মানবসম্পদ উন্নয়ন চাইলে শিক্ষা-স্বাস্থ্যে বাজেট বাড়াতে হবে

বাংলাদেশ সরকারের অর্থমন্ত্রী জুন মাসের প্রথম সপ্তাহে সংসদে ২০২২-২০২৩ অর্থবছরের বার্ষিক আর্থিক পরিকল্পনা বা বাজেট পেশ করেছেন। আশা করা যায়, অন্য বছরের মতো এবারও জুন মাসের শেষ দিনের মধ্যে এই বাজেট সংসদে পাস হয়ে যাবে। বিশ্বের সবচেয়ে বেশি ঘনবসতির স্বল্প আয়তনের, প্রাকৃতিক সম্পদের অভাবের এই দেশে প্রধান সম্পদ মানুষ। মানবসম্পদ উন্নয়নে সরাসরি ভূমিকা রাখে যে স্বাস্থ্য ও শিক্ষা, সে দুটো খাতের একটিও বাজেটে যথাযথ গুরুত্ব পায়নি।

উৎপাদনশীল ও অনুৎপাদনশীল খাত

সরকারি অর্থের বরাদ্দ ও খরচ উৎপাদনশীল ও অনুৎপাদনশীল উভয় খাতেই হতে পারে। উৎপাদনশীল খাত বলতে সেগুলোকে বোঝায় যেসব আর্থিক খাত প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে অর্থ ও সম্পদ সৃষ্টিতে ভূমিকা রাখে। এসব খাতের মধ্যে রয়েছে কৃষি, শিল্প, যোগাযোগ, স্বাস্থ্য, শিক্ষা ইত্যাদি। অনুৎপাদনশীল খাতের মধ্যে পড়ে জনপ্রশাসন (কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা প্রদান), প্রতিরক্ষা, বিনোদন, ক্রীড়া ইত্যাদি।
কিছু উৎপাদনশীল খাত এমনও আছে, অর্থনৈতিক উন্নয়নে যেগুলোর অবদান সরাসরি চোখে পড়ে না। কারণ, সেসব খাতের থাকে বেশ দীর্ঘ সুপ্তিকাল (জেস্টেশন পিরিয়ড)। শিশু-কিশোরদের আনুষ্ঠানিক শিক্ষা ১৫-২০ বছর ধরে চলে, এই সময়ে শিক্ষার্থীরা তেমন কিছু উৎপাদন করে না। কর্মে নিযুক্ত ব্যক্তিদের উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা তথা প্রশিক্ষণ মানবসম্পদের উন্নয়ন করে প্রায় সরাসরি, এর সুপ্তিকাল একেবারে ছোটখাটো হওয়ায় উন্নয়ন সহজে চোখে পড়ে এবং এসব প্রশিক্ষিত মানবসম্পদ খুব তাড়াতাড়ি অর্থনৈতিক উন্নয়নে ভূমিকা রাখতে পারে। স্বাস্থ্যবান মানুষ কর্মী হিসেবে স্বাস্থ্যহীন বা রোগা কর্মীদের চেয়ে বেশি উৎপাদনশীল বলে স্বাস্থ্য খাতে খরচকে শিক্ষা খাতের চেয়ে প্রত্যক্ষ অবদানকারী হিসেবে দেখা যায়।
আনুষ্ঠানিক শিক্ষা খাতের সুপ্তিকাল দীর্ঘ হলেও দেশের উন্নয়নে এর সুদূরপ্রসারী অবদান থাকে। এসব শিক্ষিত জনগোষ্ঠীর ব্যক্তিগত বর্ধিত আয়ের যোগ্যতা অর্থনৈতিক উন্নয়নে বাড়তি প্রভাব (স্পিলওভার এফেক্ট) ফেলে (মিনসের ১৯৭৪)।

শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে খরচ দীর্ঘস্থায়ী বিনিয়োগ

অর্ধশতাব্দী আগে শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের হিউম্যান ক্যাপিটাল স্কুল শিক্ষা খাতের খরচকে বিনিয়োগ বলে প্রমাণ করে রেখেছে (শুলৎজ, ১৯৬১)। আর অর্থনৈতিক উন্নয়নের অন্তঃসত্ত্বা প্রবৃদ্ধি তত্ত্ব (ইন্ডোজেনাস গ্রোথ থিউরি, রোমার ১৯৯০) অনুসারে শিক্ষা ও স্বাস্থ্য উভয় খাত অর্থনৈতিক উন্নয়নে অবদান রাখে ভেতর থেকে, এর অবদান বাহ্যিক মডেলের বিশ্লেষণে সরাসরি ধরা পড়ে না। ভেতর থেকে গড়ে ওঠা এই উন্নয়ন হয় দীর্ঘস্থায়ী প্রকৃত উন্নয়ন।

আমাদের নিকটতম প্রতিবেশী ভারত গত বছর স্বাস্থ্য খাতে জিডিপির ২ দশমিক ১ শতাংশ খরচ করেছে; ২০২৫ সালের মধ্যে দেশটি এই খাতে ২ দশমিক ৫ শতাংশ বরাদ্দ করার পরিকল্পনা করছে। আমাদের একক স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় তো হিসাবে জিডিপির ২ দশমিক ৫ শতাংশ ভাগে পায়। সেখানে এই করোনাপীড়িত দেশে কী করে জিডিপির মাত্র শূন্য দশমিক ৮২ শতাংশ বরাদ্দ দেওয়া হয়?

