মেঘনায় কালবোশেখি: কালো পানকৌড়ি ও বাজপড়া চাষি

আজ কিছু একটা হবে! বিশাল মেঘনা ফুলে ফুলে উঠছে বাতাসে। আকাশ জামরঙা, নদীর পানি কালো, ঢেউয়ের ফণা জোছনার মতো সাদা। নৌকা মাতালের মতো একবার এপাশে আরেকবার ওপাশে হেলছে। কী করি এখন? সাধের মেঘনায় বেড়াবার সাধ মেটাব, নাকি মুখ চুন করে ফিরে যাব ঘাটে? আকাশে যে জায়গাটিতে সূর্য ছিল, সেখানে সাদা আভা, বাকি আকাশ জামকালোরঙা। ঢেইয়ের ঝাপটা লাগছে গায়। ছইয়ের গায়ে হেলান দিয়ে বাতাসবাহিনীর চাপ সামলাচ্ছি। ভয়ের চেয়ে রোমাঞ্চ বেশি হলে ভয়কে পাত্তা দিতে ইচ্ছা করে না। রোমাঞ্চের চাইতে যখন সুন্দরের লীলা বড় হয়, তখন আবেশে স্তব্ধ হয়ে যেতে হয়। আমাদের সেটাই হচ্ছিল। হুঁশ ফিরল সঙ্গের বন্ধুর। উনি বললেন, ঝড় আসছে রে ভাই, তাড়াতাড়ি তীরে চলেন। গাঁইগুঁই করে রাজি হলাম। ডানেই সবুজ-হলুদ বাইদ্যার চর। নৌকা ঠেকল সেখানেই।
পেছনে তাকিয়ে দেখি, প্রায় আধা মাইল দূরে নদীর অন্য পাড়ে অলৌকিক দৃশ্যের জন্ম হয়েছে। বিরাট এলাকাজুড়ে হলুদ ধোঁয়া উঠে যাচ্ছে আকাশে। যেন আকাশ চুষে নিচ্ছে সেই ধোঁয়া। কালো আকাশ আর নদী যেখানে মিলেছে, সেখানে মাইলখানেক লম্বা ফিতার মতো গ্রাম। ঝড় সেখানে এসে পৌঁছেছে। তীরের হলুদ ধুলা আর বালু এমনভাবে উড়ছে যেন লেগেছে দাবানল। হায় হায় ঝড় এসে পড়েছে!

আগেই বোঝা উচিত ছিল আমাদের। রূপগঞ্জের রাস্তায় যখন শীতল হাওয়া এসে গায়ে লাগল, বোঝা দরকার ছিল তখনই। কিংবা আড়াইহাজার উপজেলার বিষনন্দী ঘাটে যখন সহসা কমলা ধুলা হঠাৎ জেগে উঠল, আর ফেরির জন্য অপেক্ষারত মানুষেরা ছুটে পালাচ্ছিল, তখনো হুঁশ হতে পারত। বাঞ্ছারামপুর ঘাটের বাঁ তীরে কচুরিবহরে খুঁটি পুঁতে রাখা সারি সারি বাঁশের ডগায় পানকৌড়িগুলোর গম্ভীর বসে থাকা দেখেও বুঝতে পারা দরকার ছিল যে নদীতে আজ কিছু একটা ঘটবে!
কিন্তু বুঝিনি। প্রকৃতির গন্ধ শোঁকার নাক, ইশারা বোঝার চোখ কবেই না আমরা হারিয়ে ফেলেছি। তাছাড়া ঢাকার গারদ থেকে এত দূর উজিয়ে এসেছি নদীসঙ্গ করব বলে, কে ফেরায় মোরে? তাই ফিরি নাই। ভাবলাম, বৃষ্টি হলে তো দারুণই হয়। একটু নাহয় ভিজব। কিন্তু মাসটা যে চৈত্র গড়িয়ে বৈশাখের দিকে ঝুঁকছে, বাংলা সন–তারিখের সেই হিসাব না জানার খেসারত কি দিতে হবে না? প্রকৃতি কি তার সন্তানদের এহেন বেয়াদবি মাফ করতে পারে?
মাফ করেনি। বিষনন্দী থেকে নৌকা ঠিক করা হলো। বন্ধু বলি বড় ভাই বলি সঙ্গী একজনাই। বেলা তখন পাঁচটা। সন্ধ্যার আগেই ভাটির দিক থেকে ঘুরে আসতে চাই আমরা। মেঘনা সেদিকে আরও চওড়া, পানি সেখানে আরও সবুজ ও স্বচ্ছ। কিন্তু আজ পানি কেমন যেন লোহার মতো রং ধরেছে। নৌকাটাকে দোলাচ্ছেও খুব। ইঞ্জিন নৌকা ভটভটিয়ে বেশ কিছুদূর এসেছে। দোলানো আর সহ্য হচ্ছিল না। বড় ভাইটি বাদ সাধলেন। মাঝি ছেলেটিরও মনে পড়ল ইঞ্জিনে তেল ভরা নাই!
ডানে একটা ছোট চর। সব রঙের ঘাসে ভরা: হলুদ, কমলা, টিয়াসবুজ আর খয়েরি। সামান্য আলোয় চরটা আভা দিচ্ছে। চরটার চারপাশেই মেঘনা, একপাশে বিশাল অন্যপাশে কিছু কম। চরে নেমে মাঝিকে পাঠালাম ঘাটে ফিরে তেল ভরে আনতে। যেতে আসতে আধা ঘণ্টা লাগবার কথা। সে তো গেল রে গেল, আরা আমি তো ছবি তুলছি আর তুলছি। অন্য পারের ধুলাঝড় দেখছিলাম। এপারে পানি ঘুলিয়ে উঠছে, পাক খাচ্ছে। তুমুল বাতাস শুরু হলো, পাড়ের লম্বা ঘাসের বন নিমেষে তছনছ। দুই বন্ধু বাতাস ঠেলে যেদিকে নদীর দৈর্ঘ্য কম, সেদিকে চলে এসেছি। হায়, নৌকার দেখা নাই। মোবাইলে ফোন করি, কথাও বলি, কিন্তু বাতাসে মাঝির কথা আমি বুঝি না, আমার কথাও সে বোঝে না। ওদিকে বড় বড় ঢেউয়ের ফেনায় নদী তার ভয়াল সুন্দর দাঁত দেখিয়ে ফেলেছে।

ভাবলাম, যা হয় হবে। ঝড়বৃষ্টি সয়ে নেওয়া যাবে মাটিতে শুয়ে। কিন্তু বাজ পড়া থেকে বাঁচব কীভাবে? কী বোকা, শিলাবৃষ্টির কথা তখনো মাথায় আসেনি। কালবৈশাখী যে এটা, তাও ভাবিনি। যখন কিছুই করার নাই, তখন মোকাবিলা করাই ভালো। এই নীতিতে বৃষ্টির ছাট আর বাতাস খাচ্ছি, মেঘনার ঢেউয়ে সমুদ্রের ঢেউ গুনছি। এর মধ্যে আবছা নদীতে দেখা গেল নৌকা আসছে। আহ্, মাঝি ছেলেটি আমাদের ভোলেনি।
নৌকা ফিরে আসতে না আসতেই শুরু হলো শিলাবৃষ্টি। মুখ ঘুরিয়ে ছবি তুলতে যাব ফোনে, ঠিক কানের ওপরে একটা মাঝারি শিলা এসে টং করে লাগল। বড় ভাইটি ততক্ষণে লাফিয়ে ছইয়ের তলায়। আমাকে আর কিচ্ছু বলতে হলো না। আকাশের গায়েবি বরফমার খেয়ে সুবোধ বালক হয়ে গেলাম, ছইয়ে ঢুকে অ্যাডভেঞ্চারিস্ট মোড থেকে কবিভাব ধারণ করলাম।
চর ঘেঁষে নোঙর করা নৌকাটা। ছইয়ের ওপর, গলুইয়ে মুহুর্মুহু শিল পড়ছে। ছইয়ের ফাঁক দিয়ে দেখছি: যতদূর চোখ যায় রাশি রাশি বরফখণ্ড নদীজুড়ে খই ফোটাচ্ছে। না না, ভাতের বলকের মতো ফুটছে এ নদী। নদীপৃষ্ঠ ঢাকতে ঢাকতে ধেয়ে আসছে কুয়াশার চাদর। আকাশে গুড়গুড় বাজ ও ঐশী আলোর চমকানি। মেঘনার সবুজ পানি এখন ধূসর-সাদা-সবুজ মিলিয়ে অপার্থিব রং ধরেছে। মনে হলো, এ কোন সর্বনাশী সুন্দর! কিন্তু এর মধ্যে ওটা কী? প্রায় ৫০ গজ সামনে একদম পানি ছুঁয়ে তড়পাচ্ছে? বৃষ্টিতে আবছা, কী ওটা?
একটা কালো পাখি। সমানে ডানা ঝাপটাচ্ছে, কিন্তু এক ইঞ্চিও এগোতে পারছে না। ফেরিঘাটের পরে যেসব পানকৌড়িকে বাঁশের ডগায় চুপ করে বসে থাকতে দেখি, এটা সম্ভবত সেই দলের কেউ। পাগলিনী বাতাস, বড় বড় বাতাসার মতো শিলাপাত। সেগুলোর একটা ঠিকমতো গায়ে লাগলেই যথেষ্ঠ। ডানা অথবা মাথা ভেঙে পাখিটার ভবলীলা পার হওয়া ঠেকাবে কে? পানকৌড়িটা করছেটা কী বোঝা যাচ্ছে না। টগবগিয়ে ফোটা নদীর বুক ঘেঁষে একই জায়গায় উড়ছে। উড়ছে না, ডানা ঝাপটে ভাসছে। পানি ঘেঁষে এমনভাবে ভাসার ব্যাখ্যা কী?
পরে বুঝলাম, প্রকৃতি তাকে এভাবে বাঁচার কৌশল শিখিয়েছে। তুমুল শিলাবৃষ্টি শুরুর আগেই দলের সবই চলে গেছে; আর এখন সে ডানা ঝাপটে ডানা ঝাপটে বাঁচার লড়াই লড়ছে। যেদিকেই যাক কমপক্ষে এক মাইল আকাশ উড়তে হবে পাখিটাকে। ততদূর যেতে যেতে কত শিল–বরফ যে তার গায়ে পড়বে! সহজাত প্রবৃত্তি তাকে শিখিয়েছে, এমন বিপদে স্থির থাকতে হবে। পানিঘেঁষে এক জায়গায় ওড়ার বুদ্ধিটা ভালোই, স্থির থাকলে বরফের আঘাতের সম্ভাবনা উড়তে থাকার থেকে অনেক কম।
একসময় শিল পড়া থেমে গেল, বৃষ্টি আর ঝড়ের দাপটও কমে গেল। ঘন কালো আকাশে বিজলীর রেখা কোন হতভাগার ভাগ্যলিখনের মতো কাঁপছে আজ? সন্ধ্যা নেমে আসছে মন্দ্রমন্থরে। ঘাটে ফিরতে পাড়ি দিতে হবে চওড়া নদী। অতএব আবারও ঢেউয়ের নাগরদোলা, আবারও প্রাণ হাতে করে ভাসা। আমরা ফিরলাম, বৃষ্টিভেজা, শ্রান্ত কিন্তু পুলকিত।

পরদিন মাঝি সোহেল খবর পাঠাল, নদী পেরতে গিয়ে একটা মানুষ নৌকা থেকে পড়ে ডুবে গেছে—এখনো ভাসেনি তার লাশ।
শুক্রবার। ফিরবার সময় হঠাৎ মনে পড়ল, পানকৌড়িটার কী হলো? ও কি বাঁচতে পেরেছিল? নাকি বরফের শেল এসে তার বুক, পিঠ, মাথা কিংবা ডানা ভেঙে দিয়েছিল? পাখিরা মায়ার জীব। মেঘনার কালো পানকৌড়ির মায়া আরও বেশি। কবি আল মাহমুদের গল্প ‘পানকৌড়ির রক্ত’ মনে পড়ল। মায়ার সেই পাখিটা কি নদীর তলায়, নাকি মেঘনার আকাশে কালো টিপ হয়ে ভাসছে? একটা প্রাণের জন্য আরেকটা প্রাণ কি কাঁদবে না? আমরাও তো প্রাণী, আমরা বাঙালিরাও তো এককালে নদীবাসী ছিলাম।
