
১৯৫২ সালের ফেব্রুয়ারিতে ২৪ বছরের তরুণ মুহাম্মদ হাবিবুর রহমানকে দেশের মানুষ চিনেছিল একজন ভয়ডরহীন ভাষাযোদ্ধা হিসেবে, যিনি ১৪৪ ধারা ভেঙে সংগ্রামের পথে নেমেছিলেন। এই আইন ভাঙার কাজটি ছিল এক ঔপনিবেশিক, জবরদখলকারী শক্তির অপশাসনের বিরুদ্ধে বলিষ্ঠ প্রতিবাদ। নিবর্তনমূলক ঔপনিবেশিক আইনের কোনো বৈধতা তাঁর চোখে ছিল না। তিনি জানতেন, কিছু আইন আছে, যা মানুষকে দমন করে, শোষণ করে; কিছু আইন মানুষের জীবন, স্বাধীনতা আর সুখের সুরক্ষা দেয়। দুই আইনের এই পার্থক্য তাঁর কাছে খুব পরিষ্কার হয়ে ধরা দিত এবং এই পার্থক্যের নেতির দিকের আইনগুলো কীভাবে প্রাপ্তির দিকে নিয়ে আসা যায়, তা নিয়ে তাঁর পরিষ্কার কিছু ধারণা ছিল।
অনেক পরে তিনি যখন শিক্ষকতা ছেড়ে আইন পেশায় স্থিত হন, এবং নৈতিকতা ও সুবিচারের মাপকাঠিতে তাঁর কাজকর্মকে সংঘটিত করেন, তখন দেশের মানুষ তাঁকে জানল একজন বিবেকবান, প্রাজ্ঞ আইনজীবী হিসেবে; একজন স্থিতধী, নীতিমান বিচারপতি হিসেবে। শিক্ষকতায় থেকে গেলে তিনি ইতিহাস নিয়ে গবেষণা-অধ্যাপনা করে খ্যাতিমান হতে পারতেন, হয়তো ইতিহাসবিদ্যার একাডেমিক চর্চার পাশাপাশি এ বিষয়ে মৌলিক কিছু জ্ঞানও সৃষ্টি করতে পারতেন, কিন্তু তিনি বেছে নিলেন আইন-আদালতের জগৎ, যেখানে বিচারের নিক্তি অবিচারের দিকে একটুখানি হেলে পড়লে শুধু ব্যক্তি নয়, সমাজের জীবনেও নামে বিপর্যয়। এই কঠিন কাজটি বিচারপতি হাবিবুর রহমান করেছেন নিজের বিবেকের কাছে সৎ থেকে।
১৯৯৬ সালে সপ্তম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে তিনি শপথ নিলেন এবং তাঁর কাঁধে চাপানো দায়িত্ব তিনি ষোলো আনা পালন করলেন। তাঁর সরকারকে কোনো বিতর্ক স্পর্শ করতে পারেনি এবং তা সম্ভব হয়েছে বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমানের নিরপেক্ষতার সততা, আইনের শাসনের প্রতি তাঁর নিষ্ঠা এবং প্রশাসক হিসেবে তাঁর কুশলতার জন্য। তাঁর সহকর্মীদের নিয়ে তিনি একটি চমৎকার ও গতিশীল সরকার গড়ে তুলেছিলেন। তাঁর ক্ষমতা ছিল, কিন্তু ক্ষমতাকে তিনি শিরোস্ত্রাণের মতো পরেননি; বরং পরেছেন একজন সেবিকার অ্যাপ্রনের মতো, যা সেবা ও নিষ্ঠার প্রতীক, যা দেখে মানুষ আস্থা পায়।
বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান তাঁর গবেষক সত্তাটিকে কখনো আড়ালে রাখেননি। সারা কর্মজীবনে অনেক গবেষণা করেছেন, বই লিখেছেন, সাহিত্য রচনা করেছেন। চমৎকার ভাষায় তিনি লিখতেন এবং লেখালেখির বিষয়ও ছিল বিচিত্র—কোরআন সূত্র থেকে নিয়ে প্রবচন, রবীন্দ্রনাথ থেকে নিয়ে সমাজ। আমার বিস্ময় জাগত লেখক হাবিবুর রহমানকে দেখে, তাঁর বই পড়ে। তাঁর লেখালেখির সূত্র ধরেই তাঁর সঙ্গে আমার পরিচয়। কিছু লিখতে বসার আগে তিনি পড়তেন, প্রচুর পড়তেন। আমাকে মাঝেমধ্যে ফোন করতেন—হয়তো শেক্সপিয়ারের কোনো নাটকের কোনো বিষয় বা চরিত্র নিয়ে, অথবা রবীন্দ্রনাথের চিত্রকলা নিয়ে দু-এক কথা বলার জন্য। দু-একবার কোনো বই জোগাড় করে দিতে বলেছেন। সামনাসামনি দেখা হতো কম; কিন্তু দেখা হলে টুকটাক কথা বলতেন। কথা বেশি বলতেন না, তবে যখনই বলতেন—তাঁর সেই পরিশীলিত মুর্শিদাবাদি বাংলায়—বিষয়ের আদ্যোপান্ত ভেবে, গুছিয়ে বলতেন।
