মাতৃভাষায় পঠন-দক্ষতা প্রবৃদ্ধি বাড়ায়

বিশ্বাস করুন আর না-ই করুন, আপনি যদি শুধু মাতৃভাষা বাংলা সুন্দরভাবে পড়তে পারে এমন শিশুর সংখ্যা ১০ শতাংশ বাড়াতে পারেন, তাহলে দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি শূন্য দশমিক ৩ শতাংশ বাড়বে।

আপনি বলতে পারেন, অর্থ বুঝে পড়া মানে ব্যাকরণ, বিচার-বিশ্লেষণ, ভাবসম্প্রসারণ, সারাংশ বুঝতে পারা-এত সব তো কঠিন কাজ।

আর এত দক্ষতা বাড়লে তো প্রবৃদ্ধি বাড়বেই, এটা আর এমনকি?

না, এত কিছু জানার দরকার নেই। শুধু পড়তে জানার কথাই বলছি। একেবারে সাদামাটা ব্যাপার। আপনি দ্বিতীয় শ্রেণির শিক্ষার্থী শিশুদের শুধু বইয়ের একটি পাতা গড়গড় করে পড়ে যেতে বলুন। আর আপনার মোবাইলে স্টপওয়াচ চালু করে চোখ রাখুন। সেই শিশু যদি মিনিটে অন্তত ৪০টি শব্দ পড়তে পারে, তাহলে আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী সেই শিশু পঠন-দক্ষতা অর্জন করেছে বলে ধরে নেওয়া হয়। ইংরেজি ভাষা পাঠে এই মানদণ্ড যুক্তরাষ্ট্রে অনুসরণ করা হয়। বাংলার ক্ষেত্রে যদিও সে রকম কোনো গৃহীত মানদণ্ড নেই, আমরা আন্তর্জাতিক মানদণ্ড আপাতত ব্যবহার করতে পারি। মিনিটে ৪০টি শব্দ মানে সেকেন্ডে একটি শব্দেরও কম। এটা খুবই সম্ভব।

আর যদি পঞ্চম শ্রেণির একজন শিক্ষার্থী অর্থ বুঝে মিনিটে ৬০-৬৫ শব্দ পড়তে পারে, তাহলে আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী সে প্রাথমিক পর্যায়ে পঠন-দক্ষতা অর্জন করেছে বলে ধরে নেওয়া যায়। মনে করবেন না, তাকে কোনো বিদেশি ভাষায় কিছু পড়তে বলা হচ্ছে। একেবারে সোজা বাংলায়, আমাদের মাতৃভাষা বাংলায় সে না থেমে, পদে পদে আটকে না গিয়ে, অর্থ বুঝে যদি একটানা মিনিটে ৪০টি শব্দ পড়তে পারে, তাহলে সে পঠন-দক্ষতায় উত্তীর্ণ। আর এ রকম পড়তে পারা শিশুর সংখ্যা যদি মাত্র ১০ শতাংশ বাড়ে, তাহলে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি যতটা বাড়বে, তা সামান্য মনে হতে পারে, কিন্তু আসলে সামান্য নয়।

আসুন, একটু অন্যভাবে দেখি। শূন্য দশমিক ৩ শতাংশ! যদি ১০ শতাংশের ১০ গুণ, মানে ১০০ শতাংশ, অর্থাৎ সব শিশু মাতৃভাষা বাংলায় সুন্দরভাবে পড়তে পারে, যদি অর্থ বুঝে মিনিটে ৪০টি শব্দ পড়তে পারে, তাহলে তো প্রবৃদ্ধি বাড়বে ৩ শতাংশ। আর এই ৩ শতাংশের জন্য আমরা মাথা কুটে মরছি। আমাদের এখন গড় প্রবৃদ্ধি প্রায় ৬-৭ শতাংশ। ২০২১ সালে মধ্য আয়ের দেশে উন্নীত হতে দরকার মাত্র আর ১-২ শতাংশ। আর আমরা তো ৩ শতাংশ অনায়াসেই বাড়িয়ে ফেলতে পারি। কারণ, সাত-আট মাস বয়সে আমরা মাতৃভাষা বাংলায় কথা বলা শুরু করে দিই। তাহলে সাত-আট বছর বয়সের মধ্যে, মানে দ্বিতীয় বা তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষালাভের পর শুধু মাতৃভাষায় ভালোভাবে পড়তে পারব না?

এখন আপনি বলতে পারেন, কে বলেছে পড়তে পারলেই প্রবৃদ্ধি তরতর করে বাড়বে? না, এটা আমার বানানো কথা না। গত ২০ জানুয়ারি প্রথম আলো কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত গোলটেবিল বৈঠকে ইউএসএআইডি ও সেভ দ্য চিলড্রেন ইন বাংলাদেশের সহযোগিতায় আমরা মাতৃভাষায় পঠন-দক্ষতার বিভিন্ন দিক নিয়ে আলোচনা করছিলাম। সেখানে বিভিন্ন আলোচকের কথায় বোঝা গেল, শুধু মাতৃভাষা দিয়েই মধ্য আয় তো বটেই, উচ্চ-মধ্য আয়, এমনকি উদীয়মান অর্থনীতির (ইমার্জিং ইকোনমিক) দেশে উত্তরণও কঠিন কিছু নয়।

