বিয়ে হোক বিনা যৌতুকে

ওপরের লাইনগুলো বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রচিত ‘হৈমন্তী’ গল্প থেকে নেওয়া।

আজ থেকে ১০০ বছরেরও বেশি সময় আগে ১৯১৪ সালে গল্পটি প্রথম ছাপা হয়। এই গল্পে রবীন্দ্রনাথ বাঙালি সমাজের যে কদর্য পণ বা যৌতুকপ্রথার কথা তুলে ধরেছিলেন, তা ১০০ বছর পরও বিদ্যমান। হৈমন্তী গল্পের হৈমন্তীর মতো এখনো এ দেশের নারীরা যৌতুকপ্রথার শিকার হচ্ছেন। দাবিমতো যৌতুক দিতে না পারায় নারীরা নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন। তাঁদের সংসার ভেঙে যাচ্ছে। অনেকে খুন হচ্ছেন। নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে অনেকে আত্মহত্যার পথ বেছে নিচ্ছেন।

গত বছরের ১৬ ডিসেম্বরের ঘটনা। মুন্সিগঞ্জের টঙ্গিবাড়ী উপজেলার সলিমাবাদ গ্রামে সোহানা বেগম নামের এক গৃহবধূকে কাঁচি দিয়ে আঘাত করে মাথা ফাটিয়ে দেন তাঁর স্বামী ওমর ফারুক। গৃহবধূটির অপরাধ—স্বামীর চাহিদামতো ৫০ হাজার টাকা বাবার বাড়ি থেকে এনে দেননি। ওমর ফারুক ও সোহানার তিন বছর আগে পারিবারিকভাবে বিয়ে হয়। বিয়ের সময় কনেপক্ষ যৌতুক হিসেবে নগদ এক লাখ টাকা, এক ভরি স্বর্ণালংকার ও আসবাব বরপক্ষকে দেয়। কিন্তু তাতে মন ভরে না বরপক্ষের। তাঁদের আরও চাই। আর তা আদায়ের জন্য তারা আশ্রয় নেয় স্ত্রী নির্যাতনের।

চলতি মে মাসের ঘটনা। মাদারীপুর জেলার রাজৈর পৌরসভার কুঠিবাড়িতে বাবার বাড়ি থেকে যৌতুকের টাকা এনে না দেওয়ায় শিউলি বেগম (২৮) নামে এক গৃহবধূর কান কেটে নেন স্বামী, ভাশুর ও জা।

গত এপ্রিল মাসে পটুয়াখালীর বাউফল উপজেলার কালাইয়া ইউনিয়নের কপূরকাঠী গ্রামে যৌতুকের জন্য খুন করা হয়েছে খালেদা বেগম (৩০) নামের এক গৃহবধূকে। গত জানুয়ারি মাসে ঢাকার কেরানীগঞ্জে দাবিমতো যৌতুক না পেয়ে নূরজাহান শান্তা (২২) নামের এক গৃহবধূকে শ্বাসরোধ করে হত্যা করেন স্বামী ও তাঁর পরিবারের লোকজন।

এ রকম অনেক উদাহরণ দেওয়া যাবে। এর যেন কোনো শেষ নেই। দেখেশুনে মনে হচ্ছে, দেশের সবাই ভয়াল এই সামাজিক ব্যাধিতে আক্রান্ত। দিনে দিনে এই ব্যাধির বিস্তার ঘটছে। ইউএনডিপির এক গবেষণায় বলা হয়েছে, বাংলাদেশে ৫০ শতাংশ বিবাহিত নারী যৌতুকের কারণে শারীরিক অথবা মানসিক নির্যাতনের শিকার হন। বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের তথ্যমতে, ২০১৫ সালে যৌতুকের কারণে খুন হয়েছেন ২৩৬ জন নারী। ২০১৪ সালে খুন হয়েছেন অন্তত ২৪১ জন নারী।

আমাদের দেশে কি বিত্তশালী পরিবার কি নিম্নবিত্ত—সব পরিবারেই মেয়েদের পাত্রস্থ করতে হলে যৌতুক দিতে হয়। অনেকে অবশ্য যৌতুককে যৌতুক না বলে ‘উপহার’ হিসেবে অভিহিত করেন। আমাদের দেশে যৌতুক দুই ধরনের। একটা এককালীন। অর্থাৎ বিয়ের সময়ই যৌতুক দিয়ে দেওয়া হয়। আরেক ধরনের যৌতুক হচ্ছে সারা জীবন ধরে দিয়ে যেতে হয় কনেপক্ষকে। এর কোনো শেষ থাকে না। মেয়ের সুখের কথা ভেবে কনেপক্ষও যৌতুক দিতে থাকেন। মেয়ের জামাইয়ের বিদেশ যাওয়া উপলক্ষে যৌতুক। জামাইয়ের বোনের বিয়ে উপলক্ষে যৌতুক। জামাইয়ের চাকরির জন্য মোটা অঙ্কের ঘুষ দিতে হবে, সে জন্য চাই যৌতুক। জামাই ব্যবসা করবেন, পুঁজি লাগবে—চাই যৌতুক। অর্থাৎ যেকোনো সময় যৌতুক লাগবে। এ জন্য কনেপক্ষকে তা দেওয়ার জন্য সব সময় প্রস্তুত থাকতে হবে।

