ভোলার নতুন গ্যাসক্ষেত্র নিয়ে এখনই যে সিদ্ধান্ত জরুরি

ভোলা প্রাকৃতিক গ্যাসক্ষেত্র
ছবি: প্রথম আলো

সম্প্রতি বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় দ্বীপ ভোলায় আরও তিনটি প্রাকৃতিক গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কৃত হয়েছে বলে ঘোষণা দিয়েছে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম এক্সপ্লোরেশন কোম্পানি (বাপেক্স)। রাশিয়ার গ্যাস অনুসন্ধান প্রতিষ্ঠান গাজপ্রম নাকি এই তিন গ্যাসক্ষেত্র উন্নয়নের কাজ পরিচালনা করবে। ফলে অদূর ভবিষ্যতে ভোলায় আবিষ্কৃত ও উৎপাদনরত গ্যাসক্ষেত্রের সংখ্যা দাঁড়াবে ৯টিতে, যেগুলোর সম্মিলিত উত্তোলনযোগ্য গ্যাসের পরিমাণ দাঁড়াবে প্রায় আড়াই থেকে তিন ট্রিলিয়ন কিউবিক ফিটে (টিসিএফ)। এ পরিমাণ গ্যাস পুরো দেশের গ্যাসের চাহিদা মেটাতে পারবে প্রায় আড়াই থেকে তিন বছর।

বলা হচ্ছে, ভোলা নাকি গ্যাসের ওপর ভাসছে। এর মানে অদূর ভবিষ্যতে ওখানে আরও গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কারের সম্ভাবনা উজ্জ্বল। বর্তমানে উৎপাদনরত গ্যাসক্ষেত্রগুলো থেকে প্রতিদিন যে পরিমাণ গ্যাস জাতীয় গ্রিডে যুক্ত হচ্ছে, তা দিয়ে দেশের প্রতিদিনের গড় গ্যাস চাহিদার দুই-তৃতীয়াংশও মেটানো যাচ্ছে না। ফলে আমাদের গ্যাসের ঘাটতি মেটানোর জন্য এখন ক্রমবর্ধমান হারে এলএনজি আমদানি করতে হচ্ছে।

বিশ্বজুড়ে দামের প্রচণ্ড উল্লম্ফনে এলএনজি আমদানির ব্যয়ভার এখন দেশের আমদানি বিলে ক্রমবর্ধমান চাপ সৃষ্টি করছে। গত দুই বছরে এলএনজির দাম বেড়েছে প্রায় চার গুণ। ফলে এখন দেশের গ্যাসচালিত বিদ্যুৎ প্ল্যান্টের অনেকগুলো বন্ধ রাখতে হচ্ছে, দেশের শিল্প খাতেও গ্যাস সরবরাহ কাটছাঁট করতে হচ্ছে। অতএব গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কারের এ খবর জনগণের জন্য একটা বিরাট সুখকর বলতেই হবে। এর সুফল হিসেবে গ্যাস আমদানি কমানো গেলে জ্বালানি খাতের চলমান সংকট অনেকটা নিরসন হবে।

পাঠকদের স্মরণ করিয়ে দিতে চাই, মিয়ানমার ও ভারতের সঙ্গে সমুদ্রসীমা নিয়ে কয়েক দশকের বিরোধ অত্যন্ত সফলভাবে মোকাবিলা করে ইন্টারন্যাশনাল ট্রাইব্যুনাল অন লস অব দ্য সিস (ইটলস) এবং দ্য হেগের আন্তর্জাতিক আদালতে জেতে বাংলাদেশ। এ বিরোধে আইনি লড়াইয়ে একজোট হয়েছিল ভারত-মিয়ানমার। ইটলসে মিয়ানমারের পক্ষে আইনি লড়াই চালানোর দায়িত্ব নিয়েছিলেন ভারতের বাঘা বাঘা আইনবিদ। এরপরও মিয়ানমার ইটলসের ঐতিহাসিক রায় তাদের পক্ষে নিতে পারেনি। এ পরাজয়ের পর বাংলাদেশের সঙ্গে সমুদ্রসীমার ভাগ-বাঁটোয়ারা নির্ধারণ করার প্রস্তাব দিয়ে অন্য কৌশল নিয়েছিল ভারত। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং দেশের নীতিনির্ধারকেরা বিষয়টির সমাধানের দায়িত্ব আন্তর্জাতিক আদালতে রেখে দিতে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন এবং আদালতের রায় বাংলাদেশের পক্ষে গেছে। এ সমুদ্র বিজয়ের মাধ্যমে বাংলাদেশ প্রায় ১ লাখ ১৮ হাজার বর্গকিলোমিটার সমুদ্রসীমার ওপর নিরঙ্কুশ অর্থনৈতিক নিয়ন্ত্রণ (এক্সক্লুসিভ ইকোনমিক জোন) প্রতিষ্ঠা করতে সমর্থ হয়েছে। এ ঐতিহাসিক বিজয় অর্জনে চিরদিন শেখ হাসিনার সরকারকে কৃতিত্ব দিয়ে যাবে ইতিহাস।

