বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে ভয় ও প্রলোভন দুটোই আছে

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী। শিক্ষাবিদ ও লেখক। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক। ২৩ জুন ৮৭তম জন্মদিন সামনে রেখে সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী প্রথম আলোর সঙ্গে কথা বলেছেন তঁার লেখালেখি, শিক্ষকতা ও সম্পাদনা এবং বাংলাদেশের আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক সংকট নিয়ে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সোহরাব হাসান

প্রশ্ন :

আপনার ৮৭তম জন্মদিন সমাগত, আপনাকে শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন। এই যে ব্রিটিশশাসিত ভারতে আপনার জন্ম, পাকিস্তান আমলে বেড়ে ওঠা এবং স্বাধীন বাংলাদেশেও অর্ধশত বছর পার করলেন। এই তিন পর্বের মধ্যে মৌলিক কোনো পার্থক্য আছে বলে মনে করেন?

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী: পার্থক্য অবশ্যই আছে। প্রথম পর্বে আমরা ছিলাম একটি ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রের নাগরিক; সাতচল্লিশে স্বাধীন হলাম; একাত্তরে সেই স্বাধীনতা পূর্ণাঙ্গ হলো। রাষ্ট্র বদলেছে—পাকিস্তান হয়ে ব্রিটিশের বড় রাষ্ট্র ছোট হয়েছে, তারপর বাংলাদেশ হওয়াতে রাষ্ট্র আরও ছোট হলো। বাংলাদেশে বাঙালিরাই রাষ্ট্র শাসন করছে; এর রাষ্ট্রভাষা বাংলা; বাংলাদেশ এখন বিশ্বে সুপরিচিত। দেশের অনেক উন্নতি হয়েছে, বাংলাদেশের মানুষ বিশ্বের নানা জায়গায় কাজ করছে; মেয়েরা অনেক এগিয়েছে। কিন্তু মৌলিক পরিবর্তনের কথা যদি বলেন, তবে সেটা কিন্তু ঘটেনি। সাতচল্লিশে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের অবসান ঘটল, কিন্তু পাকিস্তান রাষ্ট্রে পূর্ববঙ্গের জন্য অভ্যন্তরীণ ঔপনিবেশিক শোষণ প্রতিষ্ঠিত হলো। স্বাধীন বাংলাদেশেও কিন্তু ঔপনিবেশিকতা আছে। না, বিদেশিদের নয়, স্বদেশিদেরই। ধনীদের। ধনীদের বড় সেই অংশের যারা দুর্নীতি, অপরাধ, ব্যাংকের ঋণ ইত্যাদির মধ্য দিয়ে ধনী হয়েছে এবং দেশের সম্পদ বিদেশে পাচার করছে। বাংলাদেশ তাদের কাছে উপনিবেশের মতোই। দ্বিতীয়ত, উন্নতির যে চরিত্র, তারও কোনো পরিবর্তন ঘটেনি। উন্নতির এই চরিত্র হচ্ছে পুঁজিবাদী। এই উন্নতি বৈষম্য ও বিচ্ছিন্নতা সৃষ্টি করে।

প্রশ্ন :

একজীবনে আপনি অনেকগুলো জীবন যাপন করেছেন—শিক্ষক, লেখক, সম্পাদক। এর মধ্যে কোন ক্ষেত্রে নিজেকে সফল বা ব্যর্থ মনে করেন?

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী: হ্যাঁ, আমি শিক্ষক, লেখক ও সম্পাদক—তিন ভূমিকাতেই দায়িত্ব পালন করেছি। কিন্তু এই তিনের মধ্যে বিচ্ছিন্নতা ছিল না, বিরোধ তো নয়ই। আসলে তিনটি মিলিয়ে একটিই জীবন। সফলতা ও ব্যর্থতার হিসাব করতে পারব না। তিন ক্ষেত্রেই আন্তরিক ছিলাম। তবে নিজেকে আমি মূলত একজন লেখক হিসেবেই দেখি। শিক্ষকতা আমার পেশা; কিন্তু আমি সাহিত্যেরই শিক্ষক ছিলাম। আর পত্রিকা সম্পাদনা আমার সাহিত্যচর্চারই অংশ। সব মিলিয়ে আমার কাজটাকে বলা চলে সাংস্কৃতিক। শিক্ষক হিসেবেও আমার চেষ্টা ছিল শিক্ষার্থীদের সাংস্কৃতিক মানকে উন্নত করতে সাহায্যদান। ক্লাসরুমে এবং ক্লাসরুমের বাইরেও সাহিত্যকে আমি ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেছি তার অন্তর্গত ইতিহাসকে বিবেচনায় নিয়ে। শিক্ষার্থীদের ভেতর সংবেদনশীলতা বৃদ্ধিও আমার চেষ্টার মধ্যে ছিল। সে ক্ষেত্রে সাফল্য কতটা অর্জিত হয়েছে বলতে পারব না, তবে নিজেকে আমি মোটেই ব্যর্থ মনে করি না।

