বিষাক্ত গরু থেকে সাবধান

আর মাত্র দিন দশেক পর পবিত্র ঈদুল আজহা। তখন প্রায় সোয়া কোটি গবাদিপশু কোরবানি হবে। কোটি কোটি ধনী-দরিদ্র মানুষের খাদ্যতালিকায় যুক্ত হবে কোরবানির মাংস। কিন্তু গরুকে অস্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় মোটাতাজা করে অতি মুনাফা অর্জনের লক্ষেয স্টেরয়েড গ্রুপভুক্ত ডাইক্লোফেনাক, ওরাডেক্সন, স্টেরন, ডেক্সাসন, এডাম কোরটান, কোরটিজল, হাইড্রো কোরটিজল ইত্যাদি ওষুধ এবং অতিরিক্ত ইউরিয়া খাওয়ানো হয়। এসব গরুর মাংস মানুষের স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর।

স্টেরয়েড ব্যবহারে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের বৈজ্ঞানিক ফর্মুলা ও নির্দেশনা প্রতিপালিত না হওয়ায় ডেইরি সেক্টর ঝুঁকির মধ্যে পড়েছে। এই সেক্টরে সুশাসনের শর্ত গবাদিপশুর প্রতিষেধক মেয়াদোত্তীর্ণ কি না, যথাযথভাবে সংরক্ষিত কি না, গো-খাদ্য সঠিক মানের কি না, তা নিশ্চিত করা। কোনটি অপরাধ, কোনটি অপরাধ নয়, তার উপলব্ধির জন্য তিনটি বিষয়ে যেমন পর্যাপ্ত জ্ঞান, প্রশিক্ষণ এবং আইনের অনুশাসন অপরিহার্য। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির যত উন্নতি হচ্ছে, মানুষের তত নৈতিক অধঃপতন ঘটছে। তার প্রমাণ, মুনাফার নেশায় বিবেকহীনভাবে স্টেরয়েডের ব্যবহার। ভাষাহীন, প্রতিবাদহীন ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকা অবুঝ পশুগুলো এভাবে বিবেকহীন মানুষের কাছে অসহায়।

কৃত্রিমভাবে মোটাতাজা করা গরুর মাংস অবশ্যই দূষিত এবং ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকেও কাঙ্ক্ষিত নয়। কারণ, কোরবানির অন্যতম শর্ত, সুস্থ ও সবল গরু। এই বিষ মাংসের পুষ্টিগুণ ক্ষতিগ্রস্ত করে। মাংসের এই বিষ দীর্ঘ সময়ের রান্নাতেও নষ্ট হয় না। বিষযুক্ত মাংস খেলে খাদ্যচক্রের অনিবার্য প্রতিক্রিয়ায় তার প্রভাব পড়ে মানুষের কিডনি, লিভার, হার্টসহ অন্যান্য অঙ্গপ্রত্যঙ্গে। গর্ভবতী নারীর হরমোন ভারসাম্যও নষ্ট হয়। মানুষের প্রাকৃতিক রোগ প্রতিরোধব্যবস্থা দূষিত খাদ্যে ধ্বংস হয়ে যায়। বিষাক্ত মাংসে শরীর রোগাক্রান্ত হচ্ছে, চিকিৎসার ব্যয় অর্থনৈতিক ক্ষতি বাড়াচ্ছে।

কোরবানির আগে মোবাইল কোর্ট, প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর, নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ, সিটি করপোরেশন ও পৌর কর্তৃপক্ষগুলোকে এখনই মাঠে নামতে হবে। মোবাইল কোর্ট আইন, ২০০৯-এর ১০২ নম্বর তফসিলে ‘মৎস্য খাদ্য ও পশু খাদ্য আইন-২০১০ ’-এ এটি অন্তর্ভুক্ত। এ আইনের ১২ (১) (ক) ধারামতে, মত্স্য বা পশু-খাদ্যে মানুষ, পশু, মত্স্য বা পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর পদার্থ থাকলে এবং একই আইনের ১২ (১) (খ) ধারা অনুযায়ী ওই খাদ্যমান আদর্শ মানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক হলে, তা অপরাধ। একই আইনের ১৪ (১) ধারার মত্স্য ও পশু-খাদ্য হিসেবে অ্যান্টিবায়োটিক, গ্রোথ হরমোন, স্টেরয়েড, কীটনাশকসহ অন্যান্য ক্ষতিকর রাসায়নিক দ্রব্য ব্যবহার নিষিদ্ধ। এ ছাড়া জীবজন্তুর প্রতি নিষ্ঠুরতা আইন, ১৯২০ অনুযায়ী নিরাময় অযোগ্য রোগাক্রান্ত পশু ধ্বংসে ম্যাজিস্ট্রেট ক্ষমতাপ্রাপ্ত।

