ভূরাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে বাংলাদেশ

[একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ ৫০ বছর পূরণ করতে যাচ্ছে। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী এমন একটি মাইলফলক, যখন এই দীর্ঘ যাত্রার একটি মূল্যায়ন প্রয়োজন। একটি রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ এখন কোথায় এসে দাঁড়িয়েছে, তার মূল্যায়ন করেছেন দুই গবেষক। চার পর্বের ধারাবাহিকের প্রথম পর্ব ছাপা হলো আজ।]

৫০ বছর আগে বাংলাদেশ যখন একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে, তখন পৃথিবীর মনোযোগ আকর্ষণ না করলেও স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে উন্নয়ন, গণতন্ত্র এবং ভূরাজনীতির আলোচনায় বাংলাদেশ কোনো না কোনোভাবে যে উল্লেখ্য, সেটা অনস্বীকার্য। স্বাধীনতা অর্জনের অল্প কিছুদিন পরই বাংলাদেশকে একটি আন্তর্জাতিক ‘বাস্কেট কেস’ এবং উন্নয়নের পরীক্ষাগার হিসেবেই চিত্রিত করা হয়েছিল। স্বাধীনতার পরের কয়েক দশক বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক অঙ্গনে পরিচিত ছিল মূলত প্রাকৃতিক দুর্যোগ, সামরিক অভ্যুত্থান, রাজনৈতিক সহিংসতা এবং দুর্নীতির মতো নেতিবাচক সংবাদের মাধ্যমে। এসব বিষয় যে এখন একেবারেই অপসৃত, তা নয়। কিন্তু এখন বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচিত হয় ভূরাজনীতির কারণেই।

বিশ্বরাজনীতির অন্যতম শক্তি চীন ও আঞ্চলিক শক্তি ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের ভৌগোলিক নৈকট্য এবং দক্ষিণ এশিয়াসহ এ অঞ্চলে এ দুই দেশের প্রতিদ্বন্দ্বিতা বাংলাদেশ বিষয়ে আলোচনায় এক নতুন মাত্রা যুক্ত করেছে। এ বিবেচনায় যুক্তরাষ্ট্রসহ অন্যান্য বৈশ্বিক শক্তির কাছে বাংলাদেশ সাম্প্রতিক সময়ে গুরুত্ব পাচ্ছে। ক্ষমতার হাতবদল এবং রাজনৈতিক অস্থিরতা সত্ত্বেও গত কয়েক দশকে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে যে অগ্রগতি সাধন করেছে, তা-ও আন্তর্জাতিক সমাজের মনোযোগ কাড়তে সক্ষম হয়েছে।

কিন্তু ৫০ বছরের মাথায় দাঁড়িয়ে বর্তমানের বাংলাদেশে গণতন্ত্রের পশ্চাৎযাত্রা, বিশেষ করে দুটি সাজানো জাতীয় নির্বাচনে ক্ষমতাসীনদের অভাবনীয় বিজয়, নাগরিকদের ভোটাধিকার হরণ, বাক্‌স্বাধীনতার অভাব এবং কর্তৃত্ববাদী সরকারব্যবস্থা এ গুরুত্ব ও অনেক অর্জনকেই ম্লান করে দিচ্ছে। সাধারণ জনগণের গণতন্ত্রের আকাঙ্ক্ষা প্রশ্নাতীত এবং এ আকাঙ্ক্ষাকে সামনে রেখেই বৈষম্যহীন, মানবিক সমাজ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। কিন্তু গত পাঁচ দশকে সেই আকাঙ্ক্ষা অধরাই রয়ে গেছে। গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান তৈরি ও শক্তিশালী করার বদলে দীর্ঘস্থায়ী সামরিক ও বেসামরিক কর্তৃত্ববাদী সরকারের শাসন এবং দুই প্রধান রাজনৈতিক দলের পরস্পরের প্রতি তীব্র শত্রুতামূলক আচরণ বাংলাদেশের টেকসই উন্নয়নে বাধা তৈরি করেছে। বাংলাদেশে উন্নয়নকে সঠিকভাবে বিকশিত হতে দেয়নি।

