মুহিবুল্লাহ হত্যার জের যেন নিরীহ রোহিঙ্গাদের ওপর না পড়ে

রোহিঙ্গা শরণার্থীশিবিরে অবিসংবাদিত নেতা হয়ে উঠেছিলেন মুহিবুল্লাহ

রোহিঙ্গা নেতা মুহিবুল্লাহ হত্যাকাণ্ডের দিন কক্সবাজারে ছিলাম। রোহিঙ্গাবিষয়ক একটি গবেষণার মাঠকর্ম চলছিল। সন্ধ্যায় গবেষণা সহকর্মীদের সঙ্গে মুহিবুল্লাহর নেতৃত্ব প্রসঙ্গটি আলোচনা হচ্ছিল। বিষয় ছিল, মুহিবুল্লাহর সাম্প্রতিক নিষ্ক্রিয়তা।

২০১৯ সালের দিকে রোহিঙ্গা শরণার্থীশিবিরে অবিসংবাদিত নেতা হয়ে উঠেছিলেন মুহিবুল্লাহ। তাঁর বড়সড় সমর্থক ও অনুসারী দলও তৈরি হয়েছিল। যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেসে আমন্ত্রিত হয়েছিলেন তিনি। মার্কিন প্রেসিডেন্টের সাক্ষাৎও মিলেছিল তাঁর। ফলে কক্সবাজারে রোহিঙ্গাদের সেবা সহায়তায় নিয়োজিত আন্তর্জাতিক দাতা ও সাহায্য সংস্থাগুলোতে তাঁর মতামত গুরুত্ববাহী ছিল। হোটেলে ফিরতে না ফিরতেই তাঁর হত্যাকাণ্ডের খবরটি শুনে হতবাক হয়েছি। নিরাপত্তাহীনতার আশঙ্কায় আমাদের পরদিনের মাঠকর্ম বাতিল হয়ে গেল।

মুহিবুল্লাহ বুদ্ধিমান, গোছানো, নজরকাড়া ব্যক্তিত্বের অধিকারী ছিলেন। তা ছাড়া শিক্ষিত ছিলেন। নিজে শিক্ষক ছিলেন। পরিচিতি ছিল ‘মাস্টার মুহিবুল্লাহ’। ‘শিক্ষক’ পরিচয়ের কারণে আমভাবনা ছিল একজন শিক্ষককে কে-ই বা মারতে আসবে? বিবিসি স্থানীয় এক সাংবাদিকের বরাতে লিখেছে, তিনি ‘জীবননাশের আশঙ্কা’ সব সময়ই উড়িয়ে দিতেন। শিক্ষক শ্রদ্ধেয়জন এবং তুলনামূলকভাবে বেশি গ্রহণযোগ্য, হয়তো এমনটি তিনিও ভাবতেন। কিন্তু শিক্ষক বলেই নিরাপদ—তাঁর হত্যাকাণ্ড গণপরিসরের এই ভাবনাটিকে ভুল প্রমাণ করে দিয়েছে। আগের সপ্তাহে এক নম্বর পূর্ব ক্যাম্পে মাঠকর্ম চলাকালে খানিক বিরতিতে বাইরে বেরিয়ে এলে একজন আগন্তুক জিজ্ঞেস করেছিলেন মুহিবুল্লাহর সাক্ষাৎকার নেব কি না? বলেছিলাম, না। আগের অভিজ্ঞতা থেকে ভেবেছিলাম, পরেও তাঁর সাক্ষাৎ সহজেই মিলবে। তিনি যে অনিরাপদ হয়ে পড়েছেন, ধারণা করিনি।

২০২০ সালে মার্কিন প্রকাশনী লেক্সিংটন রোহিঙ্গা সংকট বিষয়ে আমাদের রচিত একটি গবেষণাগ্রন্থ ছাপে। সহলেখক ড. কাওসার আহমেদ গবেষণার অংশ হিসেবে তাঁর সাক্ষাৎকার নেন। সেই সাক্ষাৎকারে রোহিঙ্গা নেতৃত্ব বিষয়ে তাঁর বক্তব্যে ছিল উদারতা ও বাস্তবতার চুলচেরা বিশ্লেষণ। ছিল রোহিঙ্গাদের স্বদেশে ফিরে যাওয়ার অধিকার আকাঙ্ক্ষার একাগ্র প্রকাশ। ছিল রোহিঙ্গা-মানবিকতার জন্য বিশ্বসমাজের শ্রদ্ধা, সমর্থন ও সহযোগিতা কুড়ানোর আগ্রহ। বাংলাদেশের প্রতি অশেষ কৃতজ্ঞতা প্রকাশেও কমতি রাখেননি তিনি। উগ্রবাদী কোনো ভাবনার প্রতি তাঁর দুর্বলতার প্রকাশ তো ছিলই না, বরং তাঁর বয়ানে উগ্রবাদ বিষয়ে আপত্তি ও অসমর্থনই বেশি প্রকাশ পেয়েছিল।

