মুকুন্দপুরের যুদ্ধ ও মুক্তিবাহিনীর বিজয়

১৯৭১ সালে আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অনার্স শেষ বর্ষের ফাইনাল পরীক্ষার্থী ছিলাম। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ডাকে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিই। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে আমি বাংলাদেশ সামরিক বাহিনীর প্রথম ওয়ার কোর্সে সেরা ক্যাডেট নির্বাচিত হয়ে সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট পদে কমিশন লাভ করি এবং ‘সিএনসি কেইন’ লাভ করি।

কমিশনপ্রাপ্তির পর কর্নেল মেজর সফিউল্লাহর নেতৃত্বাধীন ৩ নম্বর সেক্টরে মুকুন্দপুরের কলকলিয়া সাব-সেক্টরের প্রতিরক্ষা অবস্থান ও বামটিয়া সাব-সেক্টরে মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্পের অধিনায়কের দায়িত্ব দেওয়া হয়। প্রথমে পাকিস্তানি বাহিনীর অবস্থান জেনে তাদের প্রতিরক্ষা অবস্থানের বিস্তৃতি, অধিনায়কের নাম-পদবি এবং অফিসার ও সৈনিকের সংখ্যা, অস্ত্র ও অন্যান্য তথ্য সংগ্রহ করি।

বিভিন্ন এলাকায় রেকি করে ও প্রাপ্ত তথ্য বিশ্লেষণে চান্দপুরে ও মুকুন্দপুরে পাকিস্তানি বাহিনীর প্রতিরক্ষা অবস্থানের বেশ কিছু দুর্বলতা দেখতে পাই। মুকুন্দপুরকেই প্রথম আক্রমণ করার জন্য বেছে নিই। আমার ক্যাম্পের ৩২ জন দুঃসাহসী মুক্তিযোদ্ধার বাড়ি মুকুন্দপুর ও এর আশপাশের গ্রামে। তঁারা এতই দুঃসাহসী ছিলেন, এক রাতে দক্ষিণ দিক থেকে মুকুন্দপুরের শত্রুর অবস্থান রেকি করতে করতে শত্রুর অবস্থানের এত কাছে নিয়ে যায় যে শত্রু আমাদের বুকে টর্চ মেরে ‘হল্ট, হ্যান্ডসআপ’ বলে আমাদের থামার নির্দেশ দেয়। এ আওয়াজের সঙ্গে সঙ্গে তাজু ও আমি লাফিয়ে উঁচু-নিচু ভূমি গড়িয়ে শত্রুর গুলি থেকে নিজেদের রক্ষা করি।

মুকুন্দপুরের অবস্থান কৌশলগত দিক থেকে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আখাউড়া থেকে সিলেট, সিলেট থেকে আখাউড়া হয়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় আসা-যাওয়ার ঠিক মাঝখানটাতেই মুকুন্দপুর। জুন থেকে নভেম্বর পর্যন্ত মুকুন্দপুরে বেশ কিছু যুদ্ধ হয়। দ্বিতীয় বেঙ্গল রেজিমেন্টের লেফটেন্যান্ট হেলাল মোর্শেদ ও লেফটেন্যান্ট নাসির উদ্দিনের নেতৃত্বে পরিচালিত এসব যুদ্ধে পাকিস্তানি সেনাদের বহনকারী একটি ট্রেন ধ্বংস করা হয় এবং বেশ কিছু সৈন্য হতাহত হয়। মুকুন্দপুরে রেকি করার সময় যোগাযোগ হয় গোয়ালনগর গ্রামের সায়রা খাতুন নামের এক দুঃসাহসী তরুণীর সঙ্গে। তার বাবা আজিজ চৌকিদার পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সহযোগী ছিল। পাকিস্তানিরা সায়রাকে তুলে নিয়ে গিয়েছিল। অপমানিত এই নারী মুক্তিবাহিনীকে সহযোগিতা করতে আগ্রহ দেখালে আমি তাকে পাকিস্তানি বাহিনী সম্পর্কে  খোঁজখবর দিতে বলি। সায়রা পাকিস্তানি বাহিনীর বাংকার, সৈন্যসংখ্যা, অধিনায়কের নাম, হালকা মেশিনগান ও ভারী মেশিনগান কোথায় বসানো, কোন দিকে তাক করে বসানো—সব তথ্য এনে দেয়। এরপর আগরতলায় অবস্থিত বাংলাদেশ ফোর্সের হেডকোয়ার্টারে মেজর নুরুজ্জামানের কাছে অস্ত্র ও গোলাবারুদ চাইলে উনি তা আমাকে সরবরাহ করেন।

মুকুন্দপুর আক্রমণের পরিকল্পনা প্রণয়ন ও প্রস্তুতি ৭ নভেম্বরের মধ্যে সম্পন্ন করি এবং স্থির করি ১০ নভেম্বর আক্রমণ করার। পরিকল্পনার ছক ছিল প্রধান আক্রমণকারী দল অনুপ্রবেশ করে শত্রুর অবস্থানে পশ্চিমে রেললাইনের সমান্তরালে উঁচু ভূমিতে অবস্থান নেবে। আর বিচ্ছিন্নকারী দল শত্রুর অবস্থানে উত্তরে মুকুন্দপুর রেলস্টেশনে উত্তর-পশ্চিম দিকে মুখ করে একটি প্লাটুন ব্লক পজিশন নেবে। আরেকটি প্লাটুন মূল দলের দক্ষিণে উঁচু ভূমির পাশ ঘেঁষে দক্ষিণ দিকে মুখ করে অবস্থান নেবে। আরেকটি প্লাটুন শত্রুর সম্মুখে পূর্ব দিকে অবস্থান নিয়ে শত্রুকে সম্মুখ থেকে গোলাগুলি করে ব্যস্ত রাখবে। আমাদের ফায়ার সাপোর্ট হিসেবে সেকেন্ড বেঙ্গলের মর্টার প্লাটুন শত্রুর অবস্থানের ওপর গোলাবর্ষণ করবে। বিকেল চারটায় ইনটেনসিভ গোলাবর্ষণের পর মর্টার গোলাবর্ষণ বন্ধ হবে।

আর মূল দল আমার ও আমার কোর্সমেট লেফটেন্যান্ট মনছুরুল ইসলাম মজুমদারের নেতৃত্বে শত্রুর অবস্থানের ওপর আক্রমণ করবে। আমার এই আক্রমণ পরিকল্পনা যখন সম্পন্ন, ৯ তারিখ দুপুরে ভারতীয় সেনাবাহিনীর ১৮ রাজপুত ব্যাটালিয়ন অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল ভার্মা তঁার ছয়-সাতজন অফিসার, সৈন্যসহ আমার ক্যাম্পে আসেন। তিনি তঁাকেও এই যুদ্ধে শরিক করতে বলেন এবং ডিভিশনাল আর্টিলারি সাপোর্ট নিশ্চিত করার প্রস্তাব দেন।  ডিভিশনাল আর্টিলারির কথা শুনে আমি আগ্রহী হই, ১০ তারিখের আক্রমণ পরিকল্পনা স্থগিত করি। পরের তিন রাত ১৮ রাজপুত অফিসারদের নিয়ে শত্রুর অবস্থান রেকি করি। এরপর ১৬ নভেম্বর লে. কর্নেল ভার্মা আমাকে সঙ্গে নিয়ে একটি স্যান্ড মডেলের ওপর রাঙ্গুটিয়া বিএসএফ ক্যাম্পের বিপরীতে একটি জঙ্গলে আক্রমণের অংশগ্রহণকারী অধিনায়কদের মৌখিক আদেশ দেন। এতে বলা হয়, আমার কোম্পানি শত্রুর অবস্থানে মূল অ্যাসল্ট কোম্পানি হিসেবে কাজ করবে। আর যেসব স্থানে আমি প্লাটুন নিয়োজিত করার পরিকল্পনা করেছিলাম, সেসব স্থানে একটি করে ১৮ রাজপুত কোম্পানি নিয়োগ করেন কর্নেল ভার্মা এবং একটি অতিরিক্ত ১৮ রাজপুত কোম্পানিকে গোয়ালনগর গ্রামে অবস্থান নেওয়ার জন্য বলেন।

পরিকল্পনা অনুযায়ী ১৮ নভেম্বর আঁধার রাতে আমরা যার যার সৈন্যদল কোম্পানি নিয়ে মুকুন্দপুরে অনুপ্রবেশ করে ট্রেঞ্চ নির্মাণ শুরু করি। রাত চারটার মধ্যে প্রত্যেকের ট্রেঞ্চ নির্মাণ শেষ হয়। আমি ভোর পর্যন্ত ঘুরে ঘুরে সবার অবস্থান দেখি। ভোরের আলো ফুটলে দেখা যায় শত্রুর বাংকার।  আমি ট্রেঞ্চে। সঙ্গে রফিক, মোজাম্মেল ও ওয়্যারলেস অপারেটর। পাকিস্তানি বাহিনীর চারটি বাংকারের মুখোমুখি আমরা। অতিরিক্ত ১৮ রাজপুত কোম্পানিটি গোয়ালনগরে যেতে অস্বীকার করে আমার কোম্পানির সঙ্গে অবস্থান করতে চায়। তারা আমার কোম্পানির অবস্থান উঁচু ঢাল ঘেঁষে উত্তর-পশ্চিম মুখ করে অবস্থান নেয়।

শত্রুরা আমাদের অবস্থান টের পেয়ে গোলাগুলি শুরু করে। আমরাও পাল্টা গুলি ছুড়ি। আমাদের সৈনিকেরা যেভাবে গুলি ছুড়তে থাকে, তাতে তঁাদের কাছে থাকা ৬০-৭০টি গুলি অল্প সময়েই শেষ হয়ে যাবে। আমি দ্রুত অধিনায়ক লে. মনছুরুল ইসলাম মজুমদার ও অধিনায়ক সুবেদার মান্নাফকে তঁাদের প্লাটুনের সৈন্যদের গুলি ছোড়া নিয়ন্ত্রণ করতে বলি। আমার কোম্পানির অবস্থান শত্রুর অবস্থানের এত কাছে ছিল, আমাদের নিজস্ব আর্টিলারির গোলা আমাদের কোম্পানির সামনে ও পেছনে পড়ছিল।

ঘণ্টাখানেক পর গোলাগুলি স্তিমিত হয়ে এলে আমি রানারকে নিয়ে আমার অবস্থানের পশ্চিম দিকটা দেখতে যাই। ওখানে একটি বাড়িতে একজন বয়স্ক পুরুষ ও একজন নারী ছিলেন, তঁারা আমাদের পান্তাভাত খাওয়ান।  সকাল ১০টার দিকে দেখতে পাই, আমাদের অবস্থানের পশ্চিমে গোয়ালনগর গ্রামের কিনারায় আমাদের দিকে মুখ করে বিভিন্ন গাছের নিচে পাকিস্তানি সেনারা অবস্থান নিচ্ছে। এটা দেখে আমার বঁায়ের রাজপুত কোম্পানির অধিনায়কের কাছে যাই। দেখতে পাই, গোয়ালনগর গ্রাম থেকে খাকি হাফপ্যান্ট পরা অস্ত্রহীন দুই ব্যক্তি মাথায় হাত তুলে আমাদের দিকে আসছে। আমরা তাদের আসতে দিই, তারা আমাদের জানায়, হাবিলদার গোলাপ খান তার সৈন্যদলসহ আমাদের কাছে আত্মসমর্পণ করতে চায়। আমরা তাদের বলি, দুপুর ১২টার মধ্যে আসতে হবে। তারা আসবে দুজন দুজন করে মাথার ওপর অস্ত্র তুলে ধরে। আমি তাদের একজনকে রেখে দিতে চেয়েছিলাম, কিন্তু রাজপুত অধিনায়ক তাদের দুজনকে ছেড়ে দিতে বলেন। সময়সীমা গড়িয়ে গেল, গোলাপ খানের সৈন্যদল আত্মসমর্পণ করতে না এলে আমরা গোয়ালনগরে তাদের অবস্থানের ওপর গুলি চালাই এবং আর্টিলারি গোলাবর্ষণ করি। এরপর গোয়ালনগরে শত্রুর আর নড়াচড়া দেখতে পাইনি। আমাদের গোলাগুলিতে তারা পিছু হটে যায়।

