মানবাধিকারের দৈন্য কাটবে কি

আট বছর আগে পোশাক কারখানায় লেলিহান আগুন থেকে বাঁচতে যে নাসিমা কিংবা জরিনা বেগমেরা তাজরীনের জানালা থেকে লাফিয়ে পড়ে জীবন বদলে দেওয়া ক্ষত নিয়ে বেঁচে আছেন, তাঁদের পাওনা ক্ষতিপূরণ আজও মেলেনি। এই দীর্ঘ সময়ে তাঁরা বিচারও পাননি। বাংলাদেশের আইন, আদালত কিংবা প্রশাসন তাঁদের এসব ন্যূনতম নাগরিক অধিকার পূরণ করতে পারেনি।

৮০ দিন ধরে তাঁরা রাজপথে তাঁদের অধিকার আদায়ের দাবিতে অবস্থান ধর্মঘট করছিলেন। দাবি কিংবা প্রতিবাদ জানানোর সাংবিধানিক অধিকার সত্ত্বেও ভোররাতে তাঁরা যখন প্রেসক্লাবের সামনের ফুটপাতে ঘুমাচ্ছিলেন, তখন পুলিশ তাঁদের মারধর করে উঠিয়ে দিয়েছে। পুলিশের বক্তব্য, আইনগত ক্ষমতাবলে তারা রাস্তায় জনচলাচল স্বাভাবিক রাখতে অননুমোদিত প্রতিবাদ বন্ধ করেছে। শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ মাত্রাতিরিক্ত শক্তি প্রয়োগ করে অপসারণের ক্ষমতা কোন আইনে আছে, সে কথার জবাব অবশ্য পুলিশের কাছে মিলবে বলে মনে হয় না। তাজরীন ছাড়াও এ ওয়ান বিডি নামের আরও একটি পোশাক কারখানার শ্রমিকেরাও সেখানে ছিলেন, যাঁরা তাঁদের ঘামের মজুরি পাননি এবং বছরখানেক ধরে ঘুরছেন। ছিলেন কিছু ইবতেদায়ি মাদ্রাসা ও কিছু প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক, যাঁদের দাবি হচ্ছে চাকরির স্বীকৃতি এবং কিছু আর্থিক সুবিধা।

নানা ধরনের জনস্বার্থ রক্ষায় সাংবিধানিক অধিকার সুরক্ষার আবেদন জানিয়ে যাঁরা অহরহ আদালতের শরণাপন্ন হন, তাঁরা কেউ যে এসব ভাগ্যাহত শ্রমিক কিংবা শিক্ষকের অধিকার সুরক্ষার আরজি নিয়ে আদালতের দ্বারস্থ হয়েছেন, এমন কোনো খবর এখন পর্যন্ত চোখে পড়েনি। অবশ্য, নাগরিকদের মানবাধিকার রক্ষায় সব সময় কাউকে না কাউকে যে আদালতের শরণাপন্ন হতে হবে, এমন নয়। আদালতও বিপন্ন মানুষকে আইনগত সুরক্ষা দিতে স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে এ রকম ব্যবস্থা নিতে পারেন এবং সাম্প্রতিক কালে এ রকম একাধিক নজির আমরা দেখেছি। আমাদের আশা, মানবাধিকার রক্ষায় আদালত আরও এ রকম নজির তৈরি করবেন।

২.

