মোদি শাসনের সাফল্যের ঢক্কানিনাদে অস্বস্তির কাঁটা

নরেন্দ্র মোদি

প্রচারের জন্য একটা উপলক্ষ প্রয়োজন, বিজেপির চেয়ে ভালো তা আর কেউ জানে না। জানলেও প্রচারের ঢক্কানিনাদে বাধা হয় রেস্ত। সাধ্যে কুলোয় না। উপলক্ষ ও সাধ্য—দুই ক্ষেত্রেই নরেন্দ্র মোদি সব দলকে বলে বলে গোল দিচ্ছেন। সর্বশেষ প্রমাণ ১৭ সেপ্টেম্বর, ৭১ বছর আগে যেদিনে মোদি জন্মেছিলেন।

বাহাত্তরে পা দেওয়ার দিনটিতে তাঁকে ঘিরে প্রচারের তীব্রতায় অতীতের সব নজির ম্লান হয়েছে। সরকার, দল, রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা, মিডিয়া ও শুভাকাঙ্ক্ষীরা ব্যক্তিপূজার ফানুস যেভাবে উড়িয়েছেন, তাতে মনে হতে পারে ইহকুলে মানুষের আর কোনো সমস্যা তো নেই-ই, চাহিদাও নেই! সরকারি সাফল্যের সাতকাহনে মনে হয়, অযোধ্যায় রামমন্দিরের উদ্বোধনের আগেই দেশে রামরাজ্য প্রতিষ্ঠিত! শরীরের বয়স একাত্তর যেমন, প্রশাসক হিসেবে মোদির দেশসেবারও তেমন দুই দশক (গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রিত্ব ধরে) পূর্ণ হলো। উপলক্ষ এটাই। জন্মদিনে তাঁকে ছাপিয়ে তাঁর ‘কীর্তি’ তুলে ধরার এমন অভিনবত্ব আগে কোনো প্রধানমন্ত্রী দেখাননি। অনেক কিছুর মতো এ ক্ষেত্রেও নরেন্দ্র মোদি পথিকৃৎ।

এই উদ্‌যাপন আরও নজরকাড়া। কারণ, দেশসেবার দুই দশকের প্রচারযজ্ঞ চলবে টানা ২১ দিন। আগামী ৭ অক্টোবর পর্যন্ত। প্রচারের লক্ষ৵ও তাঁরই স্থির করা। প্রথম ও প্রধান লক্ষ্য জন্মদিনে দেড় কোটি মানুষকে কোভিডের টিকাদান। সরকারি দাবি, টিকা দেওয়া হয়েছে আড়াই কোটি ভারতীয়কে।

রাজনৈতিক উদ্‌যাপনে একটু–আধটু খিঁচ থাকে। বিরোধীরা তা নিয়ে তোলপাড় করে। ১৭ সেপ্টেম্বরেও সেই খিঁচ যে মাথা তোলেনি, তা নয়। এক বছর আগে এই দিনে বিতর্কিত তিন কৃষি আইন প্রণীত হয়েছিল। বিজেপির একদা সহযোগী অকালি দল এবং দিল্লির শাসক আম আদমি পার্টি সেই বর্ষপূর্তি উদ্‌যাপন করল বিক্ষোভ সমাবেশের আয়োজনের মধ্য দিয়ে। ব্যাহত হলো রাজধানীর জনজীবন। কিন্তু তাতে প্রচারের ঔজ্জ্বল্য কমেনি। প্রচার তেমনই তীব্র ও জমজমাট, দেড় শ বছর আগে সহমরণযাত্রার সময় সতীর আর্তনাদ যেভাবে দিগ্‌বিদিক আলোড়িত করা জয়ধ্বনিতে চাপা দেওয়া হতো!