প্রশ্ন :

বাংলাদেশের স্বাধীনতাসংগ্রামে সংস্কৃতির বড় ভূমিকা ছিল। এখন কেন সংস্কৃতি পিছু হটছে? এরশাদ আমলে সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটে আপনিও সক্রিয় ছিলেন।

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী: সংস্কৃতি যে পিছু হটছে, তার কারণ পুঁজিবাদ সর্বগ্রাসী হয়ে উঠেছে। পুঁজিবাদ এখন সংস্কৃতির শত্রু। সংস্কৃতি চায় মানুষকে সচেতন, সমাজমনস্ক ও সংবেদনশীল করতে। পুঁজিবাদের কাজটা দাঁড়িয়েছে সম্পূর্ণ উল্টো। পুঁজিবাদের নৃশংস আগ্রাসনে সংস্কৃতির চর্চা বিপদগ্রস্ত হয়েছে। এটা যে কেবল বাংলাদেশের সমস্যা তা নয়; বিশ্বব্যাপীই এটা ঘটছে। সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট গঠনের সময়ে এবং পরেও আমি সক্রিয় ছিলাম। পরে সক্রিয়তা যে কমেছে, তার মূল কারণ পরবর্তী প্রজন্ম এসে গেছে।

প্রশ্ন :

এই যে রাষ্ট্র, রাজনীতি, সমাজ, শিল্প, সাহিত্য ও সংস্কৃতি নিয়ে অনেক লেখালেখি করেছেন, এখনো করছেন—জনমানসে কতটা প্রভাব ফেলতে পেরেছে বলে মনে করেন? আমরা তো দেখি চিন্তাচেতনায় সমাজ ক্রমেই পিছিয়ে যাচ্ছে। তাহলে কি লেখালেখি ব্যর্থ বলবেন?

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী: না, ব্যর্থ বলব না। নিশ্চয়ই কিছু প্রভাব ফেলেছে। কাজটা সংগ্রামের। সেটা অব্যাহত রাখা দরকার। চিন্তাচেতনার মান যে নেমেছে, তার মূল কারণও পুঁজিবাদের দৌরাত্ম্য। পুঁজিবাদ চায় না মানুষ চিন্তা করুক; সে খুশি হয় মানুষ ভোগবাদী হলে। তাতে পণ্যের বিক্রি বাড়ে; বিদ্যমান ব্যবস্থার বিরুদ্ধশক্তিটা দুর্বল হয়। তবে মানুষ যে অচেতন হয়ে পড়েছে, তা নয়। মানুষ সুযোগ পায় না, পেলে বের হয়ে আসে। যেমন তরুণেরা নিরাপদ সড়কের জন্য আন্দোলন করেছে।

প্রশ্ন :

এই মুহূর্ত বাংলাদেশের বড় সংকট কী রাজনৈতিক, সামাজিক-সাংস্কৃতিক না সব কটি?

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী: সব কটিই সংকটাপন্ন বৈকি। তবে প্রধান সংকটটা অবশ্যই রাজনৈতিক। আমরা যে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র চেয়েছিলাম, সেটা পাইনি। ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ, অধিকার ও সুযোগের সাম্য, যথার্থ জনপ্রতিনিধিদের কর্তৃত্ব—এসব ঘটেনি। ঘটানোর জন্য সাংস্কৃতিক অগ্রগতি চাই। সেই অগ্রগতি আসেনি। পুঁজিবাদী উন্নতি সাংস্কৃতিক অগ্রগতির প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়িয়েছে। রাষ্ট্রের ভূমিকাটা খুবই সক্রিয়, বলা যায় নিয়ামক। সমাজে যঁারা পরিবর্তন আনতে চান, তাঁরা রাষ্ট্রের গণতন্ত্রায়ণের গুরুত্বকে উপেক্ষা করেছেন। এমনকি বামপন্থীরাও রাজনীতির মূল লক্ষ্যটা যে রাষ্ট্রক্ষমতার ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা ও রাষ্ট্রের পুঁজিবাদী-আমলাতান্ত্রিক চরিত্রে মৌলিক পরিবর্তন আনার এই বিষয়কে সামনে রাখতে পারেননি। ফলে রাষ্ট্র আগের মতোই রয়ে গেছে, বরং নড়বড়ে হওয়ার দরুন নিজেকে রক্ষা করার প্রয়োজনে আরও নিপীড়নমূলক ভূমিকা গ্রহণ করেছে।

