বেঁচে থাক বাবা 'টক শো'

কার্টুন:তুলি
কার্টুন:তুলি

গল্পটি হচ্ছে, লন্ডনের হাইড পার্কে নাকি একটি পাথরের ব্যাঘ্রমূর্তি আছে, লোকে বলে ‘বেঙ্গল টাইগার’। তার কাছে গিয়ে আপনি যে ভাষাতেই প্রশ্ন করুন, সে আপনাকে ঠিক ঠিক জবাব দেবে। লোকসমাগম দেখে ব্রিটিশ সরকার প্রতি প্রশ্নকর্তার ওপর পাঁচ পাউন্ড টিকিট ধার্য করে দিলেন। কিন্তু তাতে কী, লোকের কোনো কমতি নেই। একদিন হলো কী, কথা নেই বার্তা নেই, হঠাৎ সেই বাঘ কথা বলা বন্ধ করে দিল। ব্রিটিশ সরকারের তো মাথায় বাড়ি। এখন উপায়? তারা ঘোষণা করল, যদি কেউ ব্যাঘ্রটিকে ফের কথা বলাতে পারে, তাকে ১০ লাখ পাউন্ড পুরস্কার দেওয়া হবে। কত লোক এল আর গেল, কিন্তু কেউ বাঘটিকে কথা বলাতে পারে না। একদিন এক বাঙালি ভদ্রলোক এসে হাজির। তিনি সেই বাঘের কানে কানে কী যেন বললেন, আর অমনি বাঘ বেচারা চেঁচিয়ে উঠল, ‘না না না!’ সবাই তো অবাক। পুরস্কার নেওয়ার সময় ব্রিটিশ সরকারের একজন তাঁকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘ভাই, বাঘটাকে তুমি জিজ্ঞেস করেছিলে কী?’ ভদ্রলোক অদৃশ্য গোঁফে পাক দিয়ে বললেন, ‘আমি শুধু জিগাইছিলাম, কী, বাংলা টিভির টক শো শুনবি?’
নিউইয়র্কে আমাদের গোটা দুয়েক বাংলা টিভি হয়েছে, তাতে যথারীতি ঢাকা স্টাইলে বাংলা টক শো হয়। সপ্তাহ দুয়েক আগে আমি প্রথমবারের মতো একটি টক শোতে অংশগ্রহণের সুযোগ পেলাম। গিয়ে দেখি এলাহি কাণ্ড। সব মিলে ১২ জন অতিথি, যে যাঁর ক্ষেত্রে প্রথিতযশা। অধিকাংশই স্থানীয়, তবে দেশ থেকেও জনা দুয়েক বক্তা মজুত। বিষয়বস্তু যথারীতি বাংলাদেশের চলমান পরিস্থিতি। আলোচনার শুরুতে সুশীল সমাজের এক বিশিষ্ট প্রতিনিধি বিস্তর যুক্তি-তর্ক দিয়ে বোঝালেন, বাংলাদেশ এখন একটা দুঃসহ অবস্থার ভেতর দিয়ে যাচ্ছে। অগণতান্ত্রিক সরকার ভোটবিহীন নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় বসে এখন ক্রমেই স্বেচ্ছাচারী হয়ে উঠছে। আইনি ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে, বিচারব্যবস্থা সরকারের পকেটে, শিক্ষাক্ষেত্রে অব্যবস্থা চূড়ান্ত। এক কথায় গভর্ন্যান্সের চরম দুর্যোগ চলছে। বাকি সবাই মোটামুটি একই কথা বললেন। আমি মিনমিনে গলায় বলার চেষ্টা করেছিলাম, ভাই, গভর্ন্যান্স মানে তো জনগণের কাছে জরুরি সেবা পৌঁছে দেওয়া। শুনতে পাই দেশের অর্থনৈতিক উন্নতি হচ্ছে, না খেয়ে মরে এমন লোক কমেছে। জিনিসপত্রের দামও সহ্যের ভেতর, মুদ্রাস্ফীতি নিম্নমুখী। সারা বিশ্ব যেখানে এখনো মন্দাবস্থা কাটাতে খাবি খাচ্ছে, সেখানে বাংলাদেশ তো ভালোই করছে।