রাজনীতিতে নিজেদের বৈধতার সংকট মোকাবিলা ও ক্ষমতাকে দীর্ঘস্থায়ী করার লক্ষ্যে এবং ভোটের পাল্লা ভারী করতে ধর্মকে কেবল দুই দলই ব্যবহার করেছে তা নয়, অন্যরাও তা থেকে পিছিয়ে থাকেনি। এর সঙ্গে বৈশ্বিক প্রভাবে বাংলাদেশের সমাজেও এসেছে নানাবিধ পরিবর্তন। স্বাধীনতা দিবসের মাহেন্দ্রক্ষণে সাফল্যের উদ্‌যাপন স্বাভাবিক, কিন্তু রাষ্ট্র হিসেবে সামনে এগোনোর পথ অনুসন্ধানে তা-ই যথেষ্ট নয়। প্রয়োজন বাংলাদেশ কোথায় দাঁড়িয়ে আছে, তা উপলব্ধি করা।

ভূরাজনীতিতে বাংলাদেশ কোথায়

একসময় বাংলাদেশ বিবেচিত হতো ভারতবেষ্টিত এবং ভারত ও মিয়ানমারের মধ্যে অবস্থিত এক ক্ষুদ্র আয়তনের দরিদ্র দেশ হিসেবে। স্বাধীনতার অব্যবহিত পর বাংলাদেশের এ পরিচয় যতটা প্রাধান্য পেয়েছিল, মধ্য সত্তরে পররাষ্ট্রনীতির পরিবর্তন এবং ১৯৯০-এর দশকে বৈশ্বিক রাজনীতিতে বড় ধরনের অদলবদল এ পরিচয়ে পরিবর্তন আনে। যদিও বাংলাদেশ স্বতন্ত্রভাবে নিজের গুরুত্ব তৈরি করতে পেরেছিল, এমন দাবি করা যাবে না। গত এক দশকে সেই অবস্থারও বদল ঘটেছে একাদিক্রমে চীনের উত্থান, বিশ্ব পরিসরে যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব হ্রাস, দক্ষিণ এশিয়ায় আধিপত্য বিস্তারের জন্য ভারতের সুস্পষ্ট প্রয়াস এবং তার প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন, বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি এবং তার আলোকে বাংলাদেশের অনুসৃত পররাষ্ট্রনীতির কারণে।

ওয়াশিংটন ও ঢাকার মধ্যে অর্থনৈতিক ও নিরাপত্তা সম্পর্কে বর্তমানে ঘাটতি না থাকলেও তা স্বাধীনতার পর পতন ও উত্থানের মধ্য দিয়ে গেছে। স্নায়ুযুদ্ধে নেওয়া নীতি অনুসারে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের স্বাধীনতাবিরোধিতার কারণে এবং স্বাধীনতার অব্যবহিত পরে সোভিয়েত ব্লকের সঙ্গে বাংলাদেশের ঘনিষ্ঠতার জেরে দুই দেশের সম্পর্কে শীতলতা ছিল। জিয়াউর রহমান সরকারের সময় দুই দেশের সম্পর্কের যে উন্নতি ঘটে, পরের সামরিক ও বেসামরিক সরকারগুলোও এ সুসম্পর্ক বজায় রেখেছে।

১/১১-এর হামলার পর মুসলিমপ্রধান দেশ হিসেবে বাংলাদেশকে বিবেচনার কারণে বাংলাদেশ সম্পর্কে যুক্তরাষ্ট্রের আগ্রহ বৃদ্ধি পায়। নিরাপত্তার বিষয়কে প্রাধান্য দেওয়া এবং বুশ প্রশাসনের তথাকথিত ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধের’ বিবেচনা থেকে বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্কে বাণিজ্যের সঙ্গে যুক্ত হয় নিরাপত্তা সহযোগিতার বিষয়। জর্জ ডব্লিউ বুশের আমল থেকেই যুক্তরাষ্ট্র মূলত ভারতের চোখেই বাংলাদেশকে দেখে এসেছে। এর পেছনে একটা বড় কারণ হচ্ছে, এ অঞ্চলে ভারতীয় আধিপত্য নিশ্চিত করে যুক্তরাষ্ট্র পরাশক্তি চীনকে ঠেকাতে চায়।