এ কথা অনস্বীকার্য, বিজেপিতে এমন শক্তি সঞ্চার আগে কেউ করেননি। সেদিক থেকেও মোদি তুলনাহীন। তবু ভালোবাসা ও শ্রদ্ধার যে আসন অটল বিহারি বাজপেয়ির জন্য দেশ পেতেছিল, মোদি তার ধারেকাছেও পৌঁছাতে পারেননি। সবাইকে নিয়ে চলার অদ্ভুত এক ক্ষমতা বাজপেয়ির ছিল। কট্টর বিরোধীরাও তাই তাঁকে শ্রদ্ধা ও সম্মান করত। বিরোধীদের সঙ্গে তাঁর বাক্যালাপ বন্ধ, এমন দৃশ্য কস্মিনকালেও কেউ দেখেনি। দল–মতনির্বিশেষে শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা পেয়ে আসা বাজপেয়ির কথা মানুষ কৃতজ্ঞচিত্তে স্মরণ করে আজও। মোদি সেই আসন আদায় করতে পারেননি। কংগ্রেস সভানেত্রী সোনিয়া গান্ধীর সঙ্গে তাঁর কুশলবিনিময় পর্যন্ত হয় না! নিজের চারধারে তিনি গড়ে তুলেছেন এক অদৃশ্য বলয়। অথচ দলগত সাফল্যের খতিয়ানে মোদির ধারেকাছে কেউ নেই। তাঁর দুই দশকের প্রশাসনিক খতিয়ান আজ তাই স্বাভাবিকভাবেই আতশি কাচের তলায় চলে আসছে। সরকারি আনুষ্ঠানিক আড়ম্বরের পাশাপাশি বাস্তবের ছবির তুলনা হয়ে উঠেছে স্বাভাবিক ও অবধারিত।

গুজরাট নরেন্দ্র মোদির খাসতালুক। টানা ২৩ বছর সেখানে মোদি-পতাকা পতপত করে উড়ছে। ‘গুজরাট-মডেল’ তাঁর খ্যাতির সোপান। সেই মডেল, যা নাকি উন্নয়ন ও শ্রীবৃদ্ধির শেষ কথা! অথচ সেই রাজ্যেই ভোটের এক বছর বাকি থাকতে প্রশাসনিক খোলনলচে বদলানো ও বিরোধীদের দল ভাঙানো ছাড়া মান বাঁচানোর আর কোনো হদিস মোদি পাচ্ছেন না! মুখ্যমন্ত্রী বিজয় রুপানির অপসারণই শুধু নয়, ২১ জনের মন্ত্রিসভায় পুরোনো কোনো মুখের স্থানই নেই। চার বছর ধরে চলা মন্ত্রিসভার প্রতি এমন অনাস্থা আর কোনো নেতা কখনো দেখাননি।

করোনার ক্ষত মেরামতে সময় লাগবে। এই কঠিন পরিস্থিতিতে মোদির একমাত্র সহায়ক দলীয় সংহতি ও ছত্রখান বিরোধীকুল। দাপট তাঁর এতটাই যে দলীয় অসন্তোষের ধোঁয়া পর্যন্ত দৃশ্যমান নয়। বিরোধীবশের নীতিমালা ও তার প্রয়োগও অবিশ্বাস্য মসৃণ! গণতন্ত্র বিরোধীশূন্য করা যদি ‘আর্ট অব রুলিং’ হয়, বলতেই হবে মোদির স্থান তা হলে সবার ওপরে।

মোদি-রাজত্বের সবচেয়ে বড় সংকট অবশ্যই করোনা। বিপদ কতটা ভয়ংকর, অনেক দিন পর্যন্ত তা তিনি মানতে চাননি। ‘নমস্তে ট্রাম্প’ ও দিল্লি দাঙ্গার পর যখন তাঁর চৈতন্য হলো, তত দিনে অনেকটাই দেরি হয়ে গিয়েছিল। শেষমেশ তড়িঘড়ি একুশ দিনের বিধিনিষেধ। সেখানেও বাস্তবতা অনুধাবনে ব্যর্থতা ও অবিমৃশ্যকারিতার নিদর্শনে সয়লাব। বিবিধ সামাজিক ও অর্থনৈতিক অভিঘাতে সরকারও স্থবির। করোনার দ্বিতীয় ঢেউ আরও মারাত্মক। পরিত্রাণের খোঁজ আজও যে পূর্ণভাবে মেলেনি, অর্থনীতির পরিসংখ্যান তার প্রমাণ। করোনার ক্ষত মেরামতে সময় লাগবে। এই কঠিন পরিস্থিতিতে মোদির একমাত্র সহায়ক দলীয় সংহতি ও ছত্রখান বিরোধীকুল। দাপট তাঁর এতটাই যে দলীয় অসন্তোষের ধোঁয়া পর্যন্ত দৃশ্যমান নয়। বিরোধীবশের নীতিমালা ও তার প্রয়োগও অবিশ্বাস্য মসৃণ! গণতন্ত্র বিরোধীশূন্য করা যদি ‘আর্ট অব রুলিং’ হয়, বলতেই হবে মোদির স্থান তা হলে সবার ওপরে।

