বিষ দিয়ে মারা বন্ধ না করলে নাই হয়ে যাবে দেশি মাছ

ফাইল ছবি

রংপুরের মিঠাপুকুর উপজেলার শালমারা নদীর গভীর অংশে বিষাক্ত ওষুধ দিয়ে মাছ ধরেন স্থানীয় এক লোক। এভাবে শিকার করা মাছ স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। তা ছাড়া ওষুধ প্রয়োগে যখন মাছ ধরা হয়, তখন মাছসহ ছোট ছোট পোকা পর্যন্ত মারা যায়। জীববৈচিত্র্যেরও মারাত্মক ক্ষতি হয়। তাই এভাবে মাছ ধরা বন্ধ করতে মিঠাপুকুর থানায় লিখিত অভিযোগ করে শালমারা নদী সুরক্ষা কমিটি। কমিটির আহ্বায়ক শাহজালাল জানালেন, আর কখনো ওষুধ প্রয়োগে মাছ শিকার করবেন না, এই মর্মে স্থানীয় সালিসে মুচলেকা দিয়েছেন ওই ব্যক্তি।

নীলফামারী জেলার ডোমার উপজেলার একটি নদী দেওনাই (হরিণচড়া-লক্ষ্মীচাপ)। এটি মূল দেওনাইয়ের শাখা এবং বুড়িখোড়ার উপনদী। দুই বছর আগে নদীটি আমরা দখলদারদের হাত থেকে মুক্ত করি। সেখানেও এখন রাতে বিষাক্ত ওষুধ প্রয়োগ করে মাছ শিকার করে একশ্রেণির অসাধু ব্যক্তি। দেওনাই নদী সুরক্ষা কমিটির আহ্বায়ক আবদুল ওয়াদুদ বিষয়টি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা এবং সহকারী ভূমি কমিশনারকে জানিয়েছেন। আবদুল ওয়াদুদ ফোনে দুঃখ করে বললেন, ‘এই জন্য নদীটা উদ্ধার করলাম!’

গত বছর কুড়িগ্রাম জেলার রাজারহাট উপজেলার চাকিরপশার নদে প্রায় একই ঘটনা ঘটেছিল। সেখানে যারা নদী সাব–লিজ নিয়েছিল, তারা মাছের অভয়াশ্রমে ওষুধ প্রয়োগ করে মাছ ধরেছিল। স্থানীয় ব্যক্তিরা থানা এবং উপজেলা মৎস্য বিভাগে লিখিত অভিযোগ করেছিল। কিন্তু অভিযুক্ত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে কোনো আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি।

আমাদের জলমহাল ব্যবস্থাপনা নীতিমালায় প্রকৃত মৎস্যজীবীদের জলমহাল বন্দোবস্ত দেওয়ার কথা থাকলেও বাস্তবে সেগুলো পায় অমৎস্যজীবী প্রভাবশালী মহল। সরকারের বিভিন্ন কর্মকর্তা অমৎস্যজীবীদের এই বন্দোবস্ত দিয়ে থাকেন। অমৎস্যজীবীদের বন্দোবস্ত বাতিলসহ চাকিরপশার নদটি সুরক্ষার দাবিতে গত বছর আমরা কুড়িগ্রাম প্রেসক্লাবে একটি সংবাদ সম্মেলন করেছিলাম। সেখানে এক সাংবাদিক বলছিলেন, সারা দেশেই তো বিল লিজ নেয় প্রভাবশালীরা। আসলেই তাই। প্রকাশ্যে মৎস্যজীবীদের অধিকার কেড়ে খাচ্ছে অসাধু কিছু ব্যক্তি। কোনো প্রতিকার নেই।

অধিক পুষ্টিগুণসমৃদ্ধ সুস্বাদু দেশি মাছ রক্ষা করতে হলে বিষ প্রয়োগে মাছ শিকারের বিরুদ্ধে কঠোর হতেই হবে। দেশি মাছ ধ্বংস করা বন্ধ হওয়া জরুরি। সরকারি খাল-বিল-জলাশয়-পুকুর অমৎস্যজীবীদের যাঁরা লিজ দেন, তাঁদেরও জবাবদিহির আওতায় আনা প্রয়োজন

ফেব্রুয়ারিতে চাঁপাইনবাবগঞ্জের গোমস্তাপুর গিয়েছিলাম। সেখানে চরলবিল নামে ৭৭২ একরের একটি বিল আছে। এই বিলের পাশে প্রায় পাঁচ শ মৎস্যজীবী পরিবার আছে। বিলটা এরা লিজ নিতে পারে না। লিজ নেন প্রভাবশালী কয়েকজন ব্যক্তি। লিজগ্রহীতা কয়েকজনের সঙ্গে কথাও হলো। তাঁদের যুক্তি, এত বড় বিল লিজ নেওয়ার সামর্থ্য মৎস্যজীবীদের নেই। তাই তাঁরা নিয়েছেন। অতীতে স্থানীয় মৎস্যজীবীরা বংশপরম্পরায় এখানে মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করতেন। এখন আর তাঁদের মাছ ধরার অধিকার নেই। ‘জাল যার জলা তার’ বদলে গিয়ে সারা দেশে এখন ‘ক্ষমতা যার জলা তার’ হয়েছে।

