সবুজ ঢাকার সন্ধানে

ধুলোয় ঢাকা পড়ছে ঢাকার সবুজ বৃক্ষ
ছবি: প্রথম আলো

ইতিপূর্বে প্রথম আলোয় প্রকাশিত ‘এক “মৃতপ্রায়” শহরে দাঁড়িয়ে’ শিরোনামে লেখাটি নিয়ে পাঠক-শুভানুধ্যায়ীদের সৌজন্যে একটা সেমিনার আর কিছু পড়ার উপাদান আমার হাতে আসে। আমাদের সবার লক্ষ্য একটাই, প্রিয় ঢাকা শহরকে বাঁচানো। আগের লেখার কিছু সূত্র ধরে নিয়েই এই লেখা।

কিছুদিন ধরে খুব হইচই গেল তেঁতুলতলার মাঠ নিয়ে, যা প্রধানমন্ত্রীর সরাসরি হস্তক্ষেপে এ যাত্রায় বেঁচে গেল। কিন্তু বাকি অন্য জায়গার কী অবস্থা? প্রথমেই বলে নিই, সরাসরি সরকারি কোনো উপাত্ত পাওয়া না গেলেও বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের (বিআইপি) গবেষণায় আর ড্যাপের প্রস্তাবনা থেকে কিছু তথ্য আমি জানাতে পারি।

কতটুকু আমাদের দরকার?

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে প্রতি একজন নাগরিকের জন্য ন্যূনতম বর্গমিটার সবুজ খোলা জায়গা প্রয়োজন। আবার লিডারশিপ ইন এনার্জি অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টাল ডিজাইন ফর নেইবারহুড ডিজাইন অনুযায়ী মাথাপিছু ২০ বর্গমিটার প্রয়োজন। ২০০৯ সালে ড্যাপের প্রতিবেদন অনুসারে ঢাকায় মাথাপিছু খালি জায়গার পরিমাণ শূন্য দশমিক ০৫২ বর্গমিটার, যা এখন আরও কমে গেছে। রাজধানীর জন্য করা ড্যাপের খসড়ায় (২০১৬-২০৩৫) বলা হয়েছে, আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুসারে প্রতি ১২ হাজার ৫০০ মানুষের জন্য একটি খেলার মাঠ প্রয়োজন। ঢাকার দুই সিটিতে প্রায় ১ কোটি ৮৪ লাখ মানুষ বাস করে। সে হিসাবে ঢাকায় মাঠ দরকার ১ হাজার ৪৬৬টি।

কেন দরকার খালি মাঠ?

বর্তমান পরিস্থিতিতে দেশের শহর এলাকার ৬১ দশমিক ৫ শতাংশ কিশোর-কিশোরী মাঝারি থেকে চরম মাত্রার মানসিক চাপে ভুগছে। তাদের একমাত্র বিনোদন এখন মুঠোফোন আর টেলিভিশন, যা নিয়ে যাচ্ছে তাদের সোনালি শৈশব, কেড়ে নিচ্ছে সৃষ্টিশীলতা আর আমরা পাচ্ছি দুর্বল এক ভবিষ্যৎ। মা-বাবাকে নিয়ে যেতে হয় কিডস জোনে, যা সবার সামর্থ্যের বাইরে।

আরও বাড়ছে অপরাধপ্রবণতা। জাতিসংঘের সংস্থা ইউনিসেফের হিসাবে, বাংলাদেশে কিশোর-কিশোরীদের সংখ্যা ৩ কোটি ৬০ লাখ। ২০২১ সালের প্রথম ৬ মাসে কিশোর অপরাধে ৮২১ মামলায় গ্রেপ্তার হয়েছে ১ হাজার ১৯১ জন। ৫০টির মতো কিশোর গ্যাং ঢাকায় তাদের অপরাধকর্ম করছে বলে পুলিশ ও র‌্যাব জানিয়েছে। আতঙ্কের ব্যাপার হলো, আট থেকে দশ হাজার কিশোর-কিশোরী বর্তমানে এসব গ্যাংয়ের সঙ্গে জড়িত এবং ছিনতাই, মাদকাসক্তি ও মাদকের চোরাচালান, ইভ টিজিং, হত্যাসহ বিভিন্ন ভয়াবহ অপরাধ করছে (কালের কণ্ঠ, ২ অক্টোবর, ২০২১)।

সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশনের (সিডিসি) গাইডলাইন মতে আমাদের প্রতি সপ্তাহে কমপক্ষে ৫ ঘণ্টা হাঁটা উচিত অথবা ৩০ হাজার স্টেপস (পাঁচ হাজার স্টেপ পার ডে), যা ১০ হাজার স্টেপ্স পার ডে করতে পারলে খুবই ভালো। কিন্তু সেটি করার জায়গা কোথায়? ফলাফলে বাড়ছে ডায়াবেটিস, হৃদ্‌রোগ, স্থূলতা, হাড়ক্ষয়সহ বহুবিধ রোগ। এমনকি অলসতার জন্য বাচ্চাদের স্থূলতাও দিন দিন বেড়ে যাচ্ছে।

বিআইপি কী বলে?

বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের (বিআইপি) গবেষণা থেকে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে বানানো এই গ্রাফটি ২০২০ সালে প্রথম আলোয় প্রকাশিত হয়েছিল।

বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের (বিআইপি) গবেষণা থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী ১৯৯৯ সালে রাজধানীতে খোলা জায়গা ছিল ১৪ শতাংশ। বর্তমানে তার পরিমাণ মাত্র ৪ দশমিক ৬১ শতাংশ। রাজধানীতে সবুজে আচ্ছাদিত এলাকার পরিমাণ ২০১৯ সালে ৯ দশমিক ২ শতাংশ। ২০ বছরে সবুজ-আচ্ছাদিত এলাকা কমেছে প্রায় ৩৮ শতাংশ। ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের ৯৩টি ওয়ার্ডে (দুই সিটিতে নতুন যুক্ত হওয়া ৩৬টি ওয়ার্ড ছাড়া) সরকারি-বেসরকারি মিলে ২৩৫টি খেলার মাঠ আছে।

এর বাইরে নতুন যুক্ত হওয়া ৩৬ ওয়ার্ডে ২১টি খেলার মাঠ রয়েছে। এর মধ্যে ৪১টি ওয়ার্ডে কোনো খেলার মাঠ নেই। ২৩৫টি মাঠের মধ্যে ১৪১টি রয়েছে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মালিকানায়, কলোনির মাঠ আছে ২৪টি, ঈদগাহ মাঠ আছে ১২টি। ১৬টি সরকারি মাঠ বিভিন্নভাবে দখল হয়ে গেছে। এর বাইরে মাত্র ৪২টি মাঠ আছে, যেগুলো সবাই ব্যবহার করতে পারে। শতকরা হিসেবে যা মাত্র ১৮ ভাগ। তবে সিটি করপোরেশনের মালিকানার বাইরের মাঠগুলো ধরলে সর্বোচ্চ ৩০ ভাগ মাঠ এখনো দখলমুক্ত আছে। কিন্তু সেসব মাঠের সব কটিতেই সাধারণ মানুষ যেতে পারেন না।

আরও পড়ুন

মেয়রদ্বয়ের প্রচেষ্টা কতটুকু?

ঢাকা দক্ষিণের সাবেক মেয়র সাইদ খোকন ২০১৬ সালে ‘জল সবুজের কাব্যে’ প্রকল্পের অধীনে ৭০টি স্থাপত্য প্রতিষ্ঠান থেকে প্রস্তাব নেন। প্রকল্পের লক্ষ্য ছিল ঢাকা দক্ষিণের ৩১টা মুক্ত উদ্যানকে সংস্কার করে উদ্যান, খেলার মাঠ, হাঁটার জায়গা, জিম, কফি শপ থাকবে। প্রকল্পের সার্বিক সহযোগিতায় ছিল সাহাত্য-আর্কিটেকচার ফর গ্রিন লাইফ এবং জে পিঁ জেড কনসাল্টিং কনসোর্টিয়াম। ১৯টি উদ্যান আর ১২টি খেলার মাঠ নিয়ে করা এই প্রকল্প ২০২১ সালের মধ্যে শেষ হওয়ার কথা ছিল। ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন ‘ভিত্তি স্থপতিবৃন্দ’ আর বুয়েটের সহযোগিতায় ২৬টি মাঠ আর উদ্যানে একই ধরনের প্রকল্প চালু করেছে, যার অনেকগুলো বাস্তবায়িত হয়ে গেছে।

ঢাকা দক্ষিণের বর্তমান মেয়র ব্যারিস্টার ফজলে নূর তাপস বলেন, ‘ঢাকা মেয়র কাপ আন্তঃওয়ার্ড ক্রীড়া প্রতিযোগিতা-২০২১ টুর্নামেন্টটি করতে গিয়ে আমি দেখেছি ,এখানে মাঠের অপ্রতুলতা। দিনে দিনে সব মাঠ দখল হয়ে গেছে। কেউ এগুলোকে মুক্ত করার চেষ্টা করেনি। আমি কথা দিচ্ছি, এক দিনে হয়তো পারব না। তবে, দখল হওয়া সব মাঠ আমি ফিরিয়ে আনব। (সময় নিউজ, ৪ ফেব্রুয়ারি ২০২১)।’ স্থানীয় সরকারমন্ত্রী মো. তাজুল ইসলাম সদ্য শেষ হওয়া এবারের টুর্নামেন্টটিতে বলেছেন, রাজধানীর সব এলাকায় খেলার জন্য যত মাঠ প্রয়োজন, তা পূরণে ঢাকা দুই সিটি করপোরেশনের মেয়র চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। দুই মেয়র যেখানেই সুযোগ পাচ্ছেন, ছোট পরিসরে হলেও ছেলেমেয়েদের জন্য নতুন খেলার মাঠ প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নিয়েছেন। (ঢাকা টাইমস, ৫ মার্চ ২০২২)। এ ছাড়া ঢাকা সবুজকরণের জন্য ভবনের ছাদে বাগান করা হলে ১০ শতাংশ হারে হোল্ডিং ট্যাক্স রেয়াত দেওয়া হবে এবং যেসব বাড়ি বা স্থাপনায় বৃষ্টির পানি (সংরক্ষণ) করা হবে, তাদেরও গৃহকরের একটা অংশ রেয়াত দেওয়ার চিন্তা করছেন বলে জানিয়েছেন ঢাকা উত্তরের মেয়র মো. আতিকুল। (কালের কণ্ঠ ২৫ আগস্ট, ২০২০)

আরও পড়ুন

ডিটেইলড এরিয়া প্ল্যান-ড্যাপ (২০৩৫) প্রস্তাবনা

ড্যাপের ভূমি ব্যবহার প্রস্তাবনায় ১৫২৮ বর্গকিলোমিটার এলাকার (ঢাকা, গাজীপুর এবং নারায়ণগঞ্জের) মধ্যে ৬০ শতাংশ এলাকাকে নগর ধরা হয়েছে। এর মধ্যে কৃষি এলাকা ২৯ দশমিক ২২ শতাংশ, জলাশয় ৭ দশমিক ৯৫ শতাংশ, বনাঞ্চল ১ দশমিক ৪১ শতাংশ, উন্মুক্ত স্থান ১ দশমিক ৩৮ শতাংশ রাখা হয়েছে। পরিবেশবান্ধব শহর তৈরির লক্ষ্যে পরিকল্পনায় পাঁচটি বড় আঞ্চলিক উদ্যান, ৪৯টি জলকেন্দ্রিক উদ্যান, আটটি বৃহৎ ইকোপার্ক (ভাওয়াল বনসহ), ৯টি অন্যান্য উদ্যান এবং খেলার মাঠ নির্মাণের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে।

প্রতি বর্গকিলোমিটারে প্রায় দেড় লাখ মানুষের বাস করা শহরে ড্যাপ পরিকল্পনা করেছে—কেন্দ্রীয় এলাকার (উত্তর ও দক্ষিণ সিটি) জন্য প্রতি একরে ২০০ জন, পুরান ঢাকায় প্রতি একরে ২৫০ জন; গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ, সাভার, পূর্বাচল, ঝিলমিল নগর এলাকার জন্য প্রতি একরে ১৮০ জন, অন্যান্য নগর এলাকার জন্য প্রতি একরে ১৫০ জন (কৃষি এলাকা ছাড়া); আবাসন চাহিদা পূরণে প্লটভিত্তিক উন্নয়নের পরিবর্তে ব্লকভিত্তিক উন্নয়ন পদ্ধতির (৩ কাঠা ও ৫ কাঠায় কোনো ভবন তৈরি না করে ছোট ছোট ব্লক আকারে ভবন নির্মাণ, যেন সেই ব্লকের অভ্যন্তরে একটি বড় খেলার মাঠ তৈরি হয়) সুপারিশ করা হয়েছে।

ড্যাপের প্রস্তাবের বাস্তবায়ন এখনই বাধার মুখে পড়েছে। ব্যবসায়ীদের তোপের সঙ্গে সঙ্গে এই প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য যে বিকেন্দ্রীকরণের প্রয়োজন, তার কোনো ধারণা নেই। এত খরচ করে ব্লক সিস্টেমে বাড়ি কে কে করবে সেটার ধারণাও নেই। তাই আগেকার ড্যাপের (২০১৫) মতো এটারও মুখ থুবড়ে পড়ার সমূহ সম্ভাবনা আছে। আমাদের এই ঢাকা শহরে মেয়রদ্বয়ের চেষ্টা তাই বড়ই অপ্রতুল! সবুজ ও মানবিক ঢাকার জন্য শুধু মেয়রদ্বয়ের নয়, রাষ্ট্রীয় ও সরকারিভাবে সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে সহযোগিতা ও আন্তরিক প্রচেষ্টার প্রয়োজন।

সুবাইল বিন আলম প্রকৌশলী, একটি বিদেশি কোম্পানির কান্ট্রি ডিরেক্টর, বিজনেস ডেভেলপমেন্ট কনসালট্যান্ট এবং সাবেক রিসার্চ ফেলো।
ই-মেইল: [email protected]