ব্যর্থতা সফলতার যাত্রায় একটি বিরতি মাত্র

ইলন মাস্ক

১৯৫৫ সাল। আমেরিকার ক্যালিফোর্নিয়ার সান ফ্রান্সিসকো শহর। অবিবাহিত মা–বাবা দুজনেই ছাত্র। জন্মের পরপরই দত্তক দিয়ে দেন তাঁদের সন্তান স্টিভকে। বেড়ে ওঠার সময় স্টিভের বন্ধুত্ব হয় পাঁচ বছরের বড় ওজনিয়াকের সঙ্গে। দুজনেই স্থানীয় কম্পিউটার ক্লাবের সদস্য। ওজনিয়াক কম্পিউটারের যন্ত্রাংশ আলাদাভাবে কিনে একদিন হঠাৎ করেই একটা কম্পিউটার বানিয়ে ফেলল নিজের জন্য। স্টিভ ভাবল, এ রকম কম্পিউটার বানিয়ে তো লোকের কাছে বিক্রি করা যাবে। যে কথা সেই কাজ। বন্ধু ওজনিয়াককে রাজি করানো হলো। বানানো হলো আরও একটি কম্পিউটার। বিক্রিও হলো। তবে খরচ উঠল না। পরেরটারও একই পরিণতি। কিন্তু দুজনের কেউই থামেননি। ওজনিয়াকের বানানো ১০০তম কম্পিউটার বিক্রি করেই প্রথম লাভের মুখ দেখা গেল।

এভাবেই ক্যালিফোর্নিয়ার এক গ্যারেজে, ১৯৭৬ সালে জন্ম আজকের অ্যাপল কোম্পানির। স্টিভ জবসের হাত ধরেই শুরু হয় আধুনিক কম্পিউটারের নতুন যুগের। মাউস ব্যবহার করে কম্পিউটার চালানোর ধারণাটাও তাঁর। আইপড, আইফোন, আইপ্যাডের মতো যুগান্তকারী পণ্য তৈরিতে নেতৃত্ব দিয়েছেন। ছবি তোলা, গান শোনা আর ফোন ব্যবহারের প্রচলিত ধারণা বদলে গেছে তাঁর কল্যাণে। প্লাস্টিক আর অ্যালুমিনিয়ামের পণ্যের সঙ্গে ব্যবহারকারীর হৃদয়ের সংযোগ ঘটেছে অসাধারণ নকশার কারণে। বিজ্ঞানের সঙ্গে সমন্বয় ঘটেছে শিল্পের।

এগুলো সবই অনেকটা জানা। কিন্তু অজানা হলো তাঁর ব্যর্থতার গল্পগুলো। একের পর এক স্টিভ জবস ব্যর্থ হয়েছেন, ভুল সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। নিজের হাতে তৈরি কোম্পানি থেকে বিদায় নিতে হয় স্টিভ জবসকে। কিন্তু থামেননি। ভুল থেকে শিখেছেন। আবার শুরু করেছেন। একদম শূন্য থেকে।

নেক্সট নামে কম্পিউটার তৈরির আরেকটি কোম্পানি শুরু করেন। লক্ষ্য বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছে বিক্রি করা। সময় থেকে প্রযুক্তিগতভাবে এগিয়ে থাকা এই কম্পিউটার বাণিজ্যিকভাবে ব্যর্থ হয়। ১৯৮৮ সালে আমেরিকার বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর কাছে ১০ হাজার ডলারে কম্পিউটার বিক্রি করা বেশ কঠিন ছিল। এরপর পিক্সার নামে এক কোম্পানি তৈরি করেন। উদ্দেশ্য গ্রাফিক ডিজাইনের জন্য কম্পিউটার তৈরি। মাত্র ৩০০ কম্পিউটার বিক্রি হয় এই কোম্পানির। এরপর স্টিভ মন দেন অ্যানিমেশন সফটওয়্যার তৈরিতে। তাঁর অ্যানিমেশন সফটওয়্যার দিয়ে বানানো চলচ্চিত্র একাডেমি অ্যাওয়ার্ড পায়। তরতর করে বেড়ে যায় পিক্সারের শেয়ারমূল্য। স্টিভের সম্পদ বেড়ে দাঁড়ায় ১ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলারে। ২০০৬ সালে ডিজনি কোম্পানি পিক্সার কিনে নেয় ৭ দশমিক ৪ বিলিয়নে।

