মধ্য এশিয়ার দিকে নজর রাখছে ভারত

আফগানিস্তান পরিস্থিতিতে নিরাপত্তা নিয়ে মধ্য এশিয়ার দেশগুলো নিয়ে সংলাপের আয়োজন করে ভারত। ১০ নভেম্বর, ২০২১, দিল্লি
ছবি: রয়টার্স

ভারত ২৬ জানুয়ারি প্রজাতন্ত্র দিবসের অতিথি হিসেবে মধ্য এশিয়ার পাঁচ দেশ—তাজিকিস্তান, উজবেকিস্তান, তুর্কমেনিস্তান, কাজাখস্তান ও কিরগিজস্তানের নেতাদের আমন্ত্রণ জানাচ্ছে। এটি একটি সময়োপযোগী পদক্ষেপ। কারণ, আফগানিস্তানে তালেবান দখলদারি মধ্য এশিয়ার ভূরাজনৈতিক ক্ষেত্রকে বিপর্যস্ত করেছে। সে কারণে এ অঞ্চলে প্রভাব বিস্তারের জন্য দারুণ প্রতিদ্বন্দ্বিতা চলছে।

দূরবর্তী দেশ থেকে ‘গ্ল্যাডিয়েটররা’ ক্রমবর্ধমান মাত্রায় এ অঞ্চলে ধেয়ে আসছে। তারা এ অঞ্চলে উদ্বেগ বাড়াচ্ছে। ‘গ্রেট গেম’টি (উনিশ শতকের বেশির ভাগ সময় ও বিশ শতকের প্রথম ভাগে আফগানিস্তান এবং মধ্য ও দক্ষিণ এশিয়ার অঞ্চলে প্রাধান্য বিস্তার নিয়ে ব্রিটিশ সাম্রাজ্য এবং রাশিয়ান সাম্রাজ্যের মধ্যে চলা রাজনৈতিক এবং কূটনৈতিক দ্বন্দ্বকে ‘গ্রেট গেম’ বলা হয়) দীর্ঘদিন ছায়ারূপ থেকে কায়া রূপ নিয়ে কেন্দ্রের মঞ্চে উঠতে শুরু করেছে। এটি উদ্বেগের বিষয়। এ অঞ্চলে প্রাধান্য বিস্তার করতে পারলে যে বিপুল বস্তুগত লাভ অর্জন করা সম্ভব এবং তার জন্য যে কাবুলকে হাতে রাখা খুবই গুরুত্বপূর্ণ, তা সব পক্ষই বুঝতে পারছে।

এশিয়ার উজ্জ্বল সম্ভাবনার কারণে এ অঞ্চলে এখন সবার দৃষ্টি রয়েছে। ওয়াশিংটন চীন ও রাশিয়াকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য তার ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশলের একটি ভেক্টর বা বাহক মধ্য এশিয়ায় তৈরি করতে চায়। ঠিক একই সময়ে মস্কো এবং বেইজিংয়ের সরকারগুলোও এ অঞ্চলকে কবজায় রাখতে সর্বোচ্চ চেষ্টা করে যাচ্ছে।

ভারতকে এসব ‘বড় ছবি’ মাথায় রেখে একটি জটিল নেটওয়ার্কের মধ্য দিয়ে এ অঞ্চলের দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রাখতে হবে। দীর্ঘমেয়াদি স্বার্থ হাসিলের জন্য দিল্লিকে এ ক্ষেত্রে তার অসংলগ্ন মানসিকতাকে কৌশলগত সম্পদে পরিণত করতে হবে। এ ক্ষেত্রে ব্রিকস (ব্রাজিল, রাশিয়া, ইন্ডিয়া, চায়না, সাউথ আফ্রিকা জোট) এবং এসসিও (সাংহাই সহযোগিতা সংস্থা)-তে ভারতের সদস্যপদ সাহায্য করবে। সেই আলোকে মস্কোর মধ্যস্থতায় ভারত ও চীনের কৌশলগত যোগাযোগ পুনঃপ্রবর্তনের যথেষ্ট সম্ভাবনা আছে।

দিল্লির মধ্য এশিয়ার নেতাদের আমন্ত্রণ জানানোর সিদ্ধান্তকে ভারতের একান্ত একক ঘটনা হিসেবে ধরা যাবে না। এটি যে ভারতের নিজস্ব আগ্রহের বাইরেরও বেশি কিছু তা রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সাম্প্রতিক দিল্লি সফর থেকে অনুমান করা যায়। গত ১০ নভেম্বর দিল্লিতে পুতিন ও মোদির মধ্যে যে বৈঠক হয়েছে তা এবং ভারতের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত দোভালের আয়োজনে অনুষ্ঠিত সংলাপে যোগ দেওয়া রাশিয়ার নিরাপত্তা উপদেষ্টা নিকোলাই পাত্রুশেভের উপস্থিতি আঞ্চলিক নিরাপত্তার চিন্তাধারায় নতুন করে প্রাণ সঞ্চার করেছে। ইন্দো-রাশিয়ান পারস্পরিক বোঝাপড়ার ঐতিহ্যগত গভীরতা সামগ্রিকভাবে দিল্লির আঞ্চলিক কৌশলে গতিশীলতা এনে দিয়েছে। এটি চীনের সঙ্গে ভারতের উত্তেজনার ওপর একটি শান্ত প্রভাব ফেলতে পারে।

