মাখন বনাম বন্দুক

শিশু শ্রেণির অর্থনীতি ক্লাসে আমাদের শিক্ষকেরা আমাদের এবং আমরা আমাদের ছাত্রদের ‘উৎপাদন সম্ভাবনা বক্ররেখা (প্রোডাকশন পসিবিলিটিজ কার্ভ)’ শিখিয়েছেন ও শিখিয়েছি। যার মূলকথা হলো বিদ্যমান সম্পদ ও প্রযুক্তি দিয়ে আপনি একটি নির্দিষ্ট সর্বোচ্চসংখ্যক কেবল মাখন অথবা কেবল বন্দুক উৎপাদন করতে পারেন। আবার চাইলে কিছুসংখ্যক মাখন ও কিছুসংখ্যক বন্দুকের সমাহার উৎপাদন করতে পারেন। এ নিয়ম সম্পদশালী ও প্রযুক্তিতে প্রাগ্রসর যুক্তরাষ্ট্র অথবা সম্পদ-দরিদ্র এবং প্রযুক্তিক্ষেত্রে পশ্চাৎপদ দক্ষিণ সুদান উভয়ের জন্য সমানভাবে প্রযোজ্য। রেখাটির অবতল (কনকেভ) আকৃতি এটা নির্দেশ করে যে আপনি ক্রমাগতভাবে বন্দুক উৎপাদন বাড়াতে চাইলে অধিকতর হারে মাখন উৎপাদন কমাতে হবে। আবার ক্রমাগতভাবে মাখন উৎপাদন বাড়াতে চাইলে অধিকতর হারে বন্দুক উৎপাদন কমাতে হবে। কেবল দুই পণ্যের এ অর্থনীতিতে বলা যায় মাখন হচ্ছে শান্তি ও সুস্বাস্থ্যের প্রতীক পণ্য। আর বন্দুক হচ্ছে যুদ্ধ ও সংঘাতের প্রতীক পণ্য।

আমি বর্তমান সময়ে ক্লাসে বিষয়টি পড়ালে ‘মাখন’ পণ্যটির বদলে সেখানে ‘ভ্যাকসিন’ শব্দটি প্রতিস্থাপন করতাম। এর ফলে প্রতিযোগী পণ্যগুলো দাঁড়াত ‘ভ্যাকসিন বনাম বন্দুক’। বর্তমান দুঃসময়ে বোধ করি তা আরও বেশি প্রাসঙ্গিক হতো। কেননা, বন্দুক জীবনসংহারী ও ভ্যাকসিন জীবন বাঁচানোর পণ্য। তা ছাড়া স্বাস্থ্যসচেতন পাঠকের কাছে খাদ্য হিসেবে মাখন এখন আর ততটা জনপ্রিয় নয়।

সম্প্রতি আফগানিস্তানে মার্কিন দখলদার বাহিনীর অবমাননাকর পরাজয় ‘মাখন বনাম বন্দুক’ বিতর্ককে আবার সামনে নিয়ে এসেছে। ব্রাউন বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়াটসন ইনস্টিটিউটের ‘যুদ্ধের মূল্য’ শিরোনামের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, ২০০১-২১ সময়ে আফগান যুদ্ধে (পাকিস্তানেও বিস্তৃত) মার্কিনদের ব্যয় হয়েছে ২ দশমিক ৩ ট্রিলিয়ন ডলার। সরাসরি এ যুদ্ধের ফলে প্রাণহানি হয়েছে ২ লাখ ৪১ হাজার আদম সন্তানের, যার মধ্যে ২ লাখ ৩০ হাজারের বেশি নিরীহ আফগান নাগরিক। ২০ বছর পর দেখা যাচ্ছে যে এ অভিযানের ফলাফল শূন্য এবং অবমাননাকর মার্কিন পরাজয়। পুতুল সরকার, দোভাষী, তাঁবেদার সৈন্য ও পুলিশ—কিছুই এ পরাজয় ঠেকাতে পারেনি।

তাই অর্থনীতিবিদ জেফ্রি স্যাকস তাঁর ‘বালুকণায় রক্ত’ শিরোনামের প্রবন্ধে লিখেছেন, আফগানিস্তানে মার্কিন ব্যয়ের সিংহভাগই সামরিক ব্যয়। মোট ব্যয়ের ২ শতাংশের কম ব্যয়িত হয়েছে আফগানিস্তানের অবকাঠামো উন্নয়ন ও দারিদ্র্য বিমোচন কর্মসূচিতে। সামরিক খাতে ব্যয় কমিয়ে মার্কিনরা সুপেয় পানি, স্বাস্থ্যব্যবস্থার উন্নয়ন, স্কুল, ক্লিনিক স্থাপন, কৃষির উপকরণ ও সম্প্রসারণ, ডিজিটাল কানেকটিভিটিতে বিনিয়োগ করলে দেশটি অর্থনৈতিক দুরবস্থা কাটিয়ে উঠতে পারত এবং তা করলেই আফগানিস্তানের অনুরূপ দেশে হানাহানি ও রক্তপাত বন্ধ হতো। এর ফলে যুক্তরাষ্ট্র আফগানিস্তানের জনগণের মিত্র বলে বিবেচিত হতো। তাদের অসম্মানজনকভাবে দেশটি থেকে বিতাড়িত হতে হতো না।

ইতিমধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতি পরিবর্তনের ঘোষণা দিয়েছেন দেশটির প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। এর মধ্য দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতিতে নতুন যুগের সূচনা ঘটবে, যেখানে সামরিক শক্তির ওপর নির্ভরতা কমে আসবে। আর অন্য দেশ ‘ঠিক করতে’ যুদ্ধে যাবে না যুক্তরাষ্ট্র। এটি একটি সঠিক উপলব্ধি বলে আমরা মনে করি। একসময় বলা হতো ‘কূটনীতির শক্তি বন্দুকের নলের ওপর নির্ভরশীল।’ এখন তা পাল্টে ‘যুদ্ধের বিকল্প কূটনীতি’ ভাবার সময় এসেছে।

এ জন্য লেখিকা অরুন্ধতী রায় সম্প্রতি এক বক্তব্যে টিটকারি দিয়ে বলেন, যুদ্ধের একমাত্র যৌক্তিকতা হিসেবে বলা হয়েছে যে এর মাধ্যমে তালেবানকে উৎখাত করে সেখানে আফগান নারীদের বোরকামুক্ত করা হবে। তাহলে কি মার্কিন মেরিনরা আফগানিস্তানে একটি ফেমিনিস্ট মিশনে কাজ করছেন! যদি তা-ই হয়, একই কারণে যুক্তরাষ্ট্রের মিত্র সৌদি আরবে হামলা চালানো উচিত হবে। এ ছাড়া ভারত, পাকিস্তান, বাংলাদেশেও এ ধরনের নানা ধর্মীয় নিপীড়ন ও বৈষম্যমূলক ব্যবস্থা প্রচলিত আছে। তাই বলে যুক্তরাষ্ট্র কি দিল্লি, ইসলামাবাদ ও ঢাকায় বোমাবর্ষণ করবে? অরুন্ধতীর মূল কথা হলো বোমাবাজি ও রক্তপাত ঘটিয়ে কোনো দেশ থেকে ধর্মান্ধতা ও গোঁড়ামি হটানো যাবে না। আফগান নারী ও জনগণকে তাদের মুক্তি ও অধিকার অর্জনের সংগ্রাম নিজেদের এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে। কোনো বহিঃশক্তি, এমনকি পরাশক্তি তাদের হয়ে এ কাজ করতে পারবে না। আফগানিস্তানে মার্কিন ও সোভিয়েত পরাজয়ের মূল শিক্ষা এটাই।

সারা বিশ্বকে সাম্প্রতিক ঘটনাবলি থেকে শিক্ষা নিয়ে বন্দুক, বোমা উৎপাদন থেকে সরে এসে ভ্যাকসিন, মাখনের অনুরূপ পণ্য উৎপাদনে মনোনিবেশ করতে হবে। একবার ভাবুন, এখন দরিদ্র দেশগুলোতে ভ্যাকসিন সরবরাহ করে যে পরিমাণ শুভেচ্ছা ও মৈত্রী অর্জন করা যাবে, বিলিয়ন বিলিয়ন ডলারের, কয়েক দশকজুড়ে সামরিক অভিযান চালিয়েও তা পাওয়া সম্ভব হবে কি?

প্রধানত যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ জনসমর্থনের অভাবে সে দেশের পরপর দুই প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ও বাইডেন আফগানিস্তান থেকে সেনা প্রত্যাহার করেন। কিন্তু তাই বলে যুক্তরাষ্ট্রে যুদ্ধের সপক্ষের লবি, বিশেষত অস্ত্রসম্ভার উৎপাদনে লগ্নিকারক ব্যবসায়ী ও ঠিকাদারেরা বসে থাকবে না। বিভিন্ন দেশের খনিজ ও অন্যান্য সম্পদ লুণ্ঠনচেষ্টা বন্ধ থাকবে না। তা ছাড়া দেশে দেশে জনসমর্থনবঞ্চিত শিখণ্ডী, তাঁবেদার ও পদলেহীরাও তাদের বিদেশি প্রভুদের সাদর আমন্ত্রণ জানাতে দ্বিধা করবে না। তাদের সংখ্যাও যে কম নয়, তা কাবুল বিমানবন্দরত্যাগী বিমানে ওঠার প্রাণান্ত চেষ্টা থেকে বোঝা গেল।