অন্যদিকে স্টিভ জবস ছাড়া অ্যাপলের অবস্থা ধীরে ধীরে খারাপ হতে শুরু করে। ১৯৯৭ সালে স্টিভ জবসকে অ্যাপলে সিইও হিসেবে ফিরিয়ে আনা হয়। তিনবার কম্পিউটার নির্মাণে ব্যর্থ হলেও স্টিভ জবস নতুন করে শুরু করেন আবার। স্টিভ জবস একাধিকবার বলেছেন, তাঁর সাফল্যের একমাত্র কারণ একাধিক ব্যর্থতা। ব্যর্থতা থেকে শেখা। থেমে না থাকা।

প্রযুক্তির আরেক দিকপাল ইলন মাস্ক। বিশ্বের সবচেয়ে ধনী ব্যক্তি। ব্যক্তিগত সম্পদের পরিমাণ ২৮১ বিলিয়ন ডলার। স্থলে, পাতালে আর অন্তরিক্ষে বদলে দিচ্ছেন পরিবহনের ধারণাকে। ব্যাটারিচালিত গাড়ি, পাতাল পরিবহন আর পুনর্ব্যবহারযোগ্য রকেট তৈরির মাধ্যমে। ক্যারিয়ারের শুরুটা হয়েছিল ব্যর্থতা দিয়ে। ইন্টারনেট কোম্পানি নেটস্কেপে চাকরির জন্য আবেদন করেছিলেন ১৯৯৫ সালে। হয়নি। এরপর খুললেন জিপ-২ নামে অনলাইনের এক টেলিফোন ডিরেক্টরি। তেমন একটা সুবিধা হলো না। নিজের কোম্পানি থেকে বিতাড়িত হলেন। এরপর খুললেন পেপাল। প্রথমদিকে হাতে নিয়ে কাজ করা যায় এমন ছোট কম্পিউটারের সিকিউরিটি সফটওয়্যার তৈরি করতে শুরু করে পেপাল। প্রথম বছরে ‘সবচেয়ে বাজে ব্যবসায়িক ধারণা’ হিসেবে স্বীকৃতি পায় এ সফটওয়্যার। দমে যাননি ইলন। তৈরি করেন অনলাইনে কেনাকাটা করে দাম মেটানোর সফটওয়্যার। পেপাল বিশ্বব্যাপী এখন দারুণ জনপ্রিয় সফটওয়্যার।

এরপর খুললেন ব্যাটারিচালিত গাড়ি তৈরির কোম্পানি টেসলা। গাড়ি তৈরি করতে গিয়ে উৎপাদন ও সরবরাহে বড় ধরনের বিপর্যয়ের সম্মুখীন হলেন ইলন। ২০১৭ সালে ইলন মাস্ক প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন বছরে ১ হাজার ৫০০ গাড়ি তৈরি করবেন। ক্রেতাদের কাছ থেকে টাকাও নিয়েছেন অগ্রিম। অক্টোবর মাসে দেখা গেল তৈরি গাড়ির সংখ্যা মাত্র ২৬০। প্রায় দেউলিয়ার কাছাকাছি চলে আসেন তিনি। সব বাধা অতিক্রম করে টেসলা এখনকার বাজারে অন্যতম এক ব্র্যান্ড। কোম্পানির বাজারমূল্য এক ট্রিলিয়ন ডলারের বেশি।

ইলনের আরেক কোম্পানি স্পেসএক্স। প্রচলিত রকেট একবার মহাশূন্যে গিয়ে আর ফেরে না। ইলন ভাবলেন বিলিয়ন ডলারের রকেট মাত্র একবার ব্যবহার করা হবে কেন? এমন এক রকেট বানাতে হবে, যা বারবার ব্যবহার করা যাবে। প্রথম রকেট আকাশে ওড়ার কয়েক মিনিট পরই প্রশান্ত মহাসাগরে ভেঙে পড়ে। দ্বিতীয়টারও একই পরিণতি। দুর্ভাগ্যক্রমে পরেরটাও। কোম্পানি প্রায় উঠে যাওয়ার জোগাড়। চারবার চেষ্টার পর সফলভাবে মহাকাশে রকেট পাঠাতে সক্ষম হয় স্পেসএক্স। এখন স্পেসএক্সের বাজারমূল্য ১০০ বিলিয়ন ডলারের ওপরে। সফলতার সফরে ব্যর্থতা অনিবার্য, অনেকবারই বলেছেন ইলন মাস্ক।

সুব্রত বোস প্রবাসী বাংলাদেশি ও বহুজাতিক ওষুধ কোম্পানির রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট বিভাগের ভাইস প্রেসিডেন্ট

[email protected]