মিয়ানমারের সম্ভাব্য গৃহযুদ্ধ ও আমাদের সতর্কতা

সামগ্রিক পরিস্থিতি বিবেচনায় নিলে এটা অনেকটাই স্পষ্ট যে মিয়ানমার একটি অবধারিত গৃহযুদ্ধের দিকে যাচ্ছে। ফেব্রুয়ারির প্রথম দিকে সেনা অভ্যুত্থানের পর দেশটিতে ক্রমাগত অস্থিরতা ও দমন–পীড়ন অব্যাহত রয়েছে। গত বছর জাতীয় নির্বাচনে কারচুপি ও প্রতারণার অভিযোগ এনে মিয়ানমার সেনাবাহিনী যা তাতমাদা হিসেবে পরিচিত, তারা ক্ষমতা দখল করে নেয়। এর মধ্য দিয়ে ১০ বছর গণতান্ত্রিক সরকারের অধীনে পরিচালিত হওয়ার পর মিয়ানমার আবার সামরিক সরকারের অধীনে চলে আসে। কিন্তু এবার সাধারণ জনগণ সামরিক সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করে এবং তা দ্রুত সহিংস রূপ লাভ করে। এখন পর্যন্ত প্রায় ৮০০ মানুষ নিহত হয়েছে, যার অধিকাংশ তরুণ শিক্ষার্থী।

এ আন্দোলনের মুখে পুরো দেশ কার্যত অচল হয়ে পড়েছে এবং ধারণা করা হচ্ছে যে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে চলমান জাতিগত বিদ্রোহের সঙ্গে এক হয়ে এ আন্দোলন গেরিলা কৌশল যুদ্ধে রূপ নিতে পারে। এরই মধ্যে মিয়ানমারের ছায়া সরকার ‘ন্যাশনাল ইউনিটি গভর্নমেন্ট’ সামরিক শাসনবিরোধী দল ও ব্যক্তিদের একত্র করে একটি ফেডারেল সশস্ত্র বাহিনী গড়ে তোলার চেষ্টা করছে। অবশ্য তাদের এ উদ্যোগ এখনো আন্তর্জাতিক সাড়া পায়নি। প্রতিরোধকারীদের বিরুদ্ধে সামরিক বাহিনীর ওপর হামলা, সরকারি ভবনে আক্রমণ, সামরিক এলাকার প্রবেশমুখে এলাকাভিত্তিক অবরোধ এমনকি ক্ষুদ্রাস্ত্র ব্যবহারের অভিযোগ রয়েছে। এ কায়দায় তাতমাদার মতো অভিজ্ঞ বাহিনীকে মোকাবিলা করা কঠিন। কিন্তু এ পরিস্থিতি স্পষ্টতই মিয়ানমারকে একটি গৃহযুদ্ধের দিকে নিয়ে যাচ্ছে এবং যার পরিণাম শুধু মিয়ানমার নয়, পুরো অঞ্চলকে ভোগ করতে হবে।

মিয়ানমারের এ গৃহযুদ্ধ পুরোদমে শুরু হয়ে গেলে বেশ কয়েকটি দেশের স্বার্থ এর সঙ্গে জড়িয়ে পড়বে। চীনের অবস্থানে এটা পরিষ্কার যে তারা মিয়ানমারের সেনা সরকারের পক্ষে রয়েছে। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্র এ অবস্থার কঠোর বিরোধিতা করে নির্দিষ্ট কিছু সেনা কর্মকর্তার ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে। এ অঞ্চলে গৃহযুদ্ধের সূচনা হলে, সরাসরি কোনো অংশগ্রহণ না হলেও তারা এখানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। বিভিন্ন মিলিশিয়া দলকে সমর্থনের মাধ্যমে নিজেদের প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করতে পারে। চীনকে চাপে রাখা, মিয়ানমারের বিপুল প্রাকৃতিক সম্পদের দিকে নজর বা ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে প্রভাব নিশ্চিত করা—যেকোনো বিবেচনাতেই যুক্তরাষ্ট্র যদি তার উপস্থিতি নিশ্চিত করে, তবে এ অঞ্চলে ব্যাপক পরিবর্তন আসবে। আফগানিস্তান ও সিরিয়ার ক্ষেত্রে আমরা তা দেখেছি। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার এ অঞ্চলে চীনের বৃহত্তর অর্থনৈতিক ও কৌশলগত স্বার্থ আছে, ফলে চীন এ গৃহযুদ্ধে আমেরিকা বা তার মিত্রদের প্রবেশ প্রতিরোধ করার চেষ্টা করবে। যার পরিপ্রেক্ষিতে কার্যত মিয়ানমার একটি বৃহৎ শক্তির প্রক্সি যুদ্ধক্ষেত্রে পরিণত হওয়ার সম্ভাবনা আছে।