চীন কেবল বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় অস্ত্র সরবরাহকারীই নয়, এখন বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় বাণিজ্যিক অংশীদার। বৈশ্বিক পরাশক্তি হিসেবে চীনের উত্থানের সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশের বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পে চীনের বিনিয়োগ লক্ষ করা যায়। ২০১৬ সালে বাংলাদেশ ও চীন একটি সমঝোতা চুক্তি স্বাক্ষর করে, যেখানে চীন ২৪ বিলিয়ন ডলার ঋণ দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেয়। এটি বাংলাদেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ ঋণ প্রতিশ্রুতি। যদিও চীনের দেওয়া ঋণের ডিসবার্সমেন্ট খুবই কম।

চীনের সঙ্গে এ চুক্তি স্বাক্ষরের কয়েক মাস আগেই বাংলাদেশ ভারতের সঙ্গে দুই বিলিয়ন ডলারের উন্নয়ন প্রকল্প ঋণ চুক্তি স্বাক্ষর করে। কিন্তু ভারতের এ ঋণে যুক্তির চেয়েও বড় বিষয় হচ্ছে বাংলাদেশের ক্ষমতাসীনদের সঙ্গে তার সম্পর্ক রাজনৈতিক। বাংলাদেশের ন্যায্য পাওনা না মিটিয়ে, বাংলাদেশের সঙ্গে অসম বাণিজ্য বহাল রেখে ভারত যে সব ধরনের কৌশলগত ও অর্থনৈতিক সুবিধা লাভ করে, তার কারণ এটিই। বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে ভারতের প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা সুস্পষ্ট। প্রায় এক দশক ধরে ভারত আওয়ামী লীগকে বাংলাদেশে কর্তৃত্ববাদী সরকারব্যবস্থা টিকিয়ে রাখতে সাহায্য করেছে। ভারতের কূটনীতিক এবং রাষ্ট্রীয় কর্মকর্তাদের কাছ থেকে আওয়ামী লীগ ২০১৪ ও ২০১৮ সালে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে যে দ্বিধাহীন সমর্থন পেয়েছিল, তার মাধ্যমেই এ বিষয়ে ভারতের অবস্থান পরিষ্কার। ভারত আওয়ামী লীগকে প্রশ্নহীনভাবে সমর্থন দিয়ে যাওয়ায় বাংলাদেশের জনগোষ্ঠীর একটি অংশের মধ্যে অসন্তোষ তৈরি হয়েছে। কিন্তু এটা প্রশ্নাতীত যে ভারতের প্রত্যক্ষ প্রভাববলয়ের মধ্যে আছে বাংলাদেশ।

যদিও বাংলাদেশের বর্তমান সরকার রাজনৈতিকভাবে ভারতেরই কাছের বন্ধু, তবু চীনের জন্য তাদের দরজা কিন্তু বন্ধ নয়। এর কারণ কেবল অর্থনৈতিক সুবিধা নয়। চীনের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক গড়ে তোলার পেছনে বাংলাদেশের কর্তৃত্ববাদী সরকারের অন্য উদ্দেশ্যও রয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে পশ্চিমা দেশগুলো, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে বাংলাদেশে মানবাধিকার লঙ্ঘন ও গণতান্ত্রিক পরিসর সংকোচন নিয়ে সমালোচনা রয়েছে। সম্প্রতি আল-জাজিরা টেলিভিশনে প্রচারিত একটি তথ্যচিত্রে দুর্নীতির অভিযোগ ওঠার পর জাতিসংঘ দুর্নীতির তদন্তের আহ্বান জানিয়েছে। মানবাধিকার বা গণতন্ত্রের সংকটের ইস্যুগুলোতে পশ্চিমা দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্কের যদি অবনতি ঘটে, সে ক্ষেত্রে বিকল্প হিসেবে চীনকে হাতে রাখতে চায় সরকার। অন্যদিকে, এ অঞ্চলে চীনের মিত্র পাকিস্তান, তাই বাংলাদেশের সঙ্গে মিত্রতার মাধ্যমে চীন ভারতের দুই দিকে মিত্রতার বলয় গড়তে পারবে ও ভারত মহাসাগরে তাদের আধিপত্য বিস্তার করতে পারবে, এমন আশা থেকেই চীন বাংলাদেশের সঙ্গে আরও ঘনিষ্ঠতা তৈরি করতে চায়।

