মহামারি থেকে রেহাই কবে পাব, কীভাবে পাব

করোনা কবে বিদায় নেবে তা এখনো অজানা
ফাইল ছবি: প্রথম আলো

দেড় বছরের বেশি সময় ধরে বিশ্ব কোভিড-১৯-এর কশাঘাতে জর্জরিত। বিশ্বে এখন পর্যন্ত ২০ কোটির বেশি মানুষ এই মহামারিতে আক্রান্ত হয়েছেন এবং ৪২ লাখের বেশি মানুষ মারা গেছেন। এই মহামারি ঠেকাতে বিশেষজ্ঞরা স্বল্প, মধ্যম ও দীর্ঘমেয়াদি কার্যক্রম চালাচ্ছেন। মতামতের ভিন্নতা থাকলেও নিচের দুটি বিষয়ে সবাই কমবেশি একমত।

প্রথমটি হলো কোভিড-১৯ এসেছে থেকে যাওয়ার জন্য, এটি শিগগিরই চলে যাবে না অথবা যাওয়ার কোনো যুক্তিসংগত কারণ নেই। দ্বিতীয়টি হলো ভবিষ্যতে আমরা কেমন থাকব, তা নির্ভর করছে অনেক ‘অজানা’ বিষয়ের ওপর। যেমন ব্যাপক জনগোষ্ঠী ভাইরাসটির বিরুদ্ধে দীর্ঘমেয়াদি প্রতিরোধের ক্ষমতা অর্জন করবে কি না, ঋতুর পরিবর্তন ভাইরাসটির সংক্রমণের ওপর কোনো প্রভাব রাখবে কি না অথবা এর চেয়েও বড় কথা, বিভিন্ন দেশের সরকারের রাজনৈতিক সদিচ্ছা ও অঙ্গীকার কোন স্তরে আছে, তার ওপর।

এখন পর্যন্ত পাওয়া তথ্যমতে, সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা এবং মাস্ক পরিধান করা, হাতের পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখা কোভিড-১৯-এর প্রসার ঠেকানোর জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। সরকার এই গুরুত্বপূর্ণ ‘নন-ফার্মাসিউটিক্যাল’ কর্মসূচিগুলো বাস্তবায়নে দায়িত্ববান হবে কি না এবং জনগণ নিজেদের সচেতনতার জায়গা থেকে সরকারের এ ধরনের কর্মসূচিতে সহায়ক ভূমিকা পালন করবে কি না, তার ওপরও আমাদের ভবিষ্যৎ স্বাস্থ্যনিরাপত্তা অনেকাংশেই নির্ভরশীল।

গত সপ্তাহেই বিশ্বব্যাপী কোভিড-১৯ সংক্রমণ ২০ কোটি ছাড়িয়েছে, মারা গেছেন ৪২ লাখের বেশি মানুষ। কিন্তু অনেক দেশই লকডাউন শিথিল করেছে। সবাই ভাবছে, হয়তো কোভিড-১৯ পৃথিবী থেকে চলে যাচ্ছে। আসলেই কি তাই? আমরা অনেকেই ভুলে যাচ্ছি, পৃথিবী এক দীর্ঘমেয়াদি সমস্যার সংকটে আবর্তিত। আরও তরঙ্গ—দ্বিতীয়, তৃতীয়, এমনকি চতুর্থ ঢেউ শেষমেশ পৃথিবীকে কোন জায়গায় নিয়ে যাবে, তা কি কোনো বিজ্ঞানী সঠিক করে বলতে পেরেছেন? না, পারেননি।

যদি ‘কোভিড-১৯ টিকা’ দেওয়ার পর এক বছরের জন্য রোগ প্রতিরোধক্ষমতা অর্জিত হয়, যা করোনা গ্রুপের অন্য সব ভাইরাসের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য, তাহলে কোভিড-১৯ তরঙ্গ ২০২৫ সালের পরও যে আমাদের আঘাত করবে, তা বলাই বাহুল্য। বিজ্ঞানকে বিশ্বাস করলে কোভিড-১৯-এর এই দীর্ঘমেয়াদি তরঙ্গকে অবিশ্বাস করার কোনো যুক্তিযুক্ত কারণ নেই।

কোভিড-১৯-এর বিস্তারের ধরন সব দেশে একই রকম নয়। চীন, রুয়ান্ডা ও নিউজিল্যান্ডের মতো দেশগুলো, যেখানে সরকার প্রথম থেকেই সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করেছে, সঠিকভাবে লকডাউন বাস্তবায়ন করেছে, এসব দেশ এখন অনেকটাই নিরাপদ। সেখানে কোভিড-১৯-এর সংক্রমণ একেবারেই কম। তাদের জনসাধারণের জীবনযাত্রা স্বাভাবিক হয়ে আসছে। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্র, ব্রাজিল ও ভারতের মতো দেশগুলো, যাদের সরকার কোভিড-১৯-এর ভয়াবহতাকে প্রথম দিকে তেমনভাবে আমলে নেয়নি এবং সাধারণ জনগণকে লকডাউনসহ সব প্রতিরোধমূলক কর্মসূচিতে কঠোরভাবে সম্পৃক্ত করেনি, সেসব দেশে এখনো রোগের বিস্তার ও মৃতের সংখ্যা বেড়েই চলেছে। বাংলাদেশের বর্তমান দুরবস্থা এর একটি উদাহরণ। অনেক বিশেষজ্ঞই মনে করছেন, প্রথম দিকে আমলে না নেওয়া দেশগুলোতে আগস্ট-সেপ্টেম্বরে আরেকটি তরঙ্গের সৃষ্টি হবে, যার ফলে লাখ লাখ মানুষের করুণ মৃত্যু হতে পারে।

ব্রাজিলের আনহেম্রি মরুম্বি বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল বিজ্ঞানী ২ লাখ ৫০ হাজার গাণিতিক মডেল বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছেন, মানুষের দৈনন্দিন জীবনের চলাফেরায় একটু পরিবর্তন আনলে, যেমন সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখলে, মাস্ক পরলে ও নিয়মিতভাবে হাত ধুলে ক্রমাগতভাবে সামগ্রিক জনগোষ্ঠীর মধ্যে কোভিড-১৯-এর সংক্রমণ কমে আসে। এই বিজ্ঞানীরা দেখিয়েছেন, একটি জনগোষ্ঠীর ৫০ থেকে ৬৫ শতাংশ মানুষ এ ধরনের সাবধানতা অবলম্বন করলে লকডাউনের মতো কঠোর কর্মসূচি প্রতি ৮০ দিন পরপর ক্রমাগতভাবে শিথিল করা যায় এবং ভ্যাকসিনের মতো গুরুত্বপূর্ণ কর্মসূচির সঠিক বাস্তবায়ন ছাড়াই আগামী ২ বছরের জন্য একটি দেশকে কিছুটা হলেও নিরাপদ করা সম্ভব। কিন্তু যেটা দরকার সেটা হলো, দৈনন্দিন জীবনযাপনের জন্য মানুষের অভ্যাসের পরিবর্তন করা। শুধু এর মাধ্যমেই কোভিড-১৯-এর ভয়াবহতা কমিয়ে আনা সম্ভব।

তবে যেসব অঞ্চলে কোভিড-১৯-এর ভয়াবহতা কমে আসবে, সেখানে অবশ্যই নিবিড় নজরদারি বাড়াতে হবে। যাতে করে দ্রুততার সঙ্গে নতুন কেস শনাক্ত করা যায় এবং এই কেসের প্রাথমিক কন্ট্যাক্টগুলো শনাক্ত করে আলাদা করা যায়। এটা করতে পারলে কোভিড-১৯-এর আর একটি নতুন তরঙ্গকে অবশ্যই প্রতিহত করা সম্ভব। ‘লন্ডন স্কুল অব ট্রপিক্যাল মেডিসিন’-এর একদল গবেষক তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছেন যে কন্টাক্ট ট্রেসিংয়ের মাত্রা যদি দৈনিক ৮০ শতাংশে উঠিয়ে আনা যায়, তবে কোভিড-১৯-এর প্রাদুর্ভাব কার্যকরভাবে ঠেকানো সম্ভব। এ ক্ষেত্রে ডিজিটাল প্রযুক্তি অবশ্যই ব্যবহার করতে হবে, যা কন্টাক্ট ট্রেসিংয়ের সমগ্র কর্মসূচিতে একটি নতুন মাত্রা যোগ করতে সক্ষম।

যেসব অঞ্চলে কোভিড-১৯-এর ভয়াবহতা কমে আসবে, সেখানে অবশ্যই নিবিড় নজরদারি বাড়াতে হবে। যাতে করে দ্রুততার সঙ্গে নতুন কেস শনাক্ত করা যায় এবং এই কেসের প্রাথমিক কন্ট্যাক্টগুলো শনাক্ত করে আলাদা করা যায়। এটা করতে পারলে কোভিড-১৯-এর আর একটি নতুন তরঙ্গকে অবশ্যই প্রতিহত করা সম্ভব।

কিন্তু বাস্তবে এত অধিক হারে কন্টাক্ট ট্রেসিং করা দুরূহ। বিশেষ করে যেসব দেশে কোভিড-১৯ সমাজের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছে। ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজির একদল বিজ্ঞানী ৮৪টি দেশের কোভিড-১৯-সংক্রান্ত তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছেন, আজ পর্যন্ত কোভিড-১৯ সংক্রমণ-সংক্রান্ত যে তথ্য প্রকাশ করা হয়েছে, বাস্তবে সংক্রমণের সংখ্যা অন্ততপক্ষে এর চেয়ে ১২ গুণ বেশি এবং মৃত্যুর ক্ষেত্রে এটা ৫০ শতাংশের বেশি। সুতরাং এ কথা বলা বাহুল্য, কোভিড-১৯-এর আসল চিত্র আমাদের ধারণার চেয়ে অনেক গুণ বেশি।

এখন প্রশ্ন করা যেতে পারে, ২০২১ সাল বা এর পরে আমরা কোন অবস্থায় উপনীত হব? কোভিড-১৯ কি একইভাবে বছরের পর বছর ঋতুর সঙ্গে তাল মিলিয়ে ক্রমাগত আঘাত করতে থাকবে? এই প্রশ্নের সহজ উত্তর হলো, আমাদের হাতে আসলে নিশ্চিত করে বলার মতো কোনো বিজ্ঞানভিত্তিক তথ্য নেই। এখন পর্যন্ত যা শোনা যায়, এর অনেকটাই অনুমানভিত্তিক।

কোভিড-১৯ টিকা ‘হাম’বা ‘পোলিও’র মতো দীর্ঘমেয়াদি সুরক্ষা না দিলেও এ পর্যন্ত গবেষণায় দেখা গেছে, মানবদেহে কোভিড-১৯-এর বিরুদ্ধে ‘অ্যান্টিবডির’ মাত্রা প্রথম ছয় মাস পর্যন্ত অনেক বেশি থাকে এবং পরে কমতে থাকলেও দুই বছর পর্যন্ত কার্যকর থাকে। শুধু অ্যান্টিবডি উৎপাদন নয়, ‘বি’ ও ‘টি’ মেমোরি সেল উৎপাদনের মাধ্যমেও টিকা আমাদের শরীরে দীর্ঘমেয়াদি সুরক্ষা দিতে পারে। কিন্তু এটা শুধুই অনুমান।

আসল সত্য জানতে আমাদের আরও কিছুদিন অপেক্ষা করতেই হবে। আসল সত্য যা-ই হোক, এ পর্যন্ত পাওয়া বৈজ্ঞানিক তথ্যমতে, নিচে উল্লেখ করা দুটি কার্যক্রমকে কোন দেশ কতটা সফলভাবে বাস্তবায়ন করতে পারল, তার ওপর নির্ভর করবে কোভিড-১৯-এর ভয়াবহতা থেকে দেশের মানুষের জীবন ও জীবিকাকে কতটা সুরক্ষা দিতে পারবে।
প্রথমত, ব্যাপক জনগোষ্ঠীর দীর্ঘদিনের জীবনযাপনের পদ্ধতিতে পরিবর্তন আনা, যাতে করে তারা সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখে বা অযাচিত ভিড় এড়িয়ে চলে, ঘরের বাইরে বেরোলেই মাস্ক পরিধান করে এবং যতটা সম্ভব ঘন ঘন সাবান অথবা হ্যান্ড স্যানিটাইজার দিয়ে হাত পরিষ্কার করে।

দ্বিতীয়ত, সরকারকে অবশ্যই টিকাদান কর্মসূচিকে বেগবান করতে হবে। ধূমপায়ী, দীর্ঘমেয়াদি রোগ, যেমন ডায়াবেটিস ও হৃদ্‌রোগে আক্রান্ত ব্যক্তি এবং বৃদ্ধ জনগোষ্ঠীকে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে টিকার আওতায় আনতে হবে। বাজারে টিকার স্বল্পতা থাকলেও দ্রুত টিকা কূটনীতির মাধ্যমে টিকার জোগান নিশ্চিত করতে হবে। জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে স্বাস্থ্য খাতকে কাজ করতে হবে, যাতে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর কাছে অতি সহজেই পৌঁছানো যায়।

সর্বোপরি ‘নন-ফার্মাসিউটিক্যাল’ কর্মসূচি ও টিকাদান কর্মসূচির সফল বাস্তবায়নে নীতিগত ও প্রশাসনিক সব বাধা সরকারকেই দ্রুত দূর করতে হবে। স্বাস্থ্য প্রশাসনকে দুর্নীতিমুক্ত করে স্বচ্ছ, কার্যকর ও বেগবান করতে হবে। তা না হলে ইতিহাসের কাছে সরকারকেই দায়বদ্ধ ও দায়ী থাকতে হবে।

ড. জিয়াউদ্দিন হায়দার হেলথ সিস্টেম ইমপ্রুভমেন্ট ফোরামের প্রতিষ্ঠাতা