমি মাদ্রাসাগুলোর আবদ্ধ পরিবেশে ইসলামভিত্তিক জঙ্গিবাদের বিস্তার ঘটে থাকে বলে মত চালু রয়েছে। সম্প্রতি কওমি মাদ্রাসাগুলোকে সমাজের মূলধারায় অন্তর্ভুক্ত করতে বর্তমান সরকার এসব প্রতিষ্ঠানভিত্তিক সংগঠন হেফাজতে ইসলামের সঙ্গে একধরনের সমঝোতা করেছে। এই প্রেক্ষাপটে মাদ্রাসাশিক্ষার প্রকৃতি ও পদ্ধতি এবং এসব মাদ্রাসাভিত্তিক ওলামাদের সংস্কারবিমুখতা নিয়ে লিখেছেন আলী রীয়াজ। এসব প্রতিষ্ঠানের ওলামারা কেন মাদ্রাসাশিক্ষার সংস্কার ও আধুনিকায়নে বরাবরই বাধা দিয়ে এসেছেন, তার কারণ ও ব্যাখ্যা পাওয়া যাবে এই লেখায়।
ব্যাংকিং ব্যবস্থা বিশ্বায়নের ধারণার সঙ্গে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে আছে। বৈশ্বিক পুঁজি ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে ব্যাংকিং ব্যবস্থার ভূমিকাই মুখ্য। তাই বিশ্বায়নের সংকটের সঙ্গে ব্যাংকিং ব্যবস্থার প্রত্যক্ষ সংযোগ রয়েছে। সে জন্য বিশ্বায়নের সমালোচনার পাশাপাশি ব্যাংকিং ব্যবস্থায় নৈতিকতার প্রশ্নটিও সামনে চলে আসে। নৈতিকতার দৃষ্টিকোণ থেকে ব্যাংকিং ব্যবস্থাকে দেখার উদ্দেশ্য নিয়ে প্রতিচিন্তার এবারের সংখ্যায় ভারতের বিশিষ্ট রাজনৈতিক অর্থনীতিবিদ অমিয় কুমার বাগচির একটি নিবন্ধ ছাপা হয়েছে।
২০১৫ সালে স্থলসীমান্ত চুক্তি স্বাক্ষরিত হওয়ার ফলে ছিটমহলের মানুষের দীর্ঘদিনের রাষ্ট্রহীনতার অবসান ঘটে। কিন্তু তারপরও কিছু সমস্যা যেমন রয়েই গেছে, তেমনি যোগ হয়েছে নতুন করে আরও কিছু সমস্যা। অনেকে আবার নাগরিকত্বও পাননি। এসব সমাধানকল্পে ছিটমহলের সমস্যা ও সংকট নিয়ে এই সংখ্যায় আলোচনা করেছেন মোহাম্মদ গোলাম রব্বানী।
বদরুল আলম খানের লেখায় বিশ্বায়নের ধারণা যে বহুল আলোচিত ও বিতর্কিত বিষয়, তা ধরা পড়েছে। বিশ্বায়নের ইতিহাস টেনে এনে তিনি বর্তমানকালের বিশ্বায়নের গতি-প্রকৃতি বোঝার চেষ্টা করেছেন। অর্থনৈতিক বিশ্বায়নের সঙ্গে সঙ্গে বিশ্বায়নের ফলে সৃষ্ট আত্মপরিচয়ের সংকট, সংস্কৃতির উচ্ছেদ, ক্ষমতাকাঠামোর মতো ক্ষমতার রাজনীতি ও সামাজিক পরিবর্তনের ফলে গড়ে ওঠা নানামুখী ধারার মধ্যে দ্বন্দ্ব-কলহ উঠে এসেছে এই প্রবন্ধে।
প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ জোসেফ স্টিগলিৎস বিশ্বায়নের অনেক বিষয়ে খোলামেলা সমালোচনা করেছেন। বিশ্বব্যাংকের সাবেক সহসভাপতি ও প্রধান অর্থনীতিবিদ স্টিগলিৎস তাঁর মেকিং গ্লোবালাইজেশন ওয়ার্ক গ্রন্থে বিশ্বায়নকে আরও কার্যকর করার ওপর জোর দিয়েছেন। বিশ্বায়ন নিয়ে ধনী ও গরিব দেশগুলোর মধ্যে দ্বন্দ্বের একটি বড় কারণ বাণিজ্য ও মেধাসম্পদ। এ দুই বিষয়ে কীভাবে উন্নত নীতি ও প্রতিষ্ঠান তৈরির মাধ্যমে বিশ্বায়নকে আরও বেশি কার্যকর করা যায়, এই বইয়ের আলোকে সেই আলোচনাই করেছেন প্রতীক বর্ধন।
বিশ্বায়নের উল্টোরথ বিবেচনায় রেখে, বিশ্বায়নের পক্ষের মৌলিক যুক্তিগুলোয় পুনরায় দৃষ্টিপাত করতে হবে। এর ফলে বর্তমান বিশ্বে বিশ্বায়নবিরোধী যে ধারা সৃষ্টি হয়েছে, তা পাঠকের জন্য বোঝা সহজতর হবে। বিশ্বায়নের অন্যতম প্রবক্তা জগদীশ ভাগবতী তাঁর ইন ডিফেন্স অব গ্লোবালাইজেশন গ্রন্থে বিশ্বায়ন-বিরোধিতার জবাবগুলো বিভিন্ন বিষয়ের আলোকে ব্যাখ্যা করেছেন। সেসব যুক্তির আলোকে বইটি আলোচনা করেছেন খলিলউল্লাহ্। বিশ্বায়নের বিরুদ্ধে যেসব যুক্তি দেওয়া হয়, তার অনেকগুলোই যথাযথ। সেগুলো কীভাবে মোকাবিলা করা যায়, সেটাই বিশ্বায়নের ভবিষ্যতের জন্য সবচেয়ে বড় প্রশ্ন। খলিলউল্লাহ্ এই আলোচনায় এই বিষয়টির ওপরই বেশি আলোকপাত করেছেন।
আশা করি, পাঠক বিশ্বায়নকে ঘিরে প্রতিচিন্তার এই আয়োজন সাধুবাদ জানাবেন। ভবিষ্যতেও এমন ধরনের বিশেষ সংখ্যা করার পরিকল্পনা ও ইচ্ছে রইল, যদি পাঠক হিসেবে আপনাদের সঙ্গে পাই। এ সংখ্যাটি একটু দেরিতে প্রকাশিত হওয়ার জন্য দুঃখিত।
খন্দকার সাখাওয়াত আলী: সমাজতত্ত্ববিদ ও গবেষক, নির্বাহী সম্পাদক, প্রতিচিন্তা।