আমার কোম্পানির সৈন্যদের যখন নিয়ন্ত্রণ করছি, তখন বেলা তিনটার দিকে ওয়্যারলেসে কর্নেল ভার্মা জানান, তঁার যুদ্ধ পরিকল্পনায় কিছুটা পরিবর্তন হয়েছে। আমার কোম্পানি নয়, শত্রুর ডান দিক থেকে ১৮ রাজপুত বাহিনীর ক্যাপ্টেন প্রিতম তঁার কোম্পানি নিয়ে শত্রুর ওপর আক্রমণ করবে। কর্নেল ভার্মার বক্তব্য আমার সৈন্যদের নিরাশ করে। পরিবর্তিত পরিকল্পনা অনুযায়ী আক্রমণ শুরু হয়। ওই সময় দেখি কিছু পাকিস্তানি সৈন্য আমাদের ডান দিক থেকে পালাচ্ছে, আমার কিছু সৈন্য নিয়ে আমি তাদের তাড়া করি। ওদের দুজন গুলি খেয়ে রেললাইনের ওপর পড়ে যায়। এরপর দক্ষিণ দিকে সার্চ করে কিছু না পেয়ে আমরা নিজ অবস্থানে ফিরে আসি। সন্ধ্যার আগেই পাকিস্তানি বাহিনী পরাজয়বরণ করে। ২৮ জন পাকিস্তানি সৈন্য মুক্তিবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করে এবং ১৯ জন পাকিস্তানি সৈন্য নিহত হয়। অনেক অস্ত্র ও গোলাবারুদ আমাদের হস্তগত হয়।

মুকুন্দপুর যুদ্ধে আমাদের বিজয় যৌথ বাহিনী গঠনে সহায়ক হয়। আখাউড়া ডিভিশনাল পর্যায়ে বৃহৎ যুদ্ধ মুকুন্দপুরের যুদ্ধের পরিকল্পনার ছক ব্যবহার করে যৌথ বাহিনী অভূতপূর্ব সফলতা অর্জন করে। কিন্তু মুকুন্দপুর যুদ্ধের পরিকল্পনাকারীর পরিচয় আজও অনেকের কাছে অজানা রয়ে গেছে। মুকুন্দপুরে মুক্তিবাহিনীর বিজয়ের পর পশ্চিমা সংবাদপত্রে খবর বেরিয়েছিল, মুক্তিবাহিনী বাংলাদেশের একটি অঞ্চল পাকিস্তানিদের কবল থেকে মুক্ত করেছে। সেই পরাজয়ের ফলে এক মাসের কম সময়ে সারা বাংলাদেশে মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনীর কাছে যুদ্ধে পরাজিত হয়ে ১৬ ডিসেম্বর রেসকোর্সে পাকিস্তানি বাহিনী আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়, মুক্ত হয় বাংলাদেশ।

মেজর জেনারেল (অব.) সায়ীদ আহমেদ বীর প্রতীক: মুক্তিযোদ্ধা, অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তা।