প্রশ্ন :

একসময় আপনি পরিবেশ রক্ষার আন্দোলনে সক্রিয় ছিলেন। ওসমানী উদ্যান রক্ষার জন্য আন্দোলন করেছেন। আড়িয়ল বিল রক্ষায় আন্দোলন করেছেন। পরবর্তীকালে আপনাকে আর পরিবেশ রক্ষার আন্দোলনে সক্রিয় থাকতে দেখিনি। এর কারণ কী?

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী: আমার ওই সক্রিয়তাকে পরিবেশ রক্ষার জন্য না বলে অধিকার রক্ষার জন্য বলাটাই বোধ করি যথার্থ হবে। বাঁচার জন্য সুস্থ পরিবেশ চাই। সুস্থ পরিবেশ প্রত্যেক নাগরিকের মৌলিক অধিকার। ওসমানী উদ্যানে মিলনায়তন তৈরি করা হলে সেই অধিকার থেকে মানুষ বঞ্চিত হতো। আড়িয়ল বিল রক্ষাও জনস্বার্থেই অত্যাবশ্যক ছিল। আমি আরও একটা আন্দোলনে সক্রিয় ছিলাম; সেটা কুষ্টিয়াতে লালনের আখড়া রক্ষার আন্দোলন। ওই আন্দোলন সফল হয়নি, কারণ রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক প্রতিবন্ধকতার দরুন স্থানীয় মানুষ এগিয়ে আসতে সক্ষম হয়নি। পরবর্তী সময় আর আমাকে দেখা যায় না বলছেন; হ্যাঁ, সেটা সত্য। তার কারণ, বয়স বেড়েছে এবং আমার মূল যে কাজ, সাংস্কৃতিক কাজ, সেটির চাপও বেড়েছে।

প্রশ্ন :

আপনার সব লেখায় ঘুরেফিরে শ্রেণিদ্বন্দ্বের বিষয়টি সামনে আসে। কিন্তু পৃথিবীর কোথাও শ্রেণিসমস্যার সমাধান হয়নি। না চীনে, না রাশিয়ায়। এই দুই দেশ তো সমাজতন্ত্র থেকে সরে এসে ব্যাপক উন্নয়ন করেছে। এটি কি সমাজতন্ত্রের ব্যর্থতার প্রমাণ নয়?

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী: মোটেই না। সমাজতন্ত্র মোটেই ব্যর্থ হয়নি। তবে হ্যাঁ, সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার কয়েকটি চেষ্টা নিজেদের সাফল্যকে ধরে রাখতে পারেনি, পিছিয়ে গেছে। তবে চীন ও রাশিয়ার যে উন্নতির কথা বলছেন, তার পেছনে কিন্তু রয়েছে ওই দুই দেশের সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব; যেটা ঘটেছিল এবং ঘটার কারণে ওই দুটি দেশ অভাবনীয় উন্নতি করেছে। মানুষের মধ্যে জাগরণ এসেছিল, তা তাদের বড় অর্জন হিসেবে কাজ করেছে। বিশ্বজুড়ে সংকট এখন পুঁজিবাদেরই এবং সংকটের মূল কারণ হচ্ছে শ্রেণি-নিপীড়ন। যত উন্নতি ঘটছে, তত বৈষম্য বাড়ছে এবং পুঁজিবাদী উন্নতি আমাদের এই গ্রহকে মনুষ্য বসবাসের জন্য অনুপযোগী করে তুলছে। পুঁজিবাদের সংকট নিরসন সংস্কারে সম্ভব নয়, সম্ভব বৈপ্লবিক পরিবর্তনে। আর সেই বিপ্লবের মূল বিষয়টি হবে শ্রেণিবিভাজন দূর করে সম্পত্তির ব্যক্তিগত মালিকানার জায়গাতে সামাজিক মালিকানা প্রতিষ্ঠা করা।

প্রশ্ন :

আপনারা সব সময় মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ ও এর আগ্রাসনের বিরুদ্ধে কথা বলেন। এই প্রেক্ষাপটে ইউক্রেনে রাশিয়ার হামলাকে কীভাবে দেখছেন? পররাজ্য দখল করা কি সাম্রাজ্যবাদী নীতি নয়?

