বেশি ভোটার কম ভোটারের কাছে হারল যেভাবে

নির্বাচনের আগে বহু জরিপেই দেখা গেছে, বেশির ভাগ ভোটার ব্রেক্সিটের বিপক্ষে। কিন্তু শুধু নির্বাচনপদ্ধতির কারণে ব্রেক্সিটপন্থীরা জিতে গেছে। ছবি: রয়টার্স
নির্বাচনের আগে বহু জরিপেই দেখা গেছে, বেশির ভাগ ভোটার ব্রেক্সিটের বিপক্ষে। কিন্তু শুধু নির্বাচনপদ্ধতির কারণে ব্রেক্সিটপন্থীরা জিতে গেছে। ছবি: রয়টার্স

যুক্তরাজ্য ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) সঙ্গে থাকবে, নাকি বেরিয়ে যাবে—এটিকেই যুক্তরাজ্যের আধুনিক ইতিহাসের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু হিসেবে ভাবা হচ্ছে। যুক্তরাজ্যের নির্বাচনী ব্যবস্থা কয়েক দিন আগে সেই ইস্যুটির একটি প্রশ্নাতীত ফয়সালা দিয়ে দিয়েছে।

যুক্তরাজ্যের বেশির ভাগ মানুষ ইইউর সঙ্গে থাকতে চায় এবং এই ভোটাররা ১২ ডিসেম্বর পার্লামেন্টারি নির্বাচনে ভোটও দিয়েছেন। এরপরও দেখা গেল এই নির্বাচন কনজারভেটিভ পার্টিকে বিরাট অবিশ্বাস্য সংখ্যাগরিষ্ঠতা দিয়েছে, যা দ্রুত ব্রেক্সিট কার্যকরে মুখ্য ভূমিকা রাখবে।

জনগণের আবেগকে যৌক্তিক প্রতিনিধিত্বশীল ফলাফলে রূপান্তর করতে ফার্স্ট-পাস্ট-দ্য-পোস্ট (এফপিটিপি) নির্বাচনী পদ্ধতির (এফপিটিপি নির্বাচনী পদ্ধতিতে বেশিসংখ্যক ভোট পেলেই প্রার্থী বিজয়ী ঘোষিত হন এবং বিজয়ী দল বা প্রার্থীই সব ক্ষমতা ভোগ করেন। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ভারত, বাংলাদেশসহ বিশ্বের এক-তৃতীয়াংশ দেশে এই পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়ে থাকে) ব্যর্থতাই এর আসল ও সহজ কারণ।

এফপিটিপি পদ্ধতি অনুযায়ী, প্রতিটি নির্বাচনী আসনে যে প্রার্থী সর্বাধিক ভোট পাবেন, তিনিই জয়ী ঘোষিত হবেন। সেখানে তাঁর প্রাপ্ত ভোট প্রয়োজনের চেয়ে অনেক বেশি হলেও সেটি তাঁর দল সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাবে কি পাবে না, সে বিষয়ে ভূমিকা রাখবে না। এই পদ্ধতির নির্বাচনে এমনটাও হওয়া সম্ভব যে বেশির ভাগ ভোটার হয়তো একই মত পোষণ করেন, কিন্তু তাঁরা কয়েকটি দলে বিভক্ত হয়ে থাকায় সেই মতের বিপক্ষে থাকা কমসংখ্যক লোকের ভোটে কোনো প্রার্থী বিজয়ী হয়ে যেতে পারেন।

একটা সহজ চিত্র দিয়ে বোঝাই: ধরুন তিনটি দল আছে। এর মধ্যে ইইউর সঙ্গে থাকার পক্ষে আছে দুটি দল। একটির নাম রিমেইন-১। অন্যটির নাম রিমেইন-২। ইইউ ছাড়ার পক্ষের দলটির নাম ‘লিভ’।

ধরা যাক, প্রতিটি জেলায় ৬৬ শতাংশ মানুষ ইইউর সঙ্গে থাকতে চায় এবং ৩৪ শতাংশ ছাড়তে চায়। এখানে থাকার পক্ষের লোক দুই ভাগে ভাগ হচ্ছে। তাহলে রিমেইন-১ পাচ্ছে ৬৬ শতাংশের অর্ধেক, অর্থাৎ ৩৩ শতাংশ এবং রিমেইন-২ পাচ্ছে বাকি অর্ধেক, মানে ৩৩ শতাংশ ভোট। লিভ পার্টি পাচ্ছে ৩৪ শতাংশ ভোট। তাহলে ওই জেলায় লিভ পার্টিই জিতে যাচ্ছে। তাতে বেশিসংখ্যক মানুষ একটি মতের অনুসারী হওয়ার পরও সেই মতের বিপরীতে থাকা কমসংখ্যক মানুষের মত প্রতিষ্ঠা পাচ্ছে।

 এই একই ফলাফল যদি সব জেলায় হয় তাহলে দেখা যাবে, জাতীয় ভোটে ১০০ শতাংশ ভোটের মধ্যে লিভ পার্টি পেয়েছে ৩৪ শতাংশ ভোট এবং বাকি দুটি দল পেয়েছে ৩৩ শতাংশ করে। অর্থাৎ এ ক্ষেত্রে লিভ পার্টি জিতে যাবে। কিন্তু দেশজুড়ে যদি প্রপোরশনাল-রিপ্রেজেন্টেশন পদ্ধতি চালু থাকে তাহলে ইইউর সঙ্গে থাকতে আগ্রহী রিমেইন পার্টি-১ এবং রিমেইন পার্টি-২ মিলে ৬৬ শতাংশ আসন পাবে এবং তারাই সরকার গঠন করবে।