যেকোনো যুদ্ধ সীমান্তবর্তী দেশকে প্রভাবিত করে, যেমনটি হয়েছিল আফগানিস্তানের ক্ষেত্রে পাকিস্তানে এবং সিরিয়ার ক্ষেত্রে তুরস্কে। দেখা যায়, অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব একপর্যায়ে অস্থিতিশীলতা ও গৃহযুদ্ধে পরিণত হয় এবং তা দ্রুত প্রতিবেশী দেশগুলোর ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলে। মিয়ানমারের সীমানা আছে বাংলাদেশ, ভারত, চীন, থাইল্যান্ড ও লাওসের সঙ্গে এবং স্বাভাবিকভাবেই, মিয়ানমারের এ গৃহযুদ্ধের প্রভাব একেক দেশে একেক রকম হবে। চীন-মিয়ানমার সীমান্তবর্তী এলাকায় সংঘর্ষ ও সহিংসতা চীনের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা ঝুঁকির মধ্যে ফেলতে পারে এবং চীন তা প্রতিহত করার সর্বোচ্চ চেষ্টা করবে। ইতিমধ্যে তারা মিয়ানমারের সঙ্গে নিজেদের সীমান্ত বন্ধ করে দিয়েছে।

শ্রীলঙ্কান গৃহযুদ্ধ থেকে ভারতের ইতিমধ্যে অভিজ্ঞতা হয়ে গেছে যে প্রতিবেশী দেশে অশান্তি চললে নিজ দেশে তার প্রভাব কতটা ভয়াবহ হতে পারে। ভারতের উত্তরাঞ্চলের সঙ্গে মিয়ানমারের চীন প্রদেশের সীমানা আছে আর এ অঞ্চলে উদ্বাস্তু সমস্যা রয়েছে। গৃহযুদ্ধ শুরু হলে ভারত-মিয়ানমারের এ সীমান্ত অনেকটা পাকিস্তান-আফগানিস্তানের মতো কাজ করবে। সীমান্তবর্তী এলাকার বিচ্ছিন্নতাবাদী দলগুলো এ সুযোগে তাদের কার্যক্রমের পরিধি আরও বাড়াতে পারে এবং এর ফলে অস্ত্র পাচার, গেরিলা প্রশিক্ষণ ও গৃহযুদ্ধে সহায়তা আদান-প্রদানের সম্ভাবনা বেড়ে যেতে পারে। ভারত তার সীমান্ত বন্ধ করে দিয়েছে। তবে ভারত এর আগে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর সঙ্গে যৌথ অভিযান চালিয়েছে। ফলে ধারণা করা যায় যে মিয়ানমারের বর্তমান সামরিক সরকারের সঙ্গে ভারতের একটি গভীর ও কার্যকরী সম্পর্ক বজায় থাকবে। মিয়ানমারের এ গৃহযুদ্ধে ভারতের ভূমিকা হতে পারে খুবই কৌশলপূর্ণ কূটনৈতিক।