পুলিশ যে নিষেধাজ্ঞা কার্যকরের জন্য এসব ভাগ্যবিড়ম্বিত নারী-শিশু-পুরুষকে ঘুমের মধ্যে লাঠিপেটা করে সেখান থেকে হটিয়ে দিয়েছে, সেই আদেশের কথা মাত্র দিন দুয়েক আগে সবাইকে জানানো হয়। তবে ওই দুদিনে ঢাকা শহরে আরও অনেক সভা-সমাবেশ হয়েছে, যেগুলোয় পুলিশ কোনো বাধা দেয়নি; বরং সমাবেশকারীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করেছে। ভাস্কর্য নিয়ে মুখোমুখি হওয়া দুটি পক্ষের মধ্যে সরকারের সহানুভূতি যাদের প্রতি, পুলিশও তাদের প্রতি উদারতা দেখাতে কোনো কার্পণ্য করেনি।

বাংলাদেশের রাজনীতিতে মানবাধিকার ও আইনের নিজস্ব গতির পক্ষপাতিত্বের এই ধারা এখন মোটামুটি সুপ্রতিষ্ঠিত। আগে এমনটি ঘটত মাঝেমধ্যে, কিন্তু তার ব্যাপক প্রতিবাদ দেখা যেত, কর্তৃপক্ষও পিছু হটত। কিন্তু ভোটাধিকার হারিয়ে যাওয়া নির্বাচনের পর থেকে এটাই স্থায়ী ব্যবস্থা। এমনকি দেশের বৃহত্তম বিরোধী দলকে নির্বাচনী জনসভার অনুমতিও দেওয়া হয়নি। তবে লক্ষণীয় ফারাক যেটি দেখা যাচ্ছে, তা হলো পুলিশের আরোপিত নিষেধাজ্ঞার বিরুদ্ধে তেমন জোরালো কোনো প্রতিবাদ নেই। যা আছে, তা শুধু টক শোর টক–মিষ্টি ঝড় এবং সামাজিক মাধ্যমে বিতর্ক।

পুলিশের অনুমতির বিষয়টি যেভাবে রাজনৈতিক পক্ষপাতে দুষ্ট হয়ে উঠেছে, তা একেবারে অস্বাভাবিক নয়। প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, আদালত—সবকিছুর ওপর দলীয়করণের যে থাবা বিস্তৃত হয়েছে, তাতে বরং ব্যতিক্রম ঘটলেই বিস্মিত হতে হতো। প্রশ্ন হচ্ছে, এই অবস্থা কি এভাবে চলতেই থাকবে। নাকি তা বদলানোর কোনো চেষ্টা হবে? সভা-সমাবেশের অধিকারচর্চায় অনুমতির প্রশ্ন আসছে কেন? জননিরাপত্তার জন্য প্রয়োজনীয় সতর্কতা ও প্রস্তুতিতে যাতে কোনো ঘাটতি না থাকে, তাই সভা-সমাবেশের বিষয়টি পুলিশকে শুধু আনুষ্ঠানিকভাবে জানানোই তো যথেষ্ট। দলীয়করণ অবশ্য এখন এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে কোনো মাঠ বা মিলনায়তনের অনুমতিও রাজনৈতিক বিবেচনায় আটকে থাকে। আমাদের রাজনীতির এই অসুস্থতা আর কত দীর্ঘ হবে? ভোটের অধিকার ফিরে পাওয়া এবং ক্ষয়প্রাপ্ত গণতন্ত্রের পুনরুজ্জীবন ছাড়া সে বিষয়ে অবশ্য আশাবাদী হওয়ার অবকাশ নেই।

৩.

আজ থেকে ৭২ বছর আগে এই দিনে বিশ্ব যে সর্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণা গ্রহণ করেছিল, তার ৩০টি ধারায় সব মানুষের সমতা, মানবিক মর্যাদা, চিন্তা ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, বিচার লাভের সমান অধিকার, সব ধরনের নির্যাতন ও নিষ্ঠুরতার হাত থেকে সুরক্ষাসহ অনেক মৌলিক অধিকারের কথা আছে। এসব অধিকার কার্যকর করা এবং সেগুলো সুরক্ষা ও পর্যালোচনায় গত সাত দশকে আরও অনেক আনুষঙ্গিক সনদ ও চুক্তি সম্পাদিত হয়েছে। সামাজিক, রাজনৈতিক, নাগরিক ও সাংস্কৃতিক অধিকারবিষয়ক এসব সনদ ও আনুষঙ্গিক চুক্তির অনেকগুলো বাংলাদেশ গ্রহণ করলেও বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে এখনো সিদ্ধান্তহীনতা দৃশ্যমান। গুম থেকে সুরক্ষার সনদ এ রকমই একটি। নির্যাতনবিরোধী সনদের অতিরিক্ত দলিল (অপশনাল প্রটোকল) আরেকটি।

এ ক্ষেত্রে আরেকটি উদ্বেগের বিষয় হচ্ছে মানবাধিকারের প্রশ্নে আন্তর্জাতিক পর্যালোচনা বা নিরীক্ষাকে এড়িয়ে চলার প্রবণতা। গুম বিষয়ে বাংলাদেশ থেকে ভুক্তভোগীদের পরিবারগুলোর ডজনখানেকের বেশি অভিযোগ সম্পর্কে জাতিসংঘের বিশেষজ্ঞরা তথ্য চাইলেও সরকার সেগুলোর জবাব দেয়নি। একইভাবে অন্তত অর্ধডজন স্বাধীন বিশেষজ্ঞ (স্পেশাল র‌্যাপোর্টিয়ার) তাঁদের ম্যান্ডেট অনুযায়ী বিভিন্ন বিষয়ে অনুসন্ধানী সফরে আসতে চাইলেও সরকার গত কয়েক বছরেও তাঁদের অনুমতি দেয়নি। কার্যত, যেসব মানবাধিকার বিষয়ে সুপরিচিত আন্তর্জাতিক সংগঠনগুলোও নানা ধরনের প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি হচ্ছে। দেশীয় সংগঠনগুলোর ক্ষেত্রেও একই ধরনের বিঘ্ন সৃষ্টির অভিযোগ রয়েছে।

মানবাধিকারের বিষয়টি বর্তমান যুগে আর কোনো দেশের একক বা অভ্যন্তরীণ সার্বভৌমত্বের বিষয় নয়। আবেগতাড়িত হয়ে অনেকেই অভিযোগ করে থাকেন, উন্নত দেশগুলোর মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনাগুলোর বিষয়ে জাতিসংঘ এবং অন্যান্য মানবাধিকার সংগঠন নীরবতা পালন করে থাকে। তাঁদের এই অভিযোগ যে কতটা অসত্য ও মনগড়া, তার সাম্প্রতিকতম একটি দৃষ্টান্ত হচ্ছে জাতিসংঘ মানবাধিকার সংস্থায় গত মাসে অনুষ্ঠিত বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিধর দেশ যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থা পর্যালোচনা। ২০১৮ সালে জাতিসংঘ মানবাধিকার পরিষদ ত্যাগ করা সত্ত্বেও দেশটি ওই পর্যালোচনায় অংশ নেয় এবং সেখানে বর্ণ, ধর্ম এবং নারী-পুরুষভেদে বৈষম্য, বিদ্বেষ সৃষ্টিকারী বক্তব্য প্রচার, ধর্মীয় অসহিষ্ণুতা, সহিংসতা এবং অভিবাসীদের প্রতি নিষ্ঠুর আচরণ সমালোচিত হয়েছে। সেখানে শান্তিপূর্ণ সমাবেশের অধিকার, বিক্ষোভ দমনে পুলিশের শক্তি প্রয়োগ এবং সাংবাদিকদের জন্য ঝুঁকি তৈরির বিষয়গুলোও বাদ যায়নি। ওই সভায় জাতিসংঘের স্বাধীন বিশেষজ্ঞরা কথিত সন্ত্রাসবিরোধী বৈশ্বিক লড়াইয়ের সময়ে মানবাধিকার ও মানবিক আইনগুলো লঙ্ঘনের প্রশ্নে দায়মুক্তির অবসান ঘটানোর আহ্বান জানিয়েছেন।

৪.