এবারের নির্বাচনে আলোচনায় থাকা মোট দলের সংখ্যা ছিল ১১টি। এর মধ্যে আটটি উদারপন্থী। তারা ব্রেক্সিটের বিপক্ষে। এদের কেউ চেয়েছে ব্রেক্সিট যদি হতেই হয়, তাহলে আবার একটি গণভোট নেওয়া হোক, নয়তো ইইউর সঙ্গেই থাকা হোক। কেউ আবার গণভোটেরও পক্ষে নয়, তারা ইইউ থেকে বিচ্ছিন্ন হতে কোনো শর্তেই রাজি নয়। এই আটটি দল হলো লেবার পার্টি, দ্য স্কটিশ ন্যাশনাল পার্টি, দ্য লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি, সিন এফ ইন, প্লাইড সিমরু, দ্য সোশ্যাল ডেমোক্রেটিক অ্যান্ড লেবার পার্টি, দ্য গ্রিন পার্টি এবং এপিএনআই জোট। বাকি তিনটি রক্ষণশীল দল সরাসরি ব্রেক্সিটের পক্ষে। এরা হলো কনজারভেটিভ পার্টি, ডেমোক্রেটিক ইউনিয়নিস্ট পার্টি ও ব্রেক্সিট পার্টি।

নির্বাচনে যত ভোট পড়েছে তার ৯৮.৬ শতাংশ এই ১১ দল পেয়েছে। উদার আটটি দল মিলে ভোট পেয়েছে ৫২.২ শতাংশ। ব্রেক্সিটপন্থী তিনটি দল মিলে পেয়েছে ৪৬.৪ শতাংশ। তা সত্ত্বেও দিন শেষে দেখা গেছে ব্রেক্সিটপন্থী তিন দল মিলে মোট পেয়েছে ৩৭৩ আসন। আর উদার আটটি দল মিলে পেয়েছে ২৭৭টি আসন। এই ফলাফলের দুটি কারণ আছে। প্রথম কারণ হলো ব্রেক্সিটপন্থী ভোটারদের ৯৪ শতাংশ কনজারভেটিভ পার্টিকে ভোট দিয়েছেন। সে তুলনায় উদার দলগুলোর পক্ষে পড়া মোট ভোটের মাত্র ৬১ শতাংশ পেয়েছে লেবার পার্টি। প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন ব্রেক্সিটপন্থীদের একত্র করতে পেরেছেন। উল্টো দিকে লেবার নেতা জেরেমি করবিন ব্রেক্সিট না চাওয়া লোকদের বিভক্ত করেছেন।

দ্বিতীয় কারণটি হলো ফার্স্ট-পাস্ট-দ্য-পোস্ট (এফপিটিপি) পদ্ধতি অনুযায়ী, লন্ডন ও স্কটল্যান্ডের মতো কিছু জেলায় ব্রেক্সিটের বিপক্ষে থাকা লোকদের একচেটিয়া ভোট পেয়েছে উদারপন্থীরা। এখানে দেখা যাচ্ছে, ৭০ শতাংশের বেশি ভোট পেলেও নিয়ম অনুযায়ী তারা আসন পেয়েছে একটি করে। এ কারণে এসব জায়গায় উদারপন্থীদের জন্য একরকম ভোটের অপচয় হয়েছে। প্রপ্রোরশনাল-রিপ্রেজেন্টেশন সিস্টেমে ভোট হলে এই ভোটগুলোও ক্ষমতা ভাগাভাগির ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখত।

নির্বাচনের আগে বহু জরিপেই দেখা গেছে, বেশির ভাগ ভোটার ব্রেক্সিটের বিপক্ষে। কিন্তু শুধু নির্বাচনপদ্ধতির কারণে ব্রেক্সিটপন্থীরা জিতে গেছে। যুক্তরাজ্যে যদি প্রপ্রোরশনাল-রিপ্রেজেন্টেশন সিস্টেম চালু থাকত, তাহলে দেশটিতে হয় ব্রেক্সিট ইস্যুতে আবার গণভোট হতো, নয়তো যুক্তরাজ্য ইইউর সঙ্গে যুক্তই থাকত। নিদেনপক্ষে, দ্রুত ব্রেক্সিটের বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়া একটি বহুদলীয় জোট সরকার হতো।

এখন বড় সমস্যা হলো, যুক্তরাজ্যের তরুণেরা ইইউর সঙ্গে থাকতে চান। কিন্তু বয়স্করা চান না। বয়স্করা তরুণদের ওপর এমন এক সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দিচ্ছেন, যার ফলে তরুণদের বাকি জীবন ইউরোপের সঙ্গে বিচ্ছিন্ন অবস্থার মধ্য দিয়ে কাটাতে হবে।

আমার মনে হয়, যেসব দেশে দুটি বা তিনটি দল সক্রিয় আছে, সেখানে এফপিটিপি পদ্ধতি লাগসই হতে পারে, কিন্তু যুক্তরাজ্যে নয়। এই পদ্ধতি এখানে কাজ করেনি বলেই অধিকাংশের মতও এখানে মার খেয়ে গেছে।

ইংরেজি থেকে অনূদিত, স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট
জেফরি ডি. স্যাক্স: কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক