ব্লকচেইন প্রযুক্তি নিয়ে কাজ করার সময় এসে গেছে

ব্লকচেইন হচ্ছে তথ্য সংরক্ষণ করার একটি নিরাপদ এবং উন্মুক্ত পদ্ধতি (এএফপি)
ব্লকচেইন হচ্ছে তথ্য সংরক্ষণ করার একটি নিরাপদ এবং উন্মুক্ত পদ্ধতি (এএফপি)

বিশ্বজুড়ে এখন জনপ্রিয় হয়ে উঠছে ব্লকচেইন প্রযুক্তি। যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বাংলাদেশেরও ব্লকচেইন প্রযুক্তি নিয়ে কাজ করার সময় এসে গেছে। কিন্তু তার আগে জানতে হবে আমরা কি নতুন প্রযুক্তি গ্রহণে প্রস্তুত?

ব্লকচেইনকে আধুনিক কালের এক অভিনব উদ্ভাবন বলা হচ্ছে। ‘সাতোশী নাকামতো’ ছদ্মনামের এক বা একাধিক ব্যক্তি বা গোষ্ঠী এ প্রযুক্তির উদ্ভাবক। ২০০৯ সালে প্রথমবারের মতো বিটকয়েন সফটওয়্যার প্রকাশিত হওয়ার পর থেকে ব্লকচেইন প্রযুক্তির অনেক বিবর্তন ঘটে চলেছে। তথ্যকে ডিজিটালরূপে বণ্টন করা (অনুলিপি নয়) এই ব্লকচেইন প্রযুক্তি এক নতুন ধরনের ইন্টারনেট সৃষ্টি করেছে। কেবল ডিজিটাল মুদ্রা বিটকয়েনের জন্য ব্লকচেইনের উদ্ভাবন করা হলেও এখন প্রযুক্তির নানা ক্ষেত্রে এর সম্ভাব্যতা যাচাই চলছে।

শুরুতেই বলি, ব্লকচেইন হচ্ছে তথ্য সংরক্ষণ করার একটি নিরাপদ এবং উন্মুক্ত পদ্ধতি। এ পদ্ধতিতে তথ্য বিভিন্ন ব্লকে একটির পর একটি চেইন আকারে সংরক্ষণ করা হয়। এটি একটি অপরিবর্তনযোগ্য ডিজিটাল লেনদেন যা শুধুমাত্র অর্থনৈতিক লেনদেনের জন্যই প্রযোজ্য নয়। এ প্রযুক্তি ব্যবহার করে যেকোনো কার্য-পরিচালনা রেকর্ড করা যেতে পারে। এটা এমন একটি বন্টনযোগ্য ডাটাবেজ যাতে অংশগ্রহণকারী পক্ষ গুলির মধ্যে সব লেনদেনের নথি করে রাখা যায়। প্রতিটি লেনদেন আবার সিস্টেমের সংখ্যাগরিষ্ঠতা দ্বারা যাচাই করা হয়। একবার লেজারে কোনো তথ্য প্রবেশ করলে স্থায়ীভাবে তা থেকে যায় এবং কখনো মুছে ফেলা যায় না। ব্লকচেইন প্রতিটি একক লেনদেনের যাচাইযোগ্য রেকর্ড নিয়ে গঠিত হয়। এই অন্তর্নিহিত প্রযুক্তি নির্ভুলভাবে কাজ করে এবং বিভিন্ন কাজে এটির প্রয়োগ করা যেতে পারে।

যেহেতু ব্লকচেইন প্রযুক্তি ব্যবহারে ডিজিটাল তথ্যসমূহের নিরাপত্তার সঙ্গে আপস না করেই ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র ডিজিটাল তথ্য যাচাই করা যায়, সেহেতু এটি প্রয়োগ করে ডিজিটাল বিশ্বে এক আমূল পরিবর্তন নিয়ে আসা সম্ভব। ব্লকচেইন প্রযুক্তির একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রয়োগ হলো ‘স্মার্ট কন্ট্রাক্ট’। এটি মূলত একটি কম্পিউটার প্রোগ্রাম যা স্বয়ংক্রিয়ভাবে একটি চুক্তির শর্তাবলি সম্পাদন করতে পারে। আরেকটি নির্ভরযোগ্য প্রয়োগ হলো—এই স্মার্ট চুক্তি ব্যবহার করে সম্পত্তির মালিকানা নিয়ন্ত্রণ, যাকে ‘স্মার্ট প্রোপার্টি’ বলা হয়।

ব্লকচেইন প্রযুক্তির ডেটাবেইস বণ্টিত ও সর্বজনীন। এটা কোনো একক জায়গায় অবস্থান করে না বা সংরক্ষণ করা হয় না। অর্থাৎ, এতে যে রেকর্ড গুলি থাকে তা সত্যিকার অর্থেই সবার জন্য এবং সহজেই যাচাইযোগ্য। কোনো কেন্দ্রীয় সংস্করণ না থাকার ফলে এটা হ্যাকিংয়ের ঝুঁকি থেকেও মুক্ত। ব্লকচেইন ডাটাবেজ সংখ্যাগরিষ্ঠতার ওপর নির্ভর করে কাজ করে। একই সঙ্গে স্বয়ংক্রিয়ভাবে প্রতি দশ মিনিট অন্তর প্রত্যেকটি লেনদেন যাচাই করতে থাকে। এই লেনদেন গুলিকে এক একটি ব্লক বলা হয়। অর্থাৎ, কোনো একটি অংশের তথ্য পরিবর্তন করে ডেটাবেইস-এর অখণ্ডতা বা বিশুদ্ধতা নষ্ট করা যায় না। এর ফলে স্বচ্ছতা বজায় থাকে।

ব্লকচেইন প্রযুক্তি বিকেন্দ্রিত হওয়ায় অনেক অনুক্রমিক কাজ একসঙ্গে হয়ে যায়। যেমন—এ প্রযুক্তি ব্যবহারে শেয়ার-বাজারের লেনদেন যুগপৎভাবে হতে পারে; কিংবা, ভূমি নিবন্ধন রেকর্ডকে জনসাধারণের জন্য অনেক সহজলভ্য করা যেতে পারে।

ভারতের মহারাষ্ট্র প্রদেশ ই-গভর্নেন্স চালু করার জন্য ব্লকচেইন প্রযুক্তি ব্যবহারের ঘোষণা দিয়েছে। এ প্রযুক্তির জন্য প্রয়োজন ক্লাউড-কম্পিউটিং প্ল্যাটফর্ম। মহারাষ্ট্র সরকার বলছে, তাঁরা পাবলিক ক্লাউড ব্যবহার করবে। এতে ২০০ কোটি মার্কিন ডলারের বাজার সৃষ্টি করবে এবং সরকারের সমস্ত তথ্য ক্লাউডে স্থানান্তরিত হওয়ায় সরকারের প্রচুর পরিমাণ অর্থ সাশ্রয় হবে। ব্লকচেইন ব্যবহারের কারণে তথ্যের নিরাপত্তা ও স্বচ্ছতা তো থাকবেই।

বাংলাদেশে কি এই ব্লকচেইন প্রযুক্তি নিয়ে কাজ করা যায় না? যথার্থ সময় এসে গেছে। তবে কাজ শুরু করার আগে মানসিকতার পরিবর্তন আনতে হবে। আমরা যদি কেন্দ্রীভূত নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার মানসিকতা ছাড়তে না পারি, তাহলে এ প্রযুক্তি কাজ করবে না।

ডিজিটাল বাংলাদেশের একটি প্রধান উদ্দেশ্য স্বচ্ছতা। তাই সরকারকেও বিকেন্দ্রিত ও বণ্টিত তথ্যভান্ডার সম্বন্ধে ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি করতে হবে। নতুন প্রযুক্তির সঙ্গে মানিয়ে নিতে হবে। যদি আমরা এখনই নিজেদের মানিয়ে নিতে না পারি, তাহলে আমরা হয়তো এগোব ঠিকই, কিন্তু অন্যরা আমাদের থেকে অনেক বেশি এগিয়ে যাবে। নতুন প্রযুক্তিতে বাংলাদেশ নিশ্চয়ই পিছিয়ে পড়তে চাইবে না!

লেখক: বেসিসের সভাপতি