বাংলাদেশের স্থলভাগের আয়তন যেখানে মাত্র ১ লাখ ৪৪ হাজার বর্গকিলোমিটারের সামান্য বেশি, সেখানে ১ লাখ ১৮ হাজার বর্গকিলোমিটার সমুদ্রসীমার ওপর অর্থনৈতিক নিয়ন্ত্রণ অর্জন যে বাংলাদেশের জন্য কত বড় সৌভাগ্যের বিষয়, সেটা হয়তো অনেকেই ধারণা করতে পারছে না। (এ ক্ষেত্রে ভারত ২০২১ সালে সর্বশেষ প্রচেষ্টা চালায়। আন্তর্জাতিক আদালতের রায় অনুসারে ভারত ও বাংলাদেশের সমুদ্রসীমা চিহ্নিত করে বাংলাদেশ ২০২০ সালে যে মানচিত্র জাতিসংঘে পেশ করেছে, সেটা গ্রহণ না করার জন্য জাতিসংঘকে চিঠি পাঠায়। বাংলাদেশ সরকার এর পাল্টা জবাব দিয়ে জাতিসংঘকে নিজেদের অবস্থান ব্যাখ্যা করেছে মাসখানেক আগে। বিষয়টি এখন জাতিসংঘের বিবেচনাধীন।)

কিন্তু সমুদ্র বিজয়ের সাত বছর অতিক্রান্ত হলেও সমুদ্র ব্লকগুলোতে তেল-গ্যাস আহরণের জন্য বিভিন্ন বিদেশি কোম্পানিকে ‘প্রোডাকশন শেয়ারিং কন্ট্রাক্ট’-এর ভিত্তিতে ব্লকের ইজারা প্রদানের ব্যাপারে জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়া বিস্ময়করভাবে থমকে আছে। অথচ মিয়ানমারের নিয়ন্ত্রণাধীন সমুদ্রে কয়েক বছর আগে প্রায় চার টিসিএফ গ্যাস আবিষ্কৃত হয়েছে। ওই গ্যাস এখন পুরোটাই চীনে রপ্তানি করছে মিয়ানমার। ভারত এ গ্যাসের একটা অংশ পাইপলাইনের মাধ্যমে বাংলাদেশের ভূখণ্ডের ওপর দিয়ে নিজেদের দেশে আমদানি করার জন্য প্রকল্প প্রণয়ন করে বাংলাদেশকে রাজি করানোর জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করেছিল ২০০১-২০০৬ মেয়াদের বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোট সরকারের সময়। প্রস্তাবিত ওই চুক্তিতে এমন শর্তও রাখা হয়েছিল যে সেই পাইপলাইনের হুইলিং চার্জ তো বাংলাদেশ পাবেই, তদুপরি প্রয়োজনে বাংলাদেশ ওই গ্যাসের একটা অংশও কিনে নিতে পারবে। জোট সরকারের অন্ধ ভারতবিরোধিতার কারণে বাংলাদেশ এ লোভনীয় প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছিল! (ওই প্রস্তাব গ্রহণ করলে বাংলাদেশকে চড়া দামে এলএনজি আমদানি করতে হতো না)।

সমুদ্র বিজয়ের সাত বছর অতিক্রান্ত হলেও সমুদ্র ব্লকগুলোতে তেল-গ্যাস আহরণের জন্য বিভিন্ন বিদেশি কোম্পানিকে ‘প্রোডাকশন শেয়ারিং কন্ট্রাক্ট’-এর ভিত্তিতে ব্লকের ইজারা প্রদানের ব্যাপারে জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়া বিস্ময়করভাবে থমকে আছে। অথচ মিয়ানমারের নিয়ন্ত্রণাধীন সমুদ্রে কয়েক বছর আগে প্রায় চার টিসিএফ গ্যাস আবিষ্কৃত হয়েছে। ওই গ্যাস এখন পুরোটাই চীনে রপ্তানি করছে মিয়ানমার

এরপর মহাজোট সরকার ২০০৯ সালে ক্ষমতাসীন হওয়ার পর ওই অঞ্চলের নিকটবর্তী বাংলাদেশের সমুদ্রসীমায় একটি ব্লক দক্ষিণ কোরিয়ার দাইয়ু কোম্পানিকে তেল-গ্যাস আহরণের জন্য ইজারা দিয়েছিল। দাইয়ু যথাযথ প্রস্তুতি ও সরঞ্জাম নিয়ে ওই অঞ্চলে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানের জন্য কয়েকটি জাহাজ নিয়ে উপস্থিত হলে সেখানে মিয়ানমারের নৌবাহিনী তাদের বাধা দেয় এবং ফিরে আসতে বাধ্য করে। মিয়ানমারের যুক্তি ছিল যে ওই অঞ্চলের সমুদ্রসীমার মালিকানা তাদের, বাংলাদেশের কোনো অধিকার নেই ওখানে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানের। ইটলসের রায়ে ওই বিরোধপূর্ণ অঞ্চলের মালিকানা ২০১২ সালে পেয়ে গেছে বাংলাদেশ, কিন্তু গত ৯ বছরেও ওখানে এখনো এক্সপ্লোরেশন শুরু করতে পারেনি বাংলাদেশের পক্ষ থেকে কোনো ইজারাদার কোম্পানি।

মিয়ানমার এই সমুদ্র অঞ্চলের ভূগর্ভস্থ যে গ্যাস তুলে নিঃশেষ করে দিচ্ছে, ওই গ্যাস তো বাংলাদেশও পেতে পারত। কারণ, সন্নিহিত অঞ্চলগুলোর ভূগর্ভে গ্যাসের মজুত তো শুধু মিয়ানমারের নিয়ন্ত্রণাধীন সমুদ্রসীমায় সীমাবদ্ধ থাকতে পারে না। বাংলাদেশের সমুদ্রসীমায় ওখানে গ্যাস পাওয়া যাবেই। সেখানে আরও ২৩ থেকে ২৫টি ব্লক ইজারা দেওয়ার সুযোগ রয়েছে তেল-গ্যাস অনুসন্ধান ও আহরণের জন্য। এ ব্যাপারে সরকারের দীর্ঘ ব্যর্থতার কারণ কী? যদিও সম্প্রতি ভারতের ওএনজিসি সমুদ্রের গ্যাস অনুসন্ধানের কাজ শুরু করার খবর প্রকাশিত হয়েছে।

এখন আমাদের দাবি হলো, ভোলার গ্যাস দ্রুত জাতীয় গ্যাস গ্রিডে পৌঁছানোর জন্য সেখানে জরুরি ভিত্তিতে একটি এলএনজি কনভারশন প্ল্যান্ট স্থাপন করা হোক। বিষয়টিকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার প্রদান করা হোক। এর মাধ্যমে পাইপলাইন স্থাপনের চেয়ে অনেক কম খরচে এই এলএনজি জাহাজে ভরে মহেশখালীতে স্থাপিত এলএনজি টার্মিনালে পৌঁছানো যাবে। এ রকম কনভারশন প্ল্যান্ট স্থাপনের খরচও খুব বেশি নয়। এই এলএনজিকে গ্যাসে রূপান্তরিত করার ব্যবস্থা মহেশখালী এলএনজি টার্মিনালে ইতিমধ্যেই স্থাপন করেছি আমরা। ভোলা থেকে এলএনজি মহেশখালীতে নিয়ে যাওয়ার পরিবহন খরচও বিদেশ থেকে এলএনজি আমদানির ক্ষেত্রে যে ফ্রেইট চার্জ বহন করতে হয়, তার তুলনায় অনেক কম হবে।

ড. মইনুল ইসলাম অর্থনীতিবিদ এবং অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়