মিয়ানমারের এ সাম্প্রতিক রাজনৈতিক পরিস্থিতি স্বাভাবিকভাবেই রোহিঙ্গা প্রত্যাবর্তনে প্রভাব ফেলবে। আশ্চর্যজনকভাবে প্রত্যাবাসন নিয়ে বাংলাদেশ-মিয়ানমার দ্বিপক্ষীয় আলোচনা শুরু হওয়ার কিছুদিনের মধ্যেই সেনা অভ্যুত্থান ঘটে। এখন মিয়ানমারের অবস্থার আরও অবনতি ঘটলে এ ১১ লাখ রোহিঙ্গার ফিরে যাওয়ার বদলে নতুন শরণার্থী অনুপ্রবেশ ঘটতে পারে এবং রোহিঙ্গাদের সঙ্গে অন্যান্য জাতিভিত্তিক শরণার্থীরাও যুক্ত হতে পারে। বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমানা দিয়ে স্বাভাবিক সময়ই প্রচুর পরিমাণে অস্ত্র, মাদকদ্রব্য ও মানুষ অবৈধভাবে পাচার হয়ে থাকে। পুরোদমে গৃহযুদ্ধ শুরু হলে এর মাত্রা বহুগুণে বেড়ে যেতে পারে। ফলে বাংলাদেশকে তার সীমান্ত নিরাপত্তা নিয়ে অনেক বেশি সাবধান হতে হবে।

সীমান্তে নিরাপত্তা বিঘ্নিত হলে দুই দেশের বিভিন্ন সন্ত্রাসবাদী গোষ্ঠী এক হয়ে হামলা ও সংঘর্ষ বাড়িয়ে দিতে পারে। বাংলাদেশে রোহিঙ্গাদের প্রবেশ ও উপস্থিতি ইতিমধ্যে সীমান্তবর্তী মানুষের মধ্যে একধরনের সাম্প্রদায়িক ও ধর্মীয় কোন্দল তৈরি করেছে, এ অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে এর আরও অবনতি হতে পারে।

সময় থাকতে এটিও চিন্তা করা দরকার যে নতুন করে কোনো শরণার্থীর ঢল বা পাশের দেশের গৃহযুদ্ধের প্রভাব সহ্য করার ক্ষমতা বাংলাদেশের কতটুকু আছে। মিয়ানমারে সহিংসতা শুরু হলে ও অস্ত্রের চালান আসতে থাকলে বাংলাদেশের নিরাপত্তার জন্য হবে ভয়ানক। এ অস্ত্রের একটি অংশ দেশের মধ্যে ঢুকে যাওয়ার আশঙ্কা থাকবে, যা আমাদের অভ্যন্তরীণ সামাজিক সুরক্ষাকে বিঘ্নিত করতে পারে। এর চরম প্রভাব পড়বে আমাদের চট্টগ্রাম পার্বত্য অঞ্চলে। সেখানকার বিভিন্ন সন্ত্রাসী ও বিচ্ছিন্নতাবাদী গ্রুপ নতুন করে সক্রিয় হওয়ার সুযোগ পাবে। সীমান্তে নিরাপত্তা বিঘ্নিত হলে দুই দেশের বিভিন্ন সন্ত্রাসবাদী গোষ্ঠী এক হয়ে হামলা ও সংঘর্ষ বাড়িয়ে দিতে পারে। বাংলাদেশে রোহিঙ্গাদের প্রবেশ ও উপস্থিতি ইতিমধ্যে সীমান্তবর্তী মানুষের মধ্যে একধরনের সাম্প্রদায়িক ও ধর্মীয় কোন্দল তৈরি করেছে, এ অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে এর আরও অবনতি হতে পারে।

মিয়ানমারের সঙ্গে সামুদ্রিক সীমানা এবং উভয় দেশ বঙ্গোপসাগর দ্বারা সংযুক্ত থাকার ফলে বাংলাদেশের সামুদ্রিক প্রতিরক্ষা ঝুঁকির মধ্যে পড়বে এবং আমাদের এখানে জলদস্যু ও বিভিন্ন অবৈধ ব্যবসার প্রবণতা বেড়ে যেতে পারে। এতে আমাদের ‘ব্যবসা ও সংযুক্তি’-এর যে নীতি এবং যাকে সামনে রেখে আমরা দ্রুত বর্ধিষ্ণু অর্থনীতিতে পরিণত হতে চাইছি, তা বাধাগ্রস্ত হবে। আমাদের সরবরাহব্যবস্থায় এর প্রভাব পড়বে সবচেয়ে বেশি। আমাদের বিস্তর উপকূলরেখা ও ২০০ নটিক্যাল মাইলের বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল ‘সামুদ্রিক অর্থনীতি’ বিস্তারের যে সুযোগ সৃষ্টি করেছে, যা আমাদের অর্থনৈতিক অগ্রগতির জন্য গুরুত্বপূর্ণ। এ অঞ্চলে সহিংসতার সূত্র ধরে অন্য অনেক দেশ এখানে নিজেদের উপস্থিতি বাড়াতে পারে। বাংলাদেশের বন্দর এলাকার খুব কাছাকাছি তাদের বিচরণ টের পাওয়া যাবে এবং বন্দরের কাছাকাছি বিদেশি শক্তির অবস্থান সব সময়ই একটি আতঙ্কের বিষয়।