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী: মার্কিন সাম্রাজ্যবাদই প্রধান; এত কাল ছিল, এখনো যে সরে এসেছে তা নয়। ইউক্রেনে রাশিয়ার হামলা অবশ্যই একটি সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসন। রাশিয়া সামাজিক সাম্রাজ্যবাদী আগেই ছিল, এখন সে পুরোপুরি সাম্রাজ্যবাদী। যুদ্ধটা আসলে নবীন সাম্রাজ্যবাদী রাশিয়ার সঙ্গে প্রবীণ সাম্রাজ্যবাদী আমেরিকার। মাঝখানে পড়ে ইউক্রেনের মানুষ বিপদগ্রস্ত হয়েছে। বিপদ বেড়েছে গোটা বিশ্বেরই।

প্রশ্ন :

সম্প্রতি একটি আন্তর্জাতিক সংস্থার জরিপে দেখা যায়, বিশ্বের ৮০০ সেরা বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকায় বাংলাদেশের কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম নেই। ৮০১ থেকে ১ হাজারের মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও বুয়েট আছে। অথচ ভারত ও পাকিস্তানের বেশ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয় ৮০০-এর মধ্যে আছে। বিষয়টি কীভাবে দেখছেন?

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী: ব্যাপারটা দুঃখজনক। তবে এর জন্য কেবল যে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো দায়ী তা নয়, দায়ী গোটা রাষ্ট্র ও সমাজব্যবস্থাই। ব্যবস্থাটা জ্ঞানের চর্চাকে মূল্যবান মনে করে না। শিক্ষার দিকেও তার তেমন মনোযোগ নেই। সর্বোপরি শিক্ষায় বাণিজ্যের তৎপরতা বেড়েছে এবং শিক্ষার দায়িত্ব রাষ্ট্রীয় না হয়ে ব্যক্তিগত হয়ে গেছে।

প্রশ্ন :

এ দেশে বামপন্থীদের বিভক্তি ও বিচ্ছিন্নতাকে কীভাবে ব্যাখ্যা করবেন? এখন তো দেখা যায়, যত নেতা তত দল। অথচ তাদের পেছনে মানুষ নেই।

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী: বামপন্থীরা মানুষকে তাদের পেছনে রাখতে চায় না, সঙ্গে রাখতে চায়। তাদের লক্ষ্য থাকে মানুষ যাতে সামনে এগিয়ে যেতে পারে, তার জন্য পথ সুগম করা। জাতীয়তাবাদীদের সঙ্গে এখানেই তাদের পার্থক্য। জাতীয়তাবাদীরা যে দলই করুক না কেন, তারা সবাই পুঁজিবাদী এবং পুঁজির যে দমন-পীড়ন, তা সুবিধাবঞ্চিত মানুষের ওপর দিয়ে যেমন, তেমনি বামপন্থীদের ওপর দিয়েও যায়। তবে অগ্রগমনের পথে বামপন্থীদের নিজেদের দুর্বলতাটাই প্রধান অন্তরায় তাদের। বামপন্থীরা জ্ঞানের চর্চাটা যেভাবে করা প্রয়োজন, সেভাবে করতে পারেননি। পথের ও পন্থার ব্যাপারে তাদের মধ্যে বিভেদ ও বিভ্রান্তি ছিল; এখনো আছে। নেতৃত্ব নিয়ে বিরোধও সত্য। তবে মূল ব্যাপারটা হলো এই যে বামপন্থীরা সমাজবিপ্লবের লক্ষ্যকে সুস্পষ্টভাবে সামনে রাখতে পারেননি। একাংশ আপসকামী হয়ে গিয়েছিল; অপরাংশের কারও কারও মধ্যে ছিল অবৈজ্ঞানিক উগ্রতা। হতাশা এবং ক্লান্তিও অসত্য নয়। ওদিকে রয়েছে পুঁজিবাদের মতাদর্শিক প্রচার, তথাকথিত উন্নয়নের দৃষ্টান্ত; রয়েছে নিপীড়ন ও তার বিপরীতে প্রলোভন।

প্রশ্ন :

ধনতান্ত্রিক সমাজেও শ্রমিক-কৃষকেরা বড় বড় আন্দোলন করেন। ভারতের কৃষকদের আন্দোলনের মুখে বিজেপি সরকার দুটি আইন বাতিল করতে বাধ্য হয়েছে। আমাদের এখানে এখন সেই ধরনের আন্দোলন হয় না কেন?

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী: আন্দোলনে আমাদের অভিজ্ঞতাটা অপেক্ষাকৃত কম সময়ের। আমাদের জন্য মীমাংসার প্রশ্ন ছিল দুটি। একটি জাতিগত, অপরটি শ্রেণিগত। বাঙালি জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের মধ্য দিয়ে পাকিস্তান ভেঙে বেরিয়ে এসে জাতিগত সমস্যার মীমাংসা হয়েছে বলা চলে; এখন শ্রেণিসমস্যার সমাধানের অপেক্ষায় রয়েছে। এ দেশে যত আন্দোলন হয়েছে তাদের চালিকা শক্তি ছিলেন বামপন্থীরাই। উনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থানেও তাঁদের ভূমিকাই ছিল প্রধান। একাত্তরের যুদ্ধেও দেশের ভেতরে থেকে যে যুদ্ধ, তা বামপন্থীরাই প্রধানত করেছেন। কিন্তু তঁারা বিক্ষিপ্ত ছিলেন, কোনো একটি সংগঠনে ঐক্যবদ্ধ ছিলেন না, তাঁদের মধ্যে তত্ত্বগত বিভ্রান্তিরও ছিল; ফলে জাতীয় মুক্তির আন্দোলনে তাঁরা নেতৃত্ব দিতে পারলেন না। যুদ্ধ শেষে সবচেয়ে বড় ও সংগঠিত শক্তি ছিল মস্কোপন্থী কমিউনিস্ট পার্টি। বিরোধী দলের ভূমিকা নেওয়ার কথা ছিল তঁদেরই। তাঁরা সেটা করতে পারেননি। ওই ফাঁকে জাসদ বেরিয়ে এসেছে। জাসদ আওয়াজ দিয়েছে বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের, কিন্তু নেতৃত্ব যে ছিল জাতীয়তাবাদী, সেটা ধরা পড়েছে তাদের ওই ‘জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল’ নাম গ্রহণেই। জাসদের রাজনীতি দুটি বড় ক্ষতির কারণ হয়েছে। একটি হলো সমাজতন্ত্রের পক্ষে যে তরুণেরা উদ্দীপ্ত ছিল জাসদ তাদের আটকে ফেলল; তাদের সামাজিক বিপ্লব সম্ভব করার দিকে এগিয়ে যেতে দিল না। অপরটি হলো বিপ্লবের জন্য অঙ্গীকারবদ্ধ তরুণদের চিহ্নিত করে দিল। রাষ্ট্রের কাজ ছিল তাদের দমন করা; প্রকাশ্যে পেয়ে দমনে সুবিধা হলো। সেই দমনে অসংখ্য তরুণ প্রাণ দিয়েছে এবং হতাশাটা বেড়েছে।

আন্দোলন যে হচ্ছে না তার একটি কারণ হতাশা। দেশজুড়ে হতাশা বিরাজ করছে। যাঁরা আন্দোলন করবেন, তাঁরাও এর বাইরে নন। আন্দোলন না হওয়ার আরেকটি কারণ হচ্ছে রাষ্ট্রীয় নিপীড়ন। বামপন্থীদের বিভ্রান্তি বিভাজন, জ্ঞানানুশীলনের অভাব, প্রচারমাধ্যমের অভাব—এসব তো রয়েছেই।

প্রশ্ন :

বাংলাদেশে যে গণতন্ত্রহীনতার সংকট চলছে, তা থেকে উত্তরণে বুদ্ধিজীবীরা যথাযথ ভূমিকা রাখছেন না বলে অভিযোগ আছে। মাঝেমধ্যে পত্রিকায় বিবৃতি দেওয়া ছাড়া কোনো তৎপরতা দেখি না। তারা কি ভয় পেলেন না প্রলোভনে পড়লেন?

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী: ভয় এবং প্রলোভন—দুটোই সত্য। এ দুটির তৎপরতা আগেও ছিল, এখন অনেক বেড়েছে। ভয় ও প্রলোভনের বৃত্ত ভেঙে বের হয়ে আসার জন্য যে ঐক্য ও সংগঠন প্রয়োজন, দেশে তা নেই। প্রথম আলো: আপনাকে ধন্যবাদ। সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী: আপনাকেও ধন্যবাদ।