তারপর নাফ নদীর জল কোথায় কীভাবে কতটা গড়িয়েছে, কেন তাঁকে খুন হতে হলো বুঝে ওঠা কঠিন। ২০১৯ সালে উচ্ছেদের দ্বিতীয় বর্ষে রোহিঙ্গাদের নিয়ে তিনি এক বিশাল সমাবেশ আয়োজন করে বসেন। সেই আয়োজন দেশি-বিদেশি সব মহলের নজর কাড়লেও বাংলাদেশের জন্য ঘটনাটি ছিল বিব্রতকর। সংগত কারণেই বাংলাদেশ সরকার সতর্ক ও সাবধানী হয়ে ওঠে। সহজেই অনুমেয় যে মিয়ানমার সরকার তাঁকে আরও বেশি কড়া নজরদারিতে রেখেছিল। তাঁর চারপাশে চর-গুপ্তচরদের গিজগিজ করারই কথা। প্রকাশ্য বিরোধিতায় ছিল ও আছে সব মহলে ‘আল-ইয়াকিন’ নামে পরিচিত ক্ষমতাধর গুপ্ত সশস্ত্র গোষ্ঠীটি। তাঁর অনুজ নির্দ্বিধায় সাংবাদিকদের কাছে ভাইয়ের হত্যাকারী হিসেবে এই গোষ্ঠীর সক্রিয় কয়েকজন সদস্যের নামধামই দিয়েছেন।

আমজনগণ হিসেবে আমরা ধারণা করে নিতে পারি যে তিনি হয়তো তাঁর পেছনে প্রতিপক্ষ এবং গোয়েন্দাজালের বিস্তার-বিস্তৃতি টের পেয়েই বেশ খানিকটা নেপথ্যে চলে গিয়েছিলেন। গত দুই বছর তাঁর উপস্থিতিতে পুরোনো ঝলক বা তেজ কোনোটাই ছিল না। তবু তাঁকে খুন হতে হলো। তবে আম-রোহিঙ্গারা মনে করে, তাঁর প্রত্যাবাসনপন্থী মনোভাব ও কার্যক্রম বাংলাদেশের রোহিঙ্গা পরিকল্পনার সঙ্গে সাংঘর্ষিক ছিল না।

১০ লাখের বেশি আশ্রিত রোহিঙ্গার কত ভাগ অপরাধে জড়িত, জানা কঠিন। হয়তো ৫ ভাগের বেশি নয়। তবু সাধারণীকরণ বা সব রোহিঙ্গাকে দায়ী করার প্রবণতা সব মহলেই বাড়ছে। যদিও আমাদের পর্যালোচনা করা প্রায় সব গবেষণাকর্মেরই বক্তব্য দুটি। এক, সিংহভাগ রোহিঙ্গাই শান্তিপ্রিয়, অসহায় ও নিরীহ এবং ক্যাম্পগুলোতে সন্ত্রাস ও অপরাধের বাড়বাড়ন্ত দেখে হতাশ, ক্রুদ্ধ ও বিপন্ন। দুই, ২০১৭ সালে দেশচ্যুত রোহিঙ্গাদের সিংহভাগেরই চাওয়া মিয়ানমারে ফেরত যাওয়া

ক্যাম্পগুলোর দায়িত্বে থাকা সরকারের কর্মকর্তারা অনেকটা জ্বলন্ত উনুনে বসেই রোহিঙ্গাসেবা দিয়ে চলেছেন। তাঁরা সুদক্ষ এবং অবগত যে ক্যাম্পে রোহিঙ্গাদের মধ্যে বিভেদ ও অন্তর্দলীয় কোন্দল বেসামাল মাত্রায় বাড়ছে। নেতৃত্বের সংঘাত মাথাচাড়া দিচ্ছে। গ্যাং গজাচ্ছে। মাদক-বাণিজ্য, মাদক পাচার, নারীঘটিত অপরাধ ও সংঘবদ্ধ অপরাধী চক্রের সীমা বাড়ছে। স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে রোহিঙ্গাদের সংঘাত যারপরনাই বাড়ছে। অভিযোগ, রাতের ক্যাম্পগুলো দিনের ক্যাম্পের মতো থাকে না। সেগুলোর দখল চলে যায় বিভিন্ন দল-উপদলের হাতে। তখন তাদের আদেশ-নির্দেশই সার। মিয়ানমার থেকে দেশে মাদক ও অস্ত্র ঢুকছে। সীমান্তের ওপারের দেশি অস্ত্র তৈরির কারিগরেরাও চলে এসেছে। দিনের বেলায় পাহাড়ে লুকিয়ে থেকে তারা অস্ত্র বানিয়ে ভান্ডার বাড়াচ্ছে। আরাকান আর্মি বা সীমান্তনির্ভর অন্য বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠীর যোগসাজশ থাকার সন্দেহও রয়েছে। অস্ত্রের প্রয়োজনে গোষ্ঠীগুলোর প্রয়োজন কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা। সে জন্য মাদক ব্যবসার পাশাপাশি ভাড়াটে ডাকাত এবং খুনিদের সংঘও বাড়ছে। এককথায় স্থানীয়দের রোহিঙ্গাবিরোধী অভিযোগ এন্তার। সত্য-মিথ্যা মিলিয়ে সেগুলো দিন দিন এতটাই বাড়বাড়ন্ত যে স্ফুলিঙ্গ একসময় দাবানল হয়ে উঠতে পারে।