কী থাকে না যৌতুকের তালিকায়! নগদ অর্থ, ফ্রিজ, টেলিভিশন আলমারি, খাট, ড্রেসিং টেবিল, গাড়ি, বাড়ি, জমি মোটরসাইকেল, মুঠোফোন—মোটামুটি সবই থাকে এই তালিকায়। মেয়ে দেখতে-শুনতে ও যোগ্যতায় যেমনই হোক না কেন, বরপক্ষকে যৌতুক দিতেই হবে। তবে মেয়ের গায়ের রং যদি চাপা হয় বা শারীরিক কোনো ত্রুটি থাকে বা হৈমন্তীর বয়সের মতো বেশি হয়, তাহলে যৌতুকের পরিমাণও বেড়ে যাবে। যৌতুক দেওয়ার সামর্থ্য না থাকায় অনেক মা-বাবা তাঁদের মেয়েদের বিয়ে দিতে পারছেন না। এই যৌতুকপ্রথার কারণেই বিশেষ করে দরিদ্র পরিবারগুলোতে মেয়েসন্তান অনাকাঙ্ক্ষিত।

>যেসব পুরুষ যৌতুক নিয়ে বিয়ে করতে চাইবেন, নারীরা তাঁদের প্রত্যাখ্যান করুন। তাঁদের কোনো অবস্থাতেই বিয়ে করবেন না। কারণ, তাঁরা আর যা-ই হোক, ভালো মানুষ নন

পুরুষেরা কেন যৌতুক নেন? তাঁদের কি এতটুকু লজ্জা করে না? না লজ্জা করবে কেন, অর্থ উপার্জনের এর চেয়ে সহজ উপায় আর কী হতে পারে! আমাদের দেশের অনেক তথাকথিত সুপাত্র এভাবে যৌতুক নিয়ে বড় লোক হওয়ার চিন্তা করেন। তাঁদের পছন্দের পাত্রীর তালিকায় থাকে ধনী বাবার কন্যা। আর এক কন্যা হলে তো সোনায় সোহাগা, রাজ্য ও রাজকন্যা দুই–ই তাঁর! কিন্তু এমনটি কি চলতেই থাকবে? নারীরা কি যৌতুকের শিকার হতেই থাকবেন? দেশে যৌতুকবিরোধী আইন প্রণীত হয়েছে সেই ১৯৮০ সালে, যেখানে বলা আছে, যৌতুক নেওয়া ও দেওয়া দুটিই সমান অপরাধ। যৌতুক দেওয়া বা দেওয়ায় সহায়তা করা হলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে সর্বাধিক পাঁচ বছর ও সর্বনিম্ন এক বছরের কারাদণ্ড ও জরিমানা অথবা উভয় দণ্ড দেওয়া যেতে পারে। কিন্তু এ আইনের কোনো প্রয়োগই নেই।

যৌতুকপ্রথার বিরুদ্ধে লিখতে গিয়ে মনে পড়ে গেল জুম্মন খান নিয়াজীর কথা। ভৈরবের একজন সাধারণ শিল্পী জুম্মন ২২ বছর ধরে লিখে চলেছেন যৌতুকবিরোধী স্লোগান। দেয়ালে, পোস্টারে, স্টিকারে, গেঞ্জিতে স্লোগান লিখছেন তিনি। পত্রিকায় যৌতুকের জন্য নারীদের ওপর নির্যাতনের খবর পড়ে মন ভারাক্রান্ত হয়ে উঠত তাঁর। তিনি মনে মনে পণ করেন নিজেও যৌতুক নিয়ে বিয়ে করবেন না এবং অন্যদেরও এ বিষয়ে সচেতন করে তুলবেন। ১৯৯৪ সালে নিজ উপজেলা ভৈরব থেকে যৌতুকবিরোধী প্রচারাভিযান শুরু করেন তিনি। তারপর থেকে দেশের নানা প্রান্তে প্রচারণা চালিয়েছেন। সামাজিক সচেতনতা বাড়াতে লংমার্চ, র‍্যালি, পথনাটক, মঞ্চনাটকসহ বহুমুখী কার্যক্রম গ্রহণ করেছেন। এখন নিয়াজী বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে গিয়ে ছাত্রছাত্রীদের যৌতুকবিরোধী শপথবাক্য পাঠ করাচ্ছেন।

জুম্মনের মতো করে হয়তো আমরা সবাই করতে পারব না। কিন্তু এর এক-তৃতীয়াংশ চেষ্টাও যদি আমরা করি, নিশ্চয়ই তা কাজে দেবে। এ ক্ষেত্রে সরকারকে অবশ্যই অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হবে। সরকারকে যৌতুকবিরোধী আইন সম্পর্কে প্রচারের উদ্যোগ নিতে হবে এবং যেখানে দরকার হবে সেখানেই আইনের প্রয়োগ করতে হবে। আর যাঁরা সত্যিই যৌতুকপ্রথাকে ঘৃণা করেন, তাঁদেরও এগিয়ে আসতে হবে। ক্ষতিকর এই প্রথাকে সমাজ থেকে দূর করতে সহায়তা করতে হবে। আমরা চাই, সব বিয়ে হোক বিনা যৌতুকে।

যেসব পুরুষ যৌতুক নিয়ে বিয়ে করতে চাইবেন, নারীরা তাঁদের প্রত্যাখ্যান করুন। তাঁদের কোনো অবস্থাতেই বিয়ে করবেন না। কারণ, তাঁরা আর যা-ই হোক, ভালো মানুষ নন। আর পুরুষদের বলছি—আজই শপথ নিন, বলুন, ‘যৌতুক নিয়ে বিয়ে করব না’। এখনই ‘না’ বলুন যৌতুককে।

রোকেয়া রহমান: সাংবাদিক।