ইউএসএআইডির শিক্ষাবিষয়ক টিম লিডার কেট মেলনি বললেন, পড়তে পারা শিশুর সংখ্যা ১০ শতাংশ বাড়লে প্রবৃদ্ধি বাড়ে শূন্য দশমিক ৩ শতাংশ। এটি আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত একটি হিসাব। তিনি এটাও বললেন, বাংলাদেশ মধ্য আয়ের দেশ হতে চলেছে। তাই তার মানবসম্পদ উন্নয়ন দরকার। এ ক্ষেত্রে পঠন-দক্ষতা খুব গুরুত্বপূর্ণ।

যদি তা-ই হয়, তাহলে তো আমরা এগিয়ে যাওয়ার পরিষ্কার একটি দিকনির্দেশনা পেলাম। পঠন-দক্ষতার যে এত বড় ভূমিকা রয়েছে, তা কি আমরা সব সময় মনে রাখি?

ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক মঞ্জুর আহমেদ তাঁর গবেষণা প্রবন্ধে জানিয়েছেন, আমাদের শিশুদের মাতৃভাষা বাংলায় পঠন-দক্ষতা যাচাইয়ের এক সরকারি জরিপের ফল অনুযায়ী দ্বিতীয় শ্রেণির শিশুদের মাত্র ৩০ ভাগ শিক্ষার্থী ঠিকভাবে বাংলা পড়তে পারে। সত্যিই দুঃখজনক।

অথচ একটু চেষ্টা করলেই সংখ্যাটা ১০০ ভাগ করা যায়। সেভ দ্য চিলড্রেনের নির্ধারিত কয়েকটি প্রকল্প এলাকায় ১০০ ভাগ শিশু বুঝেশুনে বাংলা গড়গড় করে পড়তে পারে। ওরা স্কুলে পাঠাগার স্থাপন করেছে। ইউএসএআইডি সহযোগিতা দিচ্ছে। প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মো. আবু হেনা মোস্তফা কামাল বললেন, তাঁরাও উদ্যোগ নিচ্ছেন। সবাই আশাবাদী যে পঠন-দক্ষতা বাড়ানো সম্ভব। শুধু সবার, বিশেষভাবে নীতিনির্ধারকদের মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দুতে বিষয়টিকে রাখতে হবে।

আমরা যদি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রতিটি শিশুর মা-কে বুঝিয়ে বলি, তিনি প্রতি সন্ধ্যায় তাঁর সন্তানকে বলবেন স্কুলের বাংলা বইয়ের এক পাতা পড়ে শোনাতে। মা হয়তো তেমন লেখাপড়া জানেন না। হয়তো তিনি শিক্ষাবঞ্চিত। তাতে কোনো সমস্যা নেই। তিনি শুধু লক্ষ করবেন, তাঁর সন্তান একবারও না থেমে পড়ে যেতে পারছে কি না। যদি না পারে, তাহলে পরদিন স্কুল থেকে শব্দগুলো অর্থসহ বুঝে আসতে বলবেন। শিক্ষককে বিশেষ আদর-যত্ন করে পড়াতে হবে। বুঝিয়ে দিতে হবে। পরদিন মা আবার পড়া ধরবেন। এই পদ্ধতির পড়াশোনা চালু হয়ে গেলে আমাদের শিশুদের প্রায় সবাই বছরখানেকের মধ্যেই মাতৃভাষায় পঠন-দক্ষতা অর্জন করতে পারবে। সেদিন গোলটেবিল বৈঠকে বিশেষজ্ঞদের আলোচনায় এ রকম একটি সম্ভাবনার কথা প্রায় সবাই বলেছেন।

মাতৃভাষায় পঠন-দক্ষতার গুরুত্ব এত বেশি কেন? কারণ যে শিশু মাতৃভাষায় দক্ষতা অর্জন করতে পারে, সে সহজেই ইংরেজি বা অন্য এক বা দুটি বিদেশি ভাষা শিখে নিতে পারে। তখন তার সামনে জ্ঞান-বিজ্ঞানের শীর্ষে চলে যাওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেড়ে যায়। এটাই তো আমরা চাই।

আমাদের প্রাথমিক শিক্ষায় এই দিকটির প্রতি গুরুত্ব অবশ্যই দেওয়া হয়। কিন্তু সেখানে পরিবার ও স্থানীয় সমাজের একটা ভূমিকা পালন করতে হবে।

মাতৃভাষায় শুধু অর্থ বুঝে সুন্দরভাবে পড়তে পারার দক্ষতা অর্জন তো কঠিন কিছু না। আমাদের পক্ষে এটা খুবই সম্ভব। আসলে এ দিকটায় সুনির্দিষ্টভাবে মনোযোগ দিলে আগামী বছর একুশে ফেব্রুয়ারিতে দেশের সব শিশু সগর্বে বলতে পারবে, ‘আমরা মাতৃভাষা বাংলা গড়গড় করে পড়তে পারি। আমরা মাতৃভাষায় দক্ষতা অর্জন করেছি।’

আব্দুল কাইয়ুম: প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক
[email protected]