বাংলাদেশে শিক্ষা খাতে বাজেট বরাদ্দ

জাতিসংঘের শিশু তহবিল ইউনিসেফ দীর্ঘদিন শিক্ষা খাতে জিডিপির ৭ শতাংশ বরাদ্দের দাবি করে আসছিল। তবে সংস্থাটি ২০১৫ সালের ইঞ্চিয়ন ঘোষণায় এই খাতে জিডিপির ৪ থেকে ৬ শতাংশ বরাদ্দের পরামর্শ দিয়েছে। এর কম বরাদ্দে ২০৩০ সালের মধ্যে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা-৪ (শিক্ষার জন্য নির্দিষ্ট লক্ষ্য) অর্জন করা যাবে বলে মনে হয় না।

শিক্ষা খাতে উন্নত বিশ্বের আর্থিক বিনিয়োগের দিকে না তাকিয়ে আমরা এশিয়ার কিছু নিকট প্রতিবেশীর দিকে তাকাই। ভুটান এই খাতে জিডিপির ৭ দশমিক ২ শতাংশ বিনিয়োগ করে। ভারত ও পাকিস্তানের এই খাতে বরাদ্দ যথাক্রমে জিডিপির ৩ দশমিক ৮ ও ২ দশমিক ৯ শতাংশ।

বাংলাদেশ প্রায় প্রতিবছর শিক্ষা খাতে জিডিপির মাত্র ২ শতাংশ বরাদ্দ করে থাকে। করোনার আঘাতে দুই বছরের বেশি সময় বিদ্যালয় প্রায় বন্ধ থাকার পরিপ্রেক্ষিতে শিক্ষার্থীদের শিখন ঘাটতি পূরণ করার জন্য এবং ‘নতুন’ নামে খ্যাত পরিমার্জনাধীন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নের জন্য এবার অন্য বছরের তুলনায় বেশি বরাদ্দ দরকার। অথচ এবার শিক্ষা খাতে বরাদ্দের ভাগ কমে হয়েছে জিডিপির ১ দশমিক ৮৩ শতাংশ!

বাজেট বরাদ্দকে মন্ত্রণালয়ের দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা যাক। বাংলাদেশে মন্ত্রণালয়ের সংখ্যা ৪০টির মতো। প্রতি মন্ত্রণালয় ভাগে পাওয়ার কথা জিডিপির ২ দশমিক ৫ শতাংশ। সে হিসেবে দুটো শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের ভাগ দাঁড়ায় জিডিপির ৫ শতাংশ যা জাতিসংঘ শিশু তহবিল নির্ধারিত ৪ থেকে ৬ শতাংশের মাঝখানে পড়ে। শিক্ষা খাত এই যৌক্তিক ভাগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে কেন?

বাংলাদেশে স্বাস্থ্য খাত সবচেয়ে অবহেলিত

মানবসম্পদ উন্নয়নের বিচারে স্বাস্থ্যের শিক্ষার চেয়ে বেশি গুরুত্ব পাওয়ার কথা। কারণ, স্বাস্থ্য ভালো না থাকলে শিক্ষাগ্রহণও বাধাপ্রাপ্ত হয়। আমার স্কুলজীবনের কথা মনে পড়ে। আমি গাজীপুর জেলার কালিগঞ্জ উপজেলার নাগরী ইউনিয়নে অবস্থিত সেন্ট নিকোলাস হাইস্কুলের ছাত্র ছিলাম। ১৯৭৪ সালে অষ্টম শ্রেণিতে পড়ি। ইংরেজির শিক্ষক রঞ্জিত কুমার দাস একটু পেট খারাপ হলেই স্কুলে আসতেন না। আমাদেরও অসুস্থ অবস্থায় স্কুলে যেতে বারণ করতেন। তাঁর যুক্তি ছিল: শরীর সুস্থ না থাকলে শিক্ষার মতো উন্নত মানসিক কাজ ভালো হতে পারে না। শিক্ষা গ্রহণের মতো কাজ দায়সারা গোছের করে তো করা যাবে না!