সবাই হামলে পড়লেন। মাথাপিছু আয় যদি উন্নতির লক্ষণ হয়, তাহলে সোমালিয়ার অবস্থা আমাদের চেয়ে ভালো, একজন দাবি করলেন। কারণ, তাঁর কথায়, সোমালিয়ার মাথাপিছু আয় বাংলাদেশের চেয়েও বেশি। আমি কিঞ্চিৎ ঘাবড়ে গেলাম, কিন্তু প্রতিবাদ করার সাহস পেলাম না। (পরে বই ঘেঁটে দেখি, চলতি হিসাবে বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় প্রায় ৯০০ ডলার, সোমালিয়ার ১১২ ডলার।) আরেক বক্তা, তিনি এ দেশে দীর্ঘদিন অধ্যাপনা করেন, জানালেন গণতন্ত্রের জন্য দুটি আবশ্যিক পূর্বশর্ত হলো শিক্ষিত নাগরিক সমাজ ও সংখ্যাগরিষ্ঠ মধ্যবিত্ত শ্রেণি। বাংলাদেশে দুই শর্তই অনুপস্থিত, তাহলে সেখানে গণতন্ত্র আসবে কোত্থেকে? সবচেয়ে উত্তেজিত দেখলাম ঢাকা থেকে আসা একজন বিরোধী রাজনীতিককে। তিনি জানালেন, দেশে তাঁর নামে রাষ্ট্রদ্রোহের মামলা দেওয়া হয়েছে, দেশে ফিরলেই তাঁকে জেলে ঢোকানো হবে। তিনি এ-ও জানালেন, তাঁর এক মেয়ে সারা বিশ্বের ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে ইংরেজি সাহিত্যের পরীক্ষায় প্রথম হয়ে স্কলারশিপ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে এসেছেন, তিনি মেয়েকে নিয়েই যুক্তরাষ্ট্রে এসেছেন।
আমরা সবাই তাঁকে বাহবা জানালাম, কিন্তু মনের মধ্যে এমন একটা প্রশ্নও জাগল, দেশের শিক্ষাব্যবস্থা যদি ভেঙে গিয়ে থাকে, তাহলে সেখান থেকে এমন মেধাবী ছাত্রছাত্রীই বা আসেন কীভাবে? আমি এ-ও ভাবছিলাম, সবকিছু ভেঙে চুরমার হয়ে গেলে দেশের ১৫ কোটি মানুষ টিকে আছে কী করে? দেশে তো এদ্দিনে মহাবিপ্লব হয়ে যাওয়ার কথা!
এক ঘণ্টার টক শো, তাতে নানা মুনির নানা মত। সবাই যে তথ্য-উপাত্ত ঘেঁটে সব কথা বললেন তা নয়, কিন্তু কথাগুলো বললেন বাংলাদেশের ব্যাপারে তাঁদের গভীর উদ্বেগ ও শর্তহীন ভালোবাসা থেকে। অনুষ্ঠানের গোড়া থেকেই আমার সেই বাকপটু ব্যাঘ্রের কথা মনে আসছিল। পুরো অনুষ্ঠানের মাঝেমধ্যে আমি বার কয়েক সেই ব্যাঘ্রের মতো ‘না না’ বলে চেঁচিয়ে উঠতে চেয়েছি। অথচ, কবুল করছি, অনুষ্ঠান শেষে আমার মনে হলো, বাঘ বাবাজি মোটেই ঠিক বলেনি। যে হাইড পার্কে সেই বাচাল পাথুরে বাঘ, তার এক কোনায় রয়েছে স্পিকার্স কর্নার। প্রতিদিন বিকেলে আসুন, দেখবেন যে যা খুশি বলে যাচ্ছে, রাজা-রানির মা-বাপ উদ্ধারও বাকি নেই। এতে রাজা-রানি বা ইংল্যান্ডের সরকারের গায়ে বিন্দুমাত্র আঁচড় হয়তো লাগে না, কিন্তু শহরের মানুষ মন খুলে কথা বলার একটা জায়গা তো পায়।
