তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোয় চাল, ডাল, তেল ও নুনের বাজারে সিন্ডিকেটের খবর শুনে বেড়ে উঠেছি আমরা অনেকেই। এই তো কয় দিন আগে সরকারের নির্দিষ্ট কর্মকর্তাদের দেখলাম বিভিন্ন আড়ত ও দোকান ঘুরে ঘুরে ভোজ্যতেলের মজুতদারির বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছেন। হায় রে অভাগা অভিবাসী নারী ও পুরুষ কর্মী! বিভিন্ন সময় আপনাদের রেমিট্যান্সযোদ্ধা, আজকের মুক্তিযোদ্ধা ইত্যাদি ভূষণে ভূষিত করা হলেও মনে হচ্ছে যেন তেল-নুনের চেয়েও আপনাদের মূল্য অনেক কম। তাই প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয় ছাড়া সরকারের অন্য কোনো বিভাগকে দেখছি না তেমনভাবে এগিয়ে আসতে বা আপনাদের হয়ে কথা বলতে।
২০২১ সালের ১৯ ডিসেম্বর বাংলাদেশ ও মালয়েশিয়ার মধ্যে অভিবাসী প্রেরণ ও গ্রহণ বিষয়ে একটি সমঝোতা চুক্তি সই হয়েছিল। প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় এবং বিশেষ করে এর কর্ণধার মন্ত্রী ইমরান আহমেদ শ্রমিকের স্বার্থ রক্ষা করে একটি অধিকারভিত্তিক সমঝোতা চুক্তি সইয়ের জন্য ব্যাপকভাবে প্রশংসিত হয়েছেন। দীর্ঘদিন বন্ধ থাকার পর এ বাজার উন্মোচনে আমরা সবাই ভীষণভাবে আনন্দিত হয়েছিলাম। কিন্তু ২০২২ সালের শুরুতেই শুনতে হলো সেই দুঃখজনক সংবাদ। খবরে প্রকাশ, আমাদের দেশের কিছু রিক্রুটিং এজেন্সি ওই দেশের সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী মন্ত্রণালয়কে প্রভাবিত করেছে। মালয়েশিয়ার মানবসম্পদমন্ত্রী এম সারাবামান অধিকারভিত্তিক সমঝোতা চুক্তিকে পাশ কাটিয়ে ২৫টি রিক্রুটিং এজেন্সির মাধ্যমে কর্মী সংগ্রহ ও প্রেরণের কাজটি পরিচালনা করতে আমাদের মন্ত্রীকে আনুষ্ঠানিকভাবে চিঠি লিখেছেন। মন্ত্রী মহোদয়কে আবারও ধন্যবাদ। তিনি প্রত্যুত্তরে মালয়েশীয় কর্তৃপক্ষকে জানান, বাংলাদেশের প্রতিযোগিতা আইনের বাইরে গিয়ে, ন্যায়সংগত অভিবাসনের সব নিয়মনীতিকে অবজ্ঞা করে লাইসেন্সপ্রাপ্ত রিক্রুটিং এজেন্সির শুধু ১ দশমিক ৬ ভাগ প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে কর্মী প্রেরণের সুযোগ তাঁর মন্ত্রণালয়ের নেই।
কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার, মালয়েশিয়ার মানবসম্পদ মন্ত্রণালয় তাদের সেই অন্যায় আবদারের গোঁ ধরেই রয়েছে। অভিবাসন নিয়ে কর্মরত বাংলাদেশের ২৩টি সিভিল সমাজের অ্যাসোসিয়েশন বাংলাদেশ সিভিল সোসাইটি ফর মাইগ্রেন্টস (বিসিএসএম) তাদের বিভিন্ন কর্মকাণ্ড, পত্রিকায় কলাম লেখা ও যৌথ বিবৃতির মাধ্যমে এই সিন্ডিকেশনের বিরুদ্ধে সরকারকে অনড় থাকার দাবি জানায়। তারা ২০১৬ সালে ১০টি বাংলাদেশি রিক্রুটিং এজেন্সির মাধ্যমে কর্মী পাঠানোর যে প্রক্রিয়া চালু হয়েছিল, তার অভিজ্ঞতা পর্যালোচনা করে সরকার ও সাধারণ জনগণকে অবহিত করে, শুধু সার্ভিস চার্জ নিয়ে এই ১০ রিক্রুটিং এজেন্সির মাধ্যমে কর্মী প্রেরণের যে প্রক্রিয়া চালু হয়েছিল, তাতে তারা শুধু সার্ভিস চার্জই নেয়নি, বরং উচ্চ অভিবাসনের মূল্য নিয়ে দরিদ্র অভিবাসন-ইচ্ছুক গ্রামীণ জনগণের সঙ্গে প্রতারণা করেছে এবং ব্যাপক অর্থের মালিক হয়েছে। মালয়েশিয়ার নতুন সরকার এসে দুর্নীতির দায়ে বাংলাদেশের সঙ্গে অভিবাসনের চুক্তি স্থগিত করে দেয়। এসব রিক্রুটিং এজেন্সির কোনো বিচার তো হয়ইনি, বরং এবারও তারা তাদের সংখ্যা কিছুটা বাড়িয়ে নিয়ে একইভাবে ব্যক্তিগত সম্পদ বৃদ্ধির চেষ্টা করছে।