আর পানকৌড়িটা তো মেঘনারই মেয়ে। মনে পড়ে না হুমায়ুন কবীরের সেই কবিতাটা,
‘শোন্ মা আমিনা, রেখে দে রে কাজ ত্বরা করি মাঠে চল,
এল মেঘনায় জোয়ারের বেলা এখনি নামিবে ঢল।
নদীর কিনার ঘন ঘাসে ভরা
মাঠ থেকে গরু নিয়ে আয় ত্বরা
করিস না দেরি- আসিয়া পড়িবে সহসা অথই জল’
দিন শেষ হয়, মেয়েটা আর ফিরতে পারে না। তারপর,
‘ভরবেলা গেলো, ভাটা পড়ে আসে, আঁধার জমিছে আসি,
এখনো তবুও এলো না ফিরিয়া আমিনা সর্বনাশী।
দেখ্ দেখ্ দূরে মাঝ-দরিয়ায়,
কাল চুল যেন ঐ দেখা যায়-
কাহার শাড়ির আঁচল-আভাস সহসা উঠিছে ভাসি?
আমিনারে মোর নিল কি টানিয়া মেঘনা সর্বনাশী।’
পানকৌড়িটাকে কেন আমার আমিনার মতো কৃষককন্যা মনে হয়, যে চর থেকে গরু আনতে গিয়ে ভেসে গিয়েছিল মেঘনার ঢলে? কেন মনে হয়, ওই পানকৌড়িটা যখন বাঁচার চেষ্টা করছিল, ঠিক তখন, ঠিক তখন বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রান্তে, গ্রাম এলাকায়, শিল পড়ে আর বাজে পুড়ে সাতজনেরও বেশি মানুষ মারা গেছেন। এক কৃষকের বাজ পড়ে পুড়ে কালো হয়ে যাওয়া ছবি ফেসবুকে দেখছি। পানকৌড়িটার মতোই কালো হয়ে গেছেন। ধানখেতের কাদায় পড়ে আছেন।
মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘পুতুলনাচের ইতিকথা’ উপন্যাসের প্রথম লাইনটা মনে পড়ল। কোনো দিন ভুলব না সেই দৃশ্য: ‘হারু ঘোষ গাছের তলায় দাঁড়িয়ে ছিল। এই সময় আকাশের দেবতা তাহার দিকে চাহিয়া কটাক্ষ করিলেন।’ আকাশের কটাক্ষ মানে বজ্রপাত। হারু ঘোষ বাজে পুড়ে সেই গাছের তলাতেই মরে ঠায় দাঁড়িয়ে ছিল। আর আমাদের এই কৃষক ধানখেতে সবুজ ধানের গোছা বুকে জড়িয়ে শুয়ে ছিলেন কাদাপানিতে। কী আশ্চর্য এক দৃশ্য। আকাশের কটাক্ষে মরে গিয়েও প্রাণের ধান ছাড়েননি! যে ধানের ন্যায্য দাম না দিয়ে প্রতি লোকমা ভাতে আমরা বেইমানি করি, সেই ধান!
তিরতির করে কাঁপা ওই পানকৌড়িটাকে আমার ওই কৃষকের মতো মনে হয়। বাংলার গাঁ–গেরামের আমিনা খাতুনদের মতো মনে হয়। শোক হয়, শোক হয়, শোক হয়। মানুষের এই করুণ অসহায়ত্বে রাগ হয়, রাগ হয়, রাগ হয়!
ফারুক ওয়াসিফ: লেখক ও সাংবাদিক।
[email protected]