মুহিবুল্লাহ হত্যাকাণ্ডের দিনই কক্সবাজারের একটি হোটেলে ব্র্যাক-এর ‘সামাজিক সম্প্রীতি’বিষয়ক একটি গবেষণার ফল উপস্থাপন চলছিল। সেদিনের আলোচনায় জানা গেল, ২০১৭ সালের রোহিঙ্গা উচ্ছেদকালে এক জরিপে সারা দেশের উত্তরদাতাদের মাত্র ৩৯ ভাগ রোহিঙ্গাদের আশ্রয়দান সমর্থন করেছিল। কিন্তু চট্টগ্রাম-কক্সবাজারের সমর্থনদানকারী উত্তরদাতার সংখ্যা ছিল ৯০ ভাগের বেশি। তার পেছনে স্থানীয় ও রোহিঙ্গাদের যুগ যুগ ধরে বাণিজ্যিক ও বৈবাহিক-অবৈবাহিক আত্মীয়তা এবং সমঝোতা ও সহানুভূতির বিবেচনা ছিল। অথচ ২০২১ সালে এসে ৫ ভাগ স্থানীয় অধিবাসীও রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে অবস্থান মেনে নিতে নারাজ। তাদের ধারণা, দিনের বেলায় সরকারের ও এনজিওর জন্য সহযোগীর ভূমিকায় থাকা ব্যক্তিদের একাংশই হয়তো রাতের ক্যাম্পের সশস্ত্র দখলদারদের মূল সহযোগীর কাজ করছে। ফলে পারস্পরিক আস্থা ও বিশ্বাসের বদলে সব মহলেই অনাস্থা ও অবিশ্বাস বাড়ছে। মুহিবুল্লাহ হত্যাকাণ্ড তাদের রোহিঙ্গাবিরোধিতার আগুনে ঘি ঢেলেছে। তারা চাইছে সামরিক ব্যবস্থাধীনে কঠোর দমন।

১০ লাখের বেশি আশ্রিত রোহিঙ্গার কত ভাগ অপরাধে জড়িত, জানা কঠিন। হয়তো ৫ ভাগের বেশি নয়। তবু সাধারণীকরণ বা সব রোহিঙ্গাকে দায়ী করার প্রবণতা সব মহলেই বাড়ছে। যদিও আমাদের পর্যালোচনা করা প্রায় সব গবেষণাকর্মেরই বক্তব্য দুটি। এক, সিংহভাগ রোহিঙ্গাই শান্তিপ্রিয়, অসহায় ও নিরীহ এবং ক্যাম্পগুলোতে সন্ত্রাস ও অপরাধের বাড়বাড়ন্ত দেখে হতাশ, ক্রুদ্ধ ও বিপন্ন। দুই, ২০১৭ সালে দেশচ্যুত রোহিঙ্গাদের সিংহভাগেরই চাওয়া মিয়ানমারে ফেরত যাওয়া। ফলে নিরীহ রোহিঙ্গাদের ভীতি-আতঙ্কও দ্বিগুণ। ফুটন্ত কড়াই থেকে জ্বলন্ত উনুনে পড়তে যাওয়ার আতঙ্ক। একদিকে সন্ত্রাসীদের নির্যাতনের ভয়, অন্যদিকে সন্ত্রাস দমনের অভিযানে আরেকবার বিনা দোষে নিহত, আহত ও বাস্তুচ্যুত হওয়ার আশঙ্কা।

বাংলাদেশ রোহিঙ্গা বিষয়ে বরাবরই সুচিন্তা ও ধীমত্তার পরিচয় রাখছে। সক্ষমতা থাকলেও অপরাধের কঠোর নিয়ন্ত্রণে না নামার কারণ মিয়ানমার ছুতো পেয়ে রোহিঙ্গাদের সন্ত্রাস, মৌলবাদ ও বিচ্ছিন্নতাবাদের অভিযোগ তুলে প্রত্যাবাসনে অস্বীকৃতি জানাবে। আন্তর্জাতিক দাতাদেশ, দাতা সংস্থা, এনজিও এবং নাগরিক সমাজ মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগও তুলতে পারে। অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়, অপরাধ দমনে প্রশাসন হয়তো কঠোর হতে বাধ্য হবে। সে ক্ষেত্রে একটি বিষয়ই মনে রাখতে হবে। ক্যাম্পগুলোর গাদাগাদি অবস্থানের কারণে অপরাধ দমনের সশস্ত্র চেষ্টায় নারী-শিশু-বৃদ্ধ-বৃদ্ধা-প্রসূতি, প্রতিবন্ধীসহ অসহায় নিরপরাধ মানুষ যেন বলি না হয়। মানবসন্তানের ক্ষয়কে যেন ‘কোল্যাটেরাল ড্যামেজ’ শব্দবন্ধে ঢেকে যৌক্তিকতা দিতে না হয়।

হেলাল মহিউদ্দীন অধ্যাপক, নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয় এবং সদস্য, সেন্টার ফর পিস স্টাডিজ