মোরাল নিয়ে মোড়লিপনা

বছর কয়েক আগে বাংলাদেশের একজন জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক ধানমন্ডি লেকের পাশ দিয়ে হেঁটে বাড়ি ফিরছিলেন। হঠাৎ দায়িত্বরত একজন আনসার সদস্যের মনে হলো হেঁটে যাওয়া মানুষটির মাথায় কাপড় থাকা উচিত। তিনি হেঁকে বললেন মাথায় কাপড় দেন। এটাই মোরাল নিয়ে মোড়লিপনা। অন্য কেউ হলে হয়তো ভেজালে যেতেন না। সাংবাদিক প্রতিবাদ করেছিলেন। লেখালেখি হয়েছিল বিস্তর কাগজে আর ফেসবুকে। তাই আমরা জানতে পেরেছি। না হলে কেউ জানতেই পারত না।

এটা যে শুধু আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী করে তা নয়, যেকোনো শক্তি এটা করতে পারে। করে থাকে। বিকেলে হাওয়া খেতে বেরিয়ে অবসরে থাকা হাউজিং সোসাইটির ‘আঙ্কেল’রা এ রকম করতে পারেন। পথে দেখা হওয়া কিশোরদের সালাম একরামের সহবত শেখানোর চেষ্টা করেন অনেকে। পড়া ধরেন লজ্জা দেওয়ার জন্য। এসব আচরণ একরকমের মোরাল পুলিশিং বা নৈতিকতার মোড়লিপনা। মোরাল বা নৈতিক পুলিশিং অথবা মোড়লিপনা হলো এমন ধরনের আচরণ, যখন কেউ তাদের নিজেদের মনঃপূত মান এবং নীতি ও নৈতিকতার ধারণাগুলো অন্য লোকেদের ওপর চাপিয়ে দেয় এবং তাদের নাগরিক স্বাধীনতা উপভোগের পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায়।

দিনের বেলায় প্রকাশ্য পার্কে যদি তরুণ–তরুণীরা যেতে না পারেন তাহলে তাঁরা কোথায় যাবেন। মোবাইল, ফেসবুক আর নেশা নিয়ে ঘরকুনো এক জাতির স্বপ্ন কি আমরা দেখছি? তরুণ–তরুণীদের প্রকাশ্য চলাফেরা, বিনোদন, সংস্কৃতিচর্চার জায়গা দিতে হবে। তাঁদের বন্ধ করে চুল ছেঁটে ঘরে আটকে রেখে সুস্থ জাতি গঠন কি সম্ভব

আজকে যেটা নৈতিকতার মান হিসেবে ভাবা হচ্ছে, কালকে সেটা নিতান্তই হাস্যকর বলে মনে হতে পারে। ষাটের দশকে যে কলেজে আমার বোন পড়তেন, সেই কলেজে মেয়েদের নিজ উদ্যোগে কমনরুম থেকে হেঁটে ক্লাসে যাওয়াটা ছিল বেমানান। অগ্রহণযোগ্য আচরণ। ছাত্রীদের সুরক্ষার জন্য শিক্ষকদের কমনরুম পেরিয়ে তবে ছাত্রীদের কমনরুমে যেতে হতো। শিক্ষকেরা ক্লাসে যাওয়ার সময় ছাত্রীদের কমনরুমের পিয়নের মাধ্যমে খবর পাঠাতেন। তাঁরা যেন খুব দ্রুত শিক্ষককে অনুসরণ করেন, তিনি ক্লাসে যাওয়ার জন্য তৈরি। স্বাধীনতার পর সত্তর দশকে সেই নিয়ম আর থাকেনি। প্রয়োজনে শিক্ষকদের কমনরুম ডিঙিয়ে সহপাঠী ছাত্রীবন্ধুকে ডাকতে যাওয়া নিয়ে কেউ ভ্রু কুঁচকাইনি। ১৯৫৬ সাল পর্যন্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো ছেলে প্রক্টরের অনুমতি ছাড়া কোনো মেয়ের সঙ্গে কথা বলতে পারত না। ওই ছেলেকে কারণ দর্শিয়ে প্রক্টর বরাবর দরখাস্ত দিতে হতো। প্রক্টর অনুমতি দিলেই সে কথা বলতে পারত, অন্যথায় নয়। এমনকি তার ক্লাসের কোনো মেয়ের সঙ্গেও নয়।

আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েই মোরাল পুলিশিংয়ের শিকার হয়েছিলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বছর ছয়েক পর নজরুল ঢাকায় এসে নতুন এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ঘুরে দেখতে বেরিয়েছিলেন। ঘুরতে ঘুরতে কার্জন হলের সামনে এলে কবির সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম মুসলিম ছাত্রী ফজিলতুন্নেসার সঙ্গে দেখা হয়। সঙ্গীদের বারণ অমান্য করে তিনি যেচে ফজিলতুন্নেসার সঙ্গে কথা বলেন। তাঁর নাম জানতে চান।

ফজিলতুন্নেসা মাথা নিচু করে জবাব দিয়েছিলেন কবির প্রশ্নের। এই সবকিছু দূরে দাঁড়িয়ে এক অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রক্টর দেখেছিলেন। তিন দিন পর, ২৯ ডিসেম্বর ১৯২৭, কাজী নজরুল ইসলামকে সারা জীবনের জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চত্বরে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করা হয়। কলা ভবন আর বিজ্ঞান ভবনের নোটিশ বোর্ডগুলোতে হাতে লেখা সেই বিজ্ঞপ্তি টাঙিয়ে দেওয়া