আমাদের টক শো হলো বিলাতের হাইড পার্ক। দেশের ভেতর মন খুলে কথা বলার খুব বেশি জায়গা আর নেই। রেডিও-টেলিভিশন থেকে শুরু করে পত্রপত্রিকার ওপর সরকার নজরদারি বাড়াচ্ছে। ঢাকা থেকে আসা একজন বাঘা সম্পাদক সেদিন জানালেন, বিপদের আশঙ্কা টের পেয়ে পত্রিকাগুলো নিজেরাই ‘সেলফ সেন্সরশিপ’ আরোপ করা শুরু করেছে। সরকার যত না চোখ রাঙায়, তার দেড় গুণ লাফায় অনুগত বুদ্ধিজীবী। গলা টিপে ধরার জন্য অনুগত মাস্তানরাও সদা প্রস্তুত।
এদিকে নতুন ভয় যুক্ত হয়েছে সম্প্রতি প্রস্তাবিত জাতীয় সম্প্রচার নীতিমালা নিয়ে। এই নীতিমালা আইন হিসেবে গৃহীত হলে সরকার চাইলে কার্যত যেকোনো সমালোচনাপূর্ণ বক্তব্যের জন্য যে কাউকে শ্রীঘরে ঢোকাতে পারে। রাজনৈতিক নেতাদের সমালোচনা করা যাবে না, সেনাকর্তাদের সমালোচনা করা যাবে না, বন্ধুপ্রতিম দেশের বিরুদ্ধে কটু কথা বলা যাবে না, কোনো ধর্ম বা সম্প্রদায় নিয়ে সমালোচনা করা যাবে না, পরিবেশবিমুখ কোনো মন্তব্য সহ্য করা হবে না, এমনকি রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলা বা বিদ্রোহ বিষয়েও সংবাদ পরিবেশন করা যাবে না। তাহলে ঠিক কী নিয়ে পত্রপত্রিকা বা টেলিভিশন তাদের খবর পরিবেশন করবে? (অনুমান করি, দীপিকা পাড়ুকোনের বক্ষসন্ধি নিয়েও কথা বলা যাবে না, তা অশ্লীল বিবেচিত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।)
মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা হিসেবে রয়েছে তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি আইন। বাংলাদেশ ডিজিটাল যুগে প্রবেশ করেছে, চলতি সরকারই তার প্রসারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। অথচ এই সরকার এখন যে তথ্যপ্রযুক্তি আইন বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিয়েছে, তাতে সাইবার স্পেসেও মন খুলে কথা বলা কঠিন হয়ে পড়বে। এই আইনের বলে দেশের নেতা-নেত্রীদের বিরুদ্ধে সামান্য বেফাঁস কথা বললে সোজা শ্রীঘর। খুলনার এক অল্পবয়সী ছেলে দেশের প্রধানমন্ত্রী ও জাতির জনক বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে ব্যঙ্গাত্মক গান পেনড্রাইভের মাধ্যমে অন্যকে দেওয়ার অপরাধে সাত বছরের কারাদণ্ডে দণ্ডিত হয়েছেন। বই ছেপে নয়, ফেসবুকে নয়, নিজের পেনড্রাইভে কার কাছে কী দেওয়া হলো, তার জন্য জেল?
বাকি ছিল টক শো। মাঝরাতে আর কিছু না হোক গলা ছেড়ে চেঁচানো তো যেত। শোনা যাচ্ছে, সরকার এখন সেই টক শোতে কথা বলার সুযোগ ছাঁটতে চাইছে। তাহলে মানুষ যাবে কোথায়?