ইতিহাস থেকে দেখা যায় যে একটি অঞ্চলে যেকোনো একটি দেশে বিশৃঙ্খলা পুরো অঞ্চলকে অস্থিতিশীল করে এবং উগ্র সন্ত্রাসবাদ বিকাশের ক্ষেত্র তৈরি করে। যেকোনো গৃহযুদ্ধে প্রতিবেশী দেশের অংশগ্রহণ পুরো অঞ্চলকে দারিদ্র্য, সহিংসতা, উগ্রবাদ, প্রতিরক্ষাব্যবস্থার অবনতির সর্বোচ্চ পর্যায়ে নিয়ে যেতে পারে এবং দক্ষিণ এশিয়ার এ অঞ্চলের দেশগুলোর এখনো এ ধাক্কা সামলে ওঠার সামর্থ্য নেই। কোভিড-১৯ অতিমারির জন্য ইতিমধ্যে এ অঞ্চলের দেশগুলো অর্থনৈতিক মন্দার দিকে যাচ্ছে এবং গৃহযুদ্ধের মতো আরেকটি বিপদ এ অবস্থাকে আরও নেতিবাচক করে তুলবে।

এখন পর্যন্ত বাংলাদেশ মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে নিরপেক্ষ অবস্থানে আছে। কিন্তু তৃতীয় কোনো পক্ষ এখানে নিজের স্বার্থ খুঁজতে এলে বাংলাদেশকেও সেভাবে নিজের পররাষ্ট্রনীতি পর্যালোচনা করতে হবে। আমাদের অর্থনৈতিক স্বার্থে পশ্চিমা ও পূর্বাঞ্চলীয় দেশগুলোর সঙ্গে ভালো সম্পর্ক বজায় রাখা খুব জরুরি এবং এ ক্ষেত্রে যেকোনো একপক্ষীয় সিদ্ধান্ত হবে ক্ষতিকর। আঞ্চলিক বিভিন্ন দেশ থেকে আমাদের ওপর নানা রকম কূটনৈতিক চাপ আসতে পারে, যা সামলে ওঠার জন্য আমাদের যথাযথ কূটনৈতিক প্রস্তুতি থাকতে হবে। প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞদের নিয়ে কমিটি গঠন করে সম্ভাব্য চিত্র বিবেচনায় ধরে পরিকল্পনা তৈরি ও সে অনুযায়ী পদক্ষেপ নেওয়া এখন সময়ের প্রয়োজন। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মিয়ানমারবিষয়ক অনুবিভাগের তত্ত্বাবধানে একটি ‘ক্রাইসিস ওয়াচ সেল’ তৈরি করা যেতে পারে, যাদের মূল কর্তব্য হবে মিয়ানমারের রাজনৈতিক কার্যক্রমের পুঙ্খানুপুঙ্খ অগ্রগতির প্রতি দৃষ্টি রাখা এবং তার বিস্তারিত বিশ্লেষণ করা। কূটনৈতিক সচেতনতা বৃদ্ধি ও আন্তর্জাতিক মহলে মিয়ানমারের সংঘর্ষের পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশের অবস্থান ও উদ্বেগের বিষয়গুলো তুলে ধরা খুবই জরুরি।

মেজর জেনারেল আ ন ম মুনীরুজ্জামান এনডিসি পিএসসি (অবসরপ্রাপ্ত), সভাপতি, বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব পিস অ্যান্ড সিকিউরিটি স্টাডিজ।