২০০৯ সালে বাংলাদেশে জনস্বার্থে বার্ড ফ্লু সংক্রমিত লাখ লাখ মুরগি ধ্বংস করা হয়েছিল। যুক্তরাজ্যে ১৯৮৮ সালে ম্যাড কাউ ডিজিজ উদ্ঘাটিত হলে বিপুলসংখ্যক গরু মেরে ফেলা হয়। অননুমোদিত স্টেরয়েড-জাতীয় ওষুধ বিক্রি বন্ধে প্রতিটি জেলায় মোবাইল কোর্টকে মাঠে নামানোর জন্য সব জেলা প্রশাসককে আহ্বান জানাচ্ছি। স্টেরয়েডের অভিশাপ থেকে কোরবানির গরুকে মুক্ত করা প্রশাসনের আইনি এবং নৈতিক দায়িত্ব। পাশাপাশি গরুর জেনেটিক মান উন্নত করা এবং বিদেশ থেকে উৎকৃষ্ট মানের সিমেন আমদানি নিশ্চিত করতে হবে।

এ ছাড়া সীমান্তপথে বৈধ পশু আমদানিকালে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর, বিজিবি ও মোবাইল কোর্টের সাহায্যে কিট ব্যবহার করে রক্ত ও হরমোন পরীক্ষা নিশ্চিত করতে হবে। রাসায়নিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা ছাড়া অভিযান অর্থহীন। স্যাটেলাইটে তোলা ছবি এখন ২০ মিনিটেই পাচ্ছে পৃথিবী, প্রযুক্তির পর্যবেক্ষণে যেকোনো বিষয়ে তথ্য-উপাত্ত পাওয়া কত সহজ। সুতরাং প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরকে প্রযুক্তিগত উৎকর্ষ নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে। গরুতে স্টেরয়েড বা ক্ষতিকর ওষুধের উপস্থিতি প্রমাণের জন্য প্রয়োজনীয় সফটওয়্যার, কিট ও আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করতে হবে। অপরাধ প্রমাণিত হলে শুধু জেল-জরিমানা নয়, ফৌজদারি কার্যবিধি ১৮৯৮-এর ৫১৬ থেকে ৫২৫ ধারার আলোকে বিষাক্ত গরু জব্দ করে ধর্মীয় বিধি মোতাবেক জবাই করে তা নিরাপদ স্থানে পুঁতে ফেলতে হবে।

ভেজাল খাদ্য ধ্বংসের মতো বিষাক্ত গরু ধ্বংস না করলে এ অপরাধ বন্ধ হবে না। কারণ, জেল-জরিমানার সমান্তরালে অসাধু ব্যবসায় সম্পৃক্ত পণ্য জব্দ বা ধ্বংসের অর্থনৈতিক ক্ষতি অপরাধের পুনরাবৃত্তি রোধে সহায়ক। পাশাপাশি দীর্ঘদিনের শ্রম, ঘাম ও অর্থে লালিত পশু বাজারজাত করার জন্য সৎ খামারিদের প্রণোদনা দিতে হবে। নির্ভেজাল পশু খাদ্যনিরাপত্তার অপরিহার্য অনুষঙ্গ, সংবিধানের ১৫ অনুচ্ছেদে এর নির্দেশনা আছে। তবে কোরবানিতে সুস্থ, সবল গরু নিশ্চিত করা সরকারের একক কর্তব্য নয়। একশ্রেণির উচ্চাভিলাষী মানুষ বড় আকৃতির মোটাতাজা গরু কিনে কোরবানিকে ভোগের উৎসব এবং প্রদর্শনের প্রতিযোগিতায় পরিণত করেছেন। ভোক্তারা সৎ ও সচেতন না হলে ঘরে ঘরে গিয়ে আইন প্রয়োগ করা সম্ভব নয়। হৃষ্টপুষ্ট গরুতে কোরবানির সার্থকতা নয়, অসৎ উপার্জনের অর্থে কোরবানির শুদ্ধতা নয়। ক্রয়-বিক্রয়ে সততা, লেনদেনে শুদ্ধতা এবং জীবনাচরণে নৈতিকতা ছাড়া সব আয়োজনই বৃথা। অহংকার, অনাচার ও আত্মম্ভরিতা বর্জনই স্রষ্টার নির্দেশিত কোরবানির শিক্ষা।

মোহাম্মাদ মুনীর চৌধুরী: দুর্নীতি দমন কমিশনের মহাপরিচালক
mmunirc@gmail. com