অধিকাংশ উন্নয়ন সূচকে বাংলাদেশ লক্ষণীয় অগ্রগতি অর্জন করেছে, এ নিয়ে কোনো তর্ক নেই। মতপ্রকাশের স্বাধীনতাও একটি গুরুত্বপূর্ণ উন্নয়ন সূচক। ভাত খেয়ে পেট হয়তো ভরে, কিন্তু মন ভরে না। সে জন্য মন খুলে গান গাওয়ার অথবা চেঁচানোর একটা ব্যবস্থা রাখাও কম জরুরি নয়। আমার ভয় হয়, সত্যি সত্যি যদি আইন করে মানুষের কথা বলার সুযোগ বন্ধ করা হয়, তাহলে যে শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থার সৃষ্টি হবে, তাতে দেশের গণতান্ত্রিক অগ্রযাত্রা শুধু বিঘ্নিত নয়, রুদ্ধ হয়ে আসবে।
বাংলাদেশে নিযুক্ত যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক রাষ্ট্রদূত উইলিয়াম বি মাইলাম সম্প্রতি পাকিস্তান ও বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক অগ্রগতি বিষয়ে একটি তুলনামূলক চিত্র এঁকেছেন। তাঁর কথায়, রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে দুই ধরনের রাজনৈতিক দর্শন রয়েছে। একটির প্রবক্তা টমাস হবস, অন্যটির জন লক। দুজনেই সপ্তদশ শতকের জাঁদরেল ইংরেজ সমাজবিজ্ঞানী। হবসের যুক্তি ছিল, সেই দেশ সবচেয়ে ভালো ও নিরাপদ, যার নেতৃত্বে থাকেন দেশের মানুষের আস্থাভাজন একজন শক্ত একনায়ক। হবস রাজা বা রানির কথাই বুঝিয়েছিলেন। (আধুনিক সময়ে যেমন মালয়েশিয়ার মাহাথির মোহাম্মদ বা চীনের দেং শিয়াও পিং।) লক বললেন, না, ক্ষমতা বিকেন্দ্রীকরণ ও নাগরিক অংশগ্রহণ যেখানে সবচেয়ে বেশি, সেই দেশ কেবল সবচেয়ে অধিক গ্রহণযোগ্য, তার এগোনোর ক্ষমতা সবচেয়ে বেশি। দেশের রাজনীতিক ও জনগণের মধ্যে একটি সামাজিক চুক্তির মাধ্যমে এই নাগরিক অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা সম্ভব। মাইলাম মনে করেন, কাঠামোগত নানা সমস্যা সত্ত্বেও পাকিস্তান লক-এর প্রস্তাবিত পথ অনুসরণে আগ্রহী। তারা সে পথেই এগোচ্ছে। অন্যদিকে বাংলাদেশ হবসের দেখানো পথ অনুসরণ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। মাইলাম কোথাও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী বা আওয়ামী লীগ সরকারের নাম উচ্চারণ করেননি, তবে তাদের কথাই যে বুঝিয়েছেন, তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
যে টক শোর কথা গোড়াতে বলেছিলাম, অতিথি বক্তাদের তাবৎ মতভিন্নতা ও অবিশ্বাস সত্ত্বেও শেষমেশ কিন্তু সবাই আমরা একমত হলাম, বাংলাদেশকে এগোতে হলে জন লকের প্রস্তাবিত ‘সোশ্যাল কন্ট্রাক্ট’ই চাই। শুধু এক দলের লোক ক্ষমতায় থাকবে, অথবা শুধু ক্ষমতাসীন মহল যা ঠিক করে দেবে, সে কথাই তোতাপাখির মতো আওড়াতে হবে, এমন অবস্থা দেশের গণতান্ত্রিক সম্ভাবনার জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। এমন চেষ্টা যে আগে হয়নি, তা নয়, কিন্তু সে চেষ্টার ফলাফল ভালো হয়নি।
অতএব, দেশের যাঁরা দণ্ডমুণ্ডের কর্তা, তাঁদের কাছে অনুরোধ, প্লিজ, আমাদের কথা বলার সুযোগ সংকুচিত করবেন না। ওপরে যে দেংয়ের কথা বললাম, তিনি উপদেশ দিয়েছিলেন, শত ফুল ফুটুক। আমরাও বলি, বেঁচে থাক বাবা হাজারো টক শো। বেঁচে থাক মতপ্রকাশের স্বাধীনতা।
হাসান ফেরদৌস: প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক৷