বলার অপেক্ষা রাখে না যুক্তরাষ্ট্রে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের চার বছরের শাসনকাল সারা বিশ্বে গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের বিষয়গুলোকে কতটা ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। বিশ্বের কর্তৃত্ববাদী ও জনতুষ্টিবাদী শাসকদের প্রতি তাঁর দুর্বলতা ও ঘনিষ্ঠতা, বাণিজ্যিক স্বার্থকে সবকিছুর ওপরে স্থান দেওয়া এবং বিশ্বায়ন থেকে নিজেদের গুটিয়ে নেওয়ার প্রক্রিয়ার কথা বহুল আলোচিত। এগুলো দেশে দেশে কর্তৃত্ববাদী শাসক ও সংকীর্ণতা এবং বিভাজনের রাজনীতিকে উৎসাহিত করেছে। জানুয়ারিতে নতুন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ক্ষমতা গ্রহণের পর শিগগিরই যে অবস্থা বদলে যাবে, এমনটা ভাবার কোনো কারণ নেই। তবে বাইডেন নির্বাচনের আগে ও পরে একাধিকবার গণতন্ত্রের পুনরুজ্জীবনকে অগ্রাধিকার দেওয়া এবং আন্তর্জাতিক পরিসরে যুক্তরাষ্ট্র আবার অগ্রণী ভূমিকা নেবে বলে জানিয়েছেন।

গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের পক্ষের শক্তিগুলোর জন্য অবশ্য আরও একটি ভালো খবর আছে। ৭ ডিসেম্বর ইউরোপীয় ইউনিয়নের পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা ইউরোপের জন্য ম্যাগনেটস্কি অ্যাক্ট অনুমোদন করেছেন। যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা ও ব্রিটেনের পর ইউরোপের এই আইন প্রণয়ন তাৎপর্যপূর্ণ। ম্যাগনেটস্কি আইন হচ্ছে মানবাধিকারের গুরুতর লঙ্ঘনকারী ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট শাস্তিমূলক ব্যবস্থা বা নিষেধাজ্ঞা আরোপ। এই আইনে ইউরোপের দেশগুলো বিভিন্ন দেশে গুম, বিচারবহির্ভূত হত্যা, নির্যাতনের মতো অপরাধে জড়িত ব্যক্তিদের ভ্রমণ এবং তাঁদের সম্পদ বাজেয়াপ্তের মতো পদক্ষেপ নিতে পারবে। অভিযুক্ত ব্যক্তিদের পরিবারের সদস্যরাও এ ধরনের নিষেধাজ্ঞার কবলে পড়তে পারেন।

৫.

করোনাভাইরাসের ছোবলে বিশ্বজুড়ে এখন যে বৈষম্য চরম আকার নিয়েছে ও নিচ্ছে, তা মানবাধিকারের জন্য এক নতুন চ্যালেঞ্জ। বিশেষ করে টেকসই বিশ্ব বা এসডিজি গড়ে তোলার যেসব লক্ষ্যের বিষয়ে বিশ্বনেতারা একমত হয়েছিলেন, সেই লক্ষ্য অর্জনের পথ এখন আরও সংকীর্ণ ও প্রতিকূল হয়ে পড়েছে। এই পটভূমিতে মানুষের জীবন-জীবিকা ও মর্যাদা রক্ষার চ্যালেঞ্জ ও গুরুত্ব অপরিসীম। এবারের মানবাধিকার দিবসের প্রতিপাদ্য হচ্ছে, ‘আরও ভালোভাবে পুনরুজ্জীবন, মানবাধিকারের পক্ষে দাঁড়াও’ (রিকভার বেটার, স্ট্যান্ড আপ ফর হিউম্যান রাইটস)। ভয় অবশ্য থেকেই যায় যে এগুলো না শুধু ‘কথার কথা’ হয়ে রয়।

কামাল আহমেদ সাংবাদিক