শেষবার যখন তাঁর সঙ্গে দেখা হয় তাঁর মৃত্যুর মাত্র দিন পনেরো আগে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার এক সহকর্মীর মেয়ের বিয়েতে, তখনো একইভাবে কথা বলেছেন। একটি টেবিলে আমরা বসেছিলাম, তাঁকে নিয়ে গোটা চার-পাঁচজন। তিনি ঘণ্টা দুয়েক ছিলেন, কনে আর বরের সঙ্গে মঞ্চে গিয়ে ছবিও তুলেছেন। হাসিমুখে, যেমন সচরাচর তাঁকে সামাজিক অনুষ্ঠানে দেখা যেত। তাঁকে দেখে, তাঁর কথা শুনে কারও মনে হওয়ার কথা ছিল না যে এরপর জগৎ মাত্র দুটি সপ্তাহ তাঁকে ধরে রাখতে পারব। ওই দুই ঘণ্টার যতটা সময় তিনি কথা বলেছেন—সব মিলিয়ে মিনিট পনেরোর মতো—তাঁর মনোযোগে একবারও চিড় ধরেনি, কথার খেই হারাননি। বরাবরের মতো সে রাতে তাঁর বলা কথাগুলো লিখে রাখলে কোনো সম্পাদনা ছাড়াই সেসব ছাপানো যেত। প্রতিটি বাক্যের ব্যাকরণ নির্ভুল, ইংরেজি-বাংলার মিশেলহীন, যেন তিনি অনেক সময় নিয়ে, অনেকটা মুসাবিদা করে লিখে তারপর বাক্যগুলো পড়েছেন। তাঁর ভাষার এই শক্তি আমার সমীহ জাগায়।
একবার তাঁকে নিউইয়র্কে আমন্ত্রণ জানিয়েছিল উত্তর আমেরিকার তিন ভাগ হয়ে যাওয়া বাংলাদেশি সমিতির এক ভাগ। সবচেয়ে ছোট এই ভাগটি আমাকেও দাওয়াত দিয়েছিল। নিউইয়র্কের একটি কনভেনশন হলে এক দিনের অনেকটা সময়জুড়েই তাঁর সঙ্গে ছিলাম। তিনি এ রকম জৌলুশহীন নিয়মের সমাবেশ দেখে হতাশ হয়েছিলেন, কিন্তু লাভটা হয়েছিল আমার। তাঁর সঙ্গে অনেক কথা বলার সুযোগ হয়েছিল। এবং কথার কেন্দ্রে ছিল সাহিত্য, দর্শন, সমাজ ও মানুষ নিয়ে তাঁর ভাবনা। বাম রাজনীতি, ষাটের শুরুর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, মুক্তিযুদ্ধ, সমরবাদ, গণতন্ত্র—এসব নানা বিষয়ের পাশাপাশি কার্লাইল, বার্নার্ড শ থেকে নিয়ে রবীন্দ্রনাথ, শামসুর রাহমান—কত বিষয়েই যে তিনি কথা বলেছেন। কিন্তু আমার অবাক লেগেছে, একটানা দু-তিন মিনিটের বেশি তিনি বলেননি, এবং তা-ও খুব বেশিবার নয়। কিন্তু আমার মনে হয়েছে, অনেক বিষয় যেন তাঁর সঙ্গে আলোচনা থেকে আমার জানা হয়ে গেল।
আমাদের সময়ে ঘাড়ে মাথায় উঁচু, শক্ত শিরদাঁড়া আর স্বচ্ছ বিবেকের খুব বেশি মানুষকে আমি পাইনি। যাঁদের পেয়েছি, তাঁদের ছায়ায় মাঝেমধ্যে গিয়ে দাঁড়িয়েছি, মনে হয়েছে একজন আছেন আমাদের ওপর ছায়া মেলে। দুই বছর আগে এ রকম এক ছায়া দেওয়া, অভয় দেওয়া মানুষ বিচারপতি হাবিবুর রহমান চলে গেলেন। আমরা অনেকটা নিঃস্ব হয়ে পড়লাম। তবে তাঁর আদর্শ ধারণ করে নিশ্চয় অনেকে তৈরি হচ্ছেন, হয়তো অনেক তরুণ। এই সম্ভাবনার আশাটাই আমাদের ভরসা।
বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমানের দ্বিতীয় মৃত্যুবার্ষিকীতে তাঁর প্রতি আমার শ্রদ্ধা।
সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম: কথাসাহিত্যিক। অধ্যাপক, ইংরেজি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।