বাংলাদেশ এখন পর্যন্ত চীন ও ভারতের মধ্যে একটা ‘ব্যালান্সিং গেম’ বা ভারসাম্য নীতি বজায় রেখেছে। কিন্তু এ ভারসাম্য রাখাটা কঠিন ও ঝুঁকিপূর্ণ, কারণ ভারসাম্য রাখতে ব্যর্থতা যেকোনো একটি দেশের সঙ্গে শত্রুতা তৈরি করতে পারে। তাই বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির সফলতা নির্ভর করবে কতটা দক্ষতার সঙ্গে বাংলাদেশ এ ভারসাম্যের ‘দড়িতে’ হাঁটতে পারে।

চীনের কাছাকাছি অবস্থান হওয়ার কারণে স্বাধীন ও যুগোপযোগী পররাষ্ট্রনীতি বাংলাদেশকে একটি গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রে পরিণত করতে পারে। বঙ্গোপসাগরকে সঠিকভাবে ব্যবহার করে বাংলাদেশ ইন্দো-প্যাসিফিক অর্থনৈতিক করিডরের একটি ‘হাবে’ বা কেন্দ্রে পরিণত হতে এবং দক্ষিণ এশিয়া থেকে শুরু করে মধ্য এশিয়া, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া ও চীনের মধ্যে যোগাযোগে অবদান রাখতে পারে। কিন্তু তার জন্য বাংলাদেশকেই অগ্রণী হতে হবে, পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে অভ্যন্তরীণ রাজনীতির বিবেচনা বা ক্ষমতায় টিকে থাকার প্রশ্ন নয়, দীর্ঘমেয়াদি জাতীয় স্বার্থকে প্রাধান্য দিতে হবে। যুক্তরাষ্ট্রে জো বাইডেন প্রশাসনের বাংলাদেশ বিষয়ে ভারতকেন্দ্রিক নীতির পরিবর্তন হবে কি না, সেটা এখনো স্পষ্ট নয়। কিন্তু এ অঞ্চলে চীনের প্রভাব কমাতে শুধু ভারতের ওপর নির্ভরতা বাংলাদেশে যুক্তরাষ্ট্রের গ্রহণযোগ্যতার জন্য ইতিবাচক নয়। তার বদলে বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্র দুই দেশেরই উচিত নিজেদের স্বার্থ ও বোঝাপড়ার ভিত্তিতে অগ্রসর হওয়া।

আগামীকাল: প্রতিষ্ঠার প্রতিশ্রুতি ও গণতন্ত্রের পশ্চাৎযাত্রা

আলী রীয়াজ যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির রাজনীতি ও সরকার বিভাগের ডিস্টিংগুইশড প্রফেসর, আটলান্টিক কাউন্সিলের অনাবাসিক সিনিয়র ফেলো এবং আমেরিকান ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশ স্টাডিজের প্রেসিডেন্ট

সাইমুম পারভেজ নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটির রাজনীতি ও সমাজবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক। তিনি সম্প্রতি ইউনিভার্সিটি অব সিডনি থেকে ডক্টরেট ডিগ্রি অর্জন করেছেন। তিনি সন্ত্রাসবাদ, ডিজিটাল মিডিয়া ও বাংলাদেশ রাজনীতি নিয়ে গবেষণা করেন।