মধ্য এশিয়া এবং আফগানিস্তান বিস্তীর্ণ স্থলবেষ্টিত একটি অঞ্চল যেখানে রাশিয়া এবং চীন বড় খেলোয়াড়ের ভূমিকা রাখছে। এ অঞ্চলে ভারতের সরাসরি প্রবেশাধিকার নেই কিন্তু তার গুরুত্বপূর্ণ অংশীদারত্ব রয়েছে। চীন ও রাশিয়া—এ দুই বড় শক্তির সহযোগিতা ছাড়া দিল্লির মধ্য এশিয়াবিষয়ক কৌশল কার্যকর হতে পারবে না। সে কারণে এ দুই দেশের সঙ্গে ভারতের অংশীদারত্ব বাড়াতে হবে। এর জন্য ভারত আঞ্চলিক যোগাযোগব্যবস্থাকে তুরুপের তাস হিসেবে ব্যবহার করতে পারে। এ ছাড়া টাপি (তুর্কমেনিস্তান-আফগানিস্তান-পাকিস্তান-ইন্ডিয়া) এবং ইপি (ইরান-পাকিস্তান-ইন্ডিয়া) গ্যাস পাইপলাইন প্রকল্পের ফাইলগুলো ভারতের পুনরায় খোলার প্রয়োজন হতে পারে। এ দুটো পাইপলাইনের সঙ্গেই পাকিস্তান জড়িত আছে।

এ উভয় পাইপলাইন নির্মাণে সহায়তা করার জন্য রাশিয়া তৈরি আছে। অন্যদিকে চীনও ভারত-পাকিস্তান সম্পর্ক স্বাভাবিক করার ক্ষেত্রে নিজেদের সুবিধা দেখছে। এতে সব পক্ষেরই লাভ। একইভাবে ভারত যদি ঘুরিয়ান (হেরাতের কাছে) থেকে উত্তর আফগানিস্তানজুড়ে ৬০০ কিলোমিটার রেলপথের কাজে যুক্ত থাকে, তাহলে সেটিও সব পক্ষের লাভ নিশ্চিত করবে। এই রেল চালু হলে একদিকে তা আফগানিস্তানে কর্মসংস্থান সৃষ্টি করবে। অন্যদিকে রেল সংযোগটি চাবাহার বন্দর থেকে মধ্য এশিয়া অঞ্চলে এবং রাশিয়া ও চীনসহ বাইরের দেশগুলোতেও পণ্য পরিবহনের সুবিধা দেবে।

সাম্প্রতিক খবরাখবর থেকে বোঝা যায়, বিশকেকের নতুন নেতৃত্ব কিরগিজ অঞ্চলে রেলপথ নির্মাণের অনুমোদন দিতে প্রস্তুত। এ রেলপথ হলে তা আফগান ভূখণ্ড ব্যবহার করে উজবেক রেল গ্রিডের সঙ্গে চীনকে সংযুক্ত করবে। এ যোগাযোগের মধ্যে ভারতকে যুক্ত থাকতেই হবে। ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শংকর রাশিয়ার নেতাদের সঙ্গে সর্বশেষ বৈঠকে ভূ-অর্থনীতির ভিত্তি হিসেবে চারটি ‘সি’-এর ওপর ভারত গুরুত্বারোপ করছে বলে জানিয়েছেন। এ চার ‘সি’ হলো কমার্স (বাণিজ্য), ক্যাপাসিটি এনহান্সমেন্ট (সক্ষমতা বাড়ানো), কানেকটিভিটি (সংযুক্ততা) ও কন্ট্যাক্ট (কূটনৈতিক যোগাযোগ)।

২৬ জানুয়ারি প্রজাতন্ত্র দিবসের কুচকাওয়াজে অতিথি হিসেবে যখন মধ্য এশিয়ার পাঁচ নেতা উপস্থিত হবেন, তখন এ ধারণা তাঁদের জানিয়ে দেওয়াই হবে দিল্লির প্রধান কাজ।

ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনূদিত

  • এম কে ভদ্রকুমার ভারতের সাবেক কূটনীতিক, যিনি দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ইরান-পাকিস্তান-আফগানিস্তানবিষয়ক ডেস্কে কাজ করেছেন