সরেজমিন অনুসন্ধান করে জেনেছি, দেশে অসংখ্য নদী-বিল-খাল-পুকুর অমৎস্যজীবীরা বন্দোবস্ত নিয়ে মাছ চাষ করছেন। লিখিত অভিযোগ দিলেও বন্দোবস্ত বাতিলের ব্যবস্থা প্রশাসন শিগগির করে না। মৎস্যজীবীদের পক্ষে দাঁড়ানোর মতো কোনো কর্মকর্তা তেমন একটা দেখা যায় না। সব ডিসি কিংবা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে হয়তো একই মানদণ্ডে মূল্যায়ন করা ঠিক হবে না। তারপরও দেশে এমন কোনো জেলা পাওয়া যাবে কি না সন্দেহ, যেখানে এই অনিয়ম হয়নি। শোনা যাচ্ছে চাকিরপশার নদ থেকে অমৎস্যজীবীদের বন্দোবস্ত বাতিলের উদ্যোগ নিচ্ছে জেলা প্রশাসন। সারা দেশে এ উদ্যোগ গ্রহণ জরুরি।

অমৎস্যজীবীদের লিজ দেওয়ার অনেকগুলো অসুবিধা। প্রথমত, প্রকৃত মৎস্যজীবীরা পেশাচ্যুত হচ্ছেন। অথচ অন্য কোনো পেশায় তাঁরা অভ্যস্ত নন। ফলে অবর্ণনীয় কষ্টে তাঁদের দিন কাটে। অমৎস্যজীবীরা কখনোই মাছের বংশবৃদ্ধির কথা মাথায় নেন না। তাঁরা শুধু মুনাফা খোঁজেন। ওষুধ প্রয়োগে মাছ ধরে মাছের বংশ নাশ করেন তাঁরা। জলমহাল কিংবা পুকুর বন্দোবস্ত হয় এপ্রিলের ১৪ তারিখ অর্থাৎ পয়লা বৈশাখ। চৈত্র মাসে যাঁদের লিজের মেয়াদ শেষ হয়, তাঁরা বৈশাখে নতুন বন্দোবস্ত হওয়ার আগে বিলের সব মাছ তুলে নেন। ওষুধ প্রয়োগ করে হলেও শেষ মাছটি পর্যন্ত তাঁদের ধরা চাই।

এভাবে সারা দেশে দেশি মাছ ধ্বংস করার একটি উৎসব চলছে। জলমহাল কিংবা পুকুর যদি প্রকৃত মৎস্যজীবী গ্রহণ করতেন, তাহলে অন্তত বিষজাতীয় ওষুধ প্রয়োগে মাছ ধরার কথা তাঁরা চিন্তা করতেন না। আর যদি মৎস্যজীবীরাও এ কাজ করেন, তাঁদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নিতে হবে। বর্তমান বিষ প্রয়োগে মাছ ধরার বিরুদ্ধে খুব অল্প ক্ষেত্রেই প্রতিবাদ হয়। প্রতিবাদ হলেও প্রতিকারের কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয় না।

শুধু যে সরকারি খাল-বিল-জলাশয় কিংবা পুকুরেই এসব ঘটছে তা নয়। বড় নদীতে অনেক বড় বড় কোলা পড়ে। কোনো কোনো কোলা হয় অনেক গভীর। এগুলো লিজ হয় না। এগুলোতে মৎস্যজীবীরা মাছ শিকার করে জীবিকা নির্বাহ করেন। নদীর এ রকম কিছু কিছু কোলা মাছের অভয়াশ্রম ঘোষণা করা প্রয়োজন। এসব কোলায় প্রচুর মা মাছ থাকে। এই মা মাছ এবং পোনা মাছ মৎস্যজীবীরা ধরে বাজারে বিক্রি করেন। এসব কোলা মাছের জন্য নিরাপদ করা সম্ভব হলে মাছের বংশবিস্তার দ্রুত হবে। সম্প্রতি কুড়িগ্রাম জেলার দুধকুমার নদের এমন একটি কোলায় গিয়েছিলাম। প্রথম আলোর কুড়িগ্রাম প্রতিনিধি সফি খান সেখানে নিয়ে গিয়েছিলেন। প্রথম আলোর চরের পাশে সেই কোলায় ইলিশ মাছের পোনাসহ অসংখ্য ছোট ছোট পোনা ধরা পড়ছে। আবার মা মাছও ধরা পড়ছে।

অধিক পুষ্টিগুণসমৃদ্ধ সুস্বাদু দেশি মাছ রক্ষা করতে হলে বিষ প্রয়োগে মাছ শিকারের বিরুদ্ধে কঠোর হতেই হবে। দেশি মাছ ধ্বংস করা বন্ধ হওয়া জরুরি। সরকারি খাল-বিল-জলাশয়-পুকুর অমৎস্যজীবীদের যাঁরা লিজ দেন, তাঁদেরও জবাবদিহির আওতায় আনা প্রয়োজন। বিশেষত কর্মকর্তাদের মধ্যে যাঁরা অমৎস্যজীবীদের মৎস্যজীবী হিসেবে নিবন্ধনের ব্যবস্থা করেন, তাঁদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে। অন্যথায় আমাদের দেশি মাছ যেগুলো এখনো অবশিষ্ট আছে, সেগুলোও নির্মূল হবে।

তুহিন ওয়াদুদ বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের শিক্ষক এবং নদী রক্ষাবিষয়ক সংগঠন রিভারাইন পিপলের পরিচালক

[email protected]