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাবমতে বাংলাদেশে ১০ হাজার মানুষের জন্য ৫ দশমিক ২৬ জন চিকিৎসক রয়েছেন। এই হিসাব দক্ষিণ এশীয় দেশগুলোর মধ্যে সর্বনিম্নœদেশটির পরে; মানে অল্পের জন্য নিচের দিক থেকে প্রথম হওয়ার ‘গৌরব’ থেকে বঞ্চিত হয়েছি! স্বাস্থ্যসেবার জন্য চিকিৎসকের সংখ্যার চেয়ে নার্সের সংখ্যা বেশি হতে হয়। অর্থনৈতিক সহযোগিতা ও উন্নয়ন সংস্থার (অর্গানাইজেশন অব ইকোনমিক কো-অপারেশন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট-ওইসিডি) অন্তর্ভুক্ত দেশগুলোয় একজন চিকিৎসকের জন্য তিনজন নার্স থাকেন। বাংলাদেশে এই হার উল্টো; ২ দশমিক ৫ জন চিকিৎসকের জন্য আছেন মাত্র একজন নার্স। এর কারণ কি এই যে আমাদের দেশে প্রশিক্ষণ দিয়ে নার্স তৈরির জন্য যথেষ্ট সংখ্যক নারী নেই? না থাকলে কোত্থেকে আমরা মেয়েদের মধ্যপ্রাচ্যে পাঠাই ঘরকন্যার কাজ করার নামে নানাভাবে নিগৃহীত হতে?

আরও পড়ুন

আমাদের নিকটতম প্রতিবেশী ভারত গত বছর স্বাস্থ্য খাতে জিডিপির ২ দশমিক ১ শতাংশ খরচ করেছে; ২০২৫ সালের মধ্যে দেশটি এই খাতে ২ দশমিক ৫ শতাংশ বরাদ্দ করার পরিকল্পনা করছে। আমাদের একক স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় তো হিসাবে জিডিপির ২ দশমিক ৫ শতাংশ ভাগে পায়। সেখানে এই করোনাপীড়িত দেশে কী করে জিডিপির মাত্র শূন্য দশমিক ৮২ শতাংশ বরাদ্দ দেওয়া হয়? শোনা যায়, গত বছর এই মন্ত্রণালয় জিডিপি ১ শতাংশের কম বরাদ্দের অর্থই ব্যয় বরতে পারেনি! প্রশ্ন আসে, যাঁরা স্বাস্থ্যসেবা এবং মানবসম্পদ উন্নয়নের অর্থ বোঝেন না, তাঁরা এই খাতের মন্ত্রী-সচিব হন কী করে?

অমর্ত্য সেনের আবিষ্কার এবং চিন্তার দুর্ভিক্ষ

নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন দুই দশক আগে আবিষ্কার করলেন: গণতান্ত্রিক দেশে দুর্ভিক্ষ হতে পারে না। আমরা যা-ই ভাবি না কেন, আমাদের নেতারা দিবানিশি দেশে ‘উন্নয়নের গণতন্ত্রের’ ঢোলক বাজিয়েই চলেছেন। খাদ্যের দুর্ভিক্ষ থেকে আমাদের মুক্তি মিলেছে। তবে মানবসম্পদ উন্নয়ন না বোঝা এবং শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে প্রাপ্য আর্থিক বরাদ্দের অর্ধেকও না দেওয়া থেকে মনে হয় আমাদের সরকারের মধ্যে ‘চিন্তার দুর্ভিক্ষ’ (ফেমিন ইন থিংকিং) রয়েছে।

মনে রাখতে হবে— সেতু, মেট্রোরেল, ফ্লাইওভার দূর থেকে দেখা যায়, দেখানোও যায়; কিন্তু মানুষের ভেতর থেকে উন্নয়ন না ঘটলে, মানবসম্পদ উন্নয়ন করতে না পারলে সবই বৃথা হয়ে যাবে। জ্ঞানভিত্তিক সমাজ গড়ার প্রত্যয় আছে বলে প্রায়ই শোনা যায়। আর দেশের বেশির ভাগ সংসদ সদস্য ও মন্ত্রী এখন ব্যবসায়ী; আগের দিনের মতো আইনজ্ঞ, শিক্ষাবিদ, সমাজসেবী, বিজ্ঞানীরা এখন কার্যকর (ক্ষমতাসীন) রাজনীতিতে নেই। আশা করি, আমাদের ব্যবসায়ী মন্ত্রী ও সংসদ সদস্যরা নিজেদের ব্যবসা (বিজনেস) ভালোমতো বুঝে মানবসম্পদ উন্নয়নের ধারণা কাজে লাগিয়ে শিক্ষা খাতে অন্তত ৩ শতাংশ এবং স্বাস্থ্য খাতে অন্তত ১ দশমিক ৫ শতাংশ বরাদ্দ নিশ্চিত করে বাজেট পাস করবেন।

  • ড. আবদুস সাত্তার মোল্লা শিক্ষা গবেষক এবং অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক (বিসিএস সাধারণ শিক্ষা)। [email protected]