কৃষক বিক্ষোভ যদি ফল্গুধারা হয়, করোনা তাহলে স্বাস্থ্য পরিষেবার সামনে ধরা আয়না। ১৩০ কোটির দেশে জাতীয় আয়ের মাত্র দেড় শতাংশ যেখানে স্বাস্থ্যে বরাদ্দ, অতিমারির প্রলয়নৃত্যে সেখানে আশ্চর্যের কিছু নেই। সচকিত মোদি স্বাস্থ্য বরাদ্দ বাড়িয়ে আড়াই শতাংশ করেছেন। সেই বৃদ্ধি সিন্ধুতে বিন্দুসম হলেও তাঁর ‘আয়ুষ্মান প্রকল্প’ যথেষ্ট সাড়া ফেলেছে। নিম্ন আয়ের মানুষের জন্য পাঁচ লাখ টাকার এই স্বাস্থ্যবিমা মোদি শাসনের পাগড়ির এক ঝলমলে পালক। এমনই আরেকটা পালক দরিদ্রদের বিনা মূল্যে রেশন ও কৃষকদের বার্ষিক ছয় হাজার টাকা অনুদান। বাজারের চাহিদা তৈরিতে এই সাহায্য মরুভূমিতে বর্ষণতুল্য। প্রবৃদ্ধির হারই তা দেখাচ্ছে। কিন্তু সাফল্যের প্রচারে এসবই মহিরুহের মতো, ভোটে যা অপরিহার্য।

অর্থনীতির কালিমা বাদ দিলে বাকি থাকে মোদির সামাজিক ও পররাষ্ট্রনীতি। দুই ক্ষেত্রে তিনি সফল না ব্যর্থ, সেই নমুনাও চোখের সামনে। ধর্মীয় মেরুকরণের রাজনীতি থেকে বিজেপি পিছু তো হটেইনি, বরং দিন দিন তা প্রকটতর হচ্ছে। ‘কবরস্থান ও শ্মশান’জাতীয় মন্তব্যের পর এখন উত্তর প্রদেশে চলছে ‘আব্বাজান’ প্রচার। দুর্ভাগ্য, উন্নয়ন ও বিকাশের পতাকা ওড়ানোর কথা বারবার শুনিয়েও মোদির বিজেপি বিভাজনের রাজনীতি থেকে সরতে পারল না! পান থেকে চুন খসলেই তাই দেশদ্রোহের মামলা। গো–রক্ষা আন্দোলন ঘিরে অনর্থক নিষেধাজ্ঞা, নিয়মনীতি ও গণপিটুনি।

আশঙ্কা, দেশজোড়া বিভাজনের এই রাজনীতিতে গতি আনবে আফগানিস্তানে পররাষ্ট্রনীতির ব্যর্থতা। যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি অতিনির্ভরতা আফগানিস্তানে মোদির ভারতের পায়ের তলার জমি ধসিয়ে দিয়েছে। তালেবানের রাজত্বে চীন-পাকিস্তানের প্রভাব যত বাড়বে, ততই নিরাপত্তাজনিত আশঙ্কায় ভুগবে ভারত। দুই বছর আগে ৩৭০ অনুচ্ছেদ খারিজ সত্ত্বেও কাশ্মীর এখনো অশান্ত। উপত্যকায় পাকিস্তানের উসকানি বাড়লে (যে আশঙ্কা প্রবল) বাকি ভারত আলোড়িত হতে বাধ্য। বিভাজনের রাজনীতির স্বার্থে সেটা হবে সোনায় সোহাগা।

দুই দশকের ‘দেশসেবা’ ও সাফল্যের সাতকাহন গুণকীর্তন সত্ত্বেও মোদির ভারতের আগামী দিন যে সুখ ও স্বস্তির, জোর দিয়ে তা বলা যাচ্ছে না।

সৌম্য বন্দ্যোপাধ্যায়, প্রথম আলোর নয়াদিল্লি প্রতিনিধি