বিষয়টি যেহেতু অতিগুরুত্বপূর্ণ, লাখ লাখ অভিবাসীর জায়গাজমি বিক্রি করা অর্থের অন্যায় ব্যবহারের প্রশ্ন, জাতীয় রিজার্ভে বৈদেশিক মুদ্রায় নেতিবাচক প্রভাবের প্রশ্ন, বাংলাদেশের সমগ্র সুশীল সমাজের পক্ষ থেকে আমরা প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা করছি। তিনি বারবার বলেছেন, অভিবাসন প্রক্রিয়াকরণে চাই স্বচ্ছতা। আমরা নিশ্চিত, প্রধানমন্ত্রী যদি একবার বলেন, তবে এই ২৫ রিক্রুটিং এজেন্সি তাদের অন্যায় তৎপরতা থেকে বিরত হবে।
আমার ভাবতে অবাক লাগছে, মালয়েশিয়ায় সিন্ডিকেশন যেন কোনো অবস্থায় আর না হতে পারে, সে বিষয়ে আদালতের আপিল বিভাগের রায় রয়েছে। তা ছাড়া বাংলাদেশের সঙ্গে আরও ১৩টি রাষ্ট্রের সমঝোতা চুক্তি রয়েছে। কিন্তু কোথাও এ ধরনের সিন্ডিকেশন নেই। এত সব সত্ত্বেও সিন্ডিকেশনের চেষ্টা অপ্রতিহতভাবে এগিয়ে চলেছে। সিন্ডিকেট সৃষ্টিকারী রিক্রুটিং এজেন্সিগুলো প্রস্তাব করেছে আরও ২৫০টি রিক্রুটিং এজেন্সি তাদের সাব-এজেন্ট হয়ে মালয়েশিয়ায় কর্মী পাঠাতে পারবে। অর্থাৎ একই ফি দিয়ে লাইসেন্স নেওয়া রিক্রুটিং এজেন্সিকে তারা দালালে পরিণত করতে চাইছে।
খুবই যুক্তিসংগত একটা প্রশ্ন আমার মাথায় ঘুরছে। কারা এই সিন্ডিকেটের অংশ? হঠাৎ হঠাৎ পত্রপত্রিকায় দু-একটা নাম এলেও এই ১০ জন অথবা ২৫ জনের নাম আমরা একত্রে কোথাও দেখিনি। কেন দেখিনি? সব অর্থেই তারা তো দেশের শত্রু। সর্বোচ্চ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনকারী সেক্টরের স্থিতিশীলতার বিরুদ্ধে তারা কাজ করছে। ফিলিপাইনের অভিবাসনবিষয়ক আইনে এ ধরনের কার্যক্রমকে জাতীয় অর্থনীতির বিরুদ্ধে স্যাবোটাজ করে চিহ্নিত করা হয়েছে। আমরা কি পারি না এসব মানুষকে দায়বদ্ধতার ভেতরে নিয়ে আসতে? আবারও প্রশ্ন, কেন পারছি না? তবে কি এদের সমর্থনের জায়গা আরও অনেক ওপরের পর্যায় পর্যন্ত বিস্তৃত? আমি ভাবতে চাই এটি সত্যি নয়।
সমঝোতা চুক্তি সই হওয়ার পর আজ বৃহস্পতিবার অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে জয়েন্ট ওয়ার্কিং গ্রুপের প্রথম মিটিং। এই মিটিংয়ে টেকনিক্যাল বিষয়গুলো নির্ধারিত হওয়ার কথা। সবচেয়ে বড় ইস্যু থাকবে আইনবহির্ভূত সিন্ডিকেশন? নাকি সবার অংশগ্রহণের মাধ্যমে স্বচ্ছ অভিবাসন প্রক্রিয়াকরণ। আজকের জয়েন্ট কমিটির বৈঠকের ফলাফল বলে দেবে প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয় অভিবাসীদের কল্যাণ এবং ফি দিয়ে লাইসেন্স নেওয়া সব রিক্রুটিং এজেন্সির স্বার্থ রক্ষা করতে পারবে কি না?
বিষয়টি যেহেতু অতিগুরুত্বপূর্ণ, লাখ লাখ অভিবাসীর জায়গাজমি বিক্রি করা অর্থের অন্যায় ব্যবহারের প্রশ্ন, জাতীয় রিজার্ভে বৈদেশিক মুদ্রায় নেতিবাচক প্রভাবের প্রশ্ন, বাংলাদেশের সমগ্র সুশীল সমাজের পক্ষ থেকে আমরা প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা করছি। তিনি বারবার বলেছেন, অভিবাসন প্রক্রিয়াকরণে চাই স্বচ্ছতা। আমরা নিশ্চিত, প্রধানমন্ত্রী যদি একবার বলেন, তবে এই ২৫ রিক্রুটিং এজেন্সি তাদের অন্যায় তৎপরতা থেকে বিরত হবে। তারা নিজেদের আর দশটি রিক্রুটিং এজেন্সির মতো সম-অধিকারে নেমে আসবে। সে ক্ষেত্রে মালয়েশীয় কর্তৃপক্ষের ২০২১ সালের স্বাক্ষরিত সমঝোতা চুক্তির বাইরে যাওয়ার প্রয়োজন পড়বে না।
● ড. তাসনীম সিদ্দিকী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক এবং রিফিউজি অ্যান্ড মাইগ্রেটরি মুভমেন্ট রিসার্চ ইউনিটের (রামরু) চেয়ারপারসন