এ ছাড়া সোভিয়েত ইউনিয়ন ও যুক্তরাষ্ট্র বিদেশে দখলদারির বিফলতার শিক্ষা পেলেও চীন, অন্যান্য উঠতি শক্তি সোভিয়েত ইউনিয়ন ও যুক্তরাষ্ট্রের পশ্চাদপসরণকে তাদের নিজেদের জন্য সুযোগ বলে ভাবতে পারে। তাদের মনে রাখতে হবে যে পরাশক্তি সোভিয়েত ইউনিয়ন ও যুক্তরাষ্ট্র যেখানে আফগানিস্তানের মতো দরিদ্র দেশে অভিযান পরিচালনা করে ব্যর্থ হয়েছে, সেখানে উঠতি বা ক্ষুদ্র শক্তির সাফল্যের সম্ভাবনা নেই বললেই চলে।

তাই যে কথা দিয়ে শুরু করেছিলাম, তাতে ফিরে আসি। সারা বিশ্বকে সাম্প্রতিক ঘটনাবলি থেকে শিক্ষা নিয়ে বন্দুক, বোমা উৎপাদন থেকে সরে এসে ভ্যাকসিন, মাখনের অনুরূপ পণ্য উৎপাদনে মনোনিবেশ করতে হবে। একবার ভাবুন, এখন দরিদ্র দেশগুলোতে ভ্যাকসিন সরবরাহ করে যে পরিমাণ শুভেচ্ছা ও মৈত্রী অর্জন করা যাবে, বিলিয়ন বিলিয়ন ডলারের, কয়েক দশকজুড়ে সামরিক অভিযান চালিয়েও তা পাওয়া সম্ভব হবে কি?

কথা হচ্ছে বিশ্বসম্প্রদায় ও নেতারা কেন এটা করবেন? এককথায় এর জবাব হলো ‘শান্তির লভ্যাংশ’ অর্জন করতে হবে। ব্রাজিলের ইগারাপে ইনস্টিটিউটের প্রকাশিত গবেষণাপত্র ‘হানাহানি পরিহারের লভ্যাংশের প্রক্ষেপণ ২০২০-৩০’ থেকে দেখা যায় যে স্থিতাবস্থা অব্যাহত থাকলে উল্লিখিত সময়ে আরও তিনটি দেশ যুদ্ধে জড়িয়ে পড়বে এবং ৯টি দেশ যুদ্ধের ঝুঁকিতে পড়বে। ফলে যুদ্ধের কারণে সামরিক ও বেসামরিক ৬ লাখ ৭৭ হাজার ২৫০ প্রাণহানি ঘটবে। এর বিপরীতে যদি হানাহানি রোধের প্রচেষ্টা ২৫ শতাংশ সফল হয়, তবে ১ লাখ ৯ হাজার প্রাণহানি এড়ানো সম্ভব হবে, আগামী দশকে আরও ১০টি দেশে শান্তি প্রতিষ্ঠিত হবে এবং ৩ দশমিক ১ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার সাশ্রয় হবে।

যদি হানাহানি রোধের প্রচেষ্টা ৫০ শতাংশ সফল হয়, তবে আগামী দশকে ২ লাখ ৫ হাজার প্রাণহানি এড়ানো সম্ভব হবে, আরও ১৭টি দেশে শান্তি প্রতিষ্ঠিত হবে এবং ৬ দশমিক ৬ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার সাশ্রয় হবে। যদি হানাহানি রোধের প্রচেষ্টা ৭৫ শতাংশ সফল হয়, তবে ২ লাখ ৯১ হাজার প্রাণহানি এড়ানো সম্ভব হবে, আরও ২৩টি দেশে শান্তি প্রতিষ্ঠিত হবে এবং ৬ দশমিক ৬ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার সাশ্রয় হবে। সামরিক অভিযানের নিষ্ফলতা এখন প্রমাণিত। এর বিপরীতে শান্তির লভ্যাংশ বিশাল। তাই এখনই বিশ্বসম্প্রদায় ও এর নেতাদের সিদ্ধান্ত নিতে হবে। এর ওপর নির্ভর করছে মানবজাতির ভবিষ্যৎ।

শুধু বিদেশে অভিযানের ক্ষেত্রেই নয়, দেশের অভ্যন্তরেও সামরিক ও আইনশৃঙ্খলা খাতের ব্যয় কমিয়ে সামাজিক খাত ও সুরক্ষায় ব্যয় বাড়াতে হবে। জলবায়ু পরিবর্তন ও অতিমারির মতো দুর্যোগ মোকাবিলায় বিনিয়োগ বাড়াতে হবে।

শান্তি অন্বেষার সময় এখন। বন্দুক ও বোমা উৎপাদন কমিয়ে ভ্যাকসিন ও মাখন উৎপাদন অবশ্যই বাড়াতে হবে।

মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান সাবেক সচিব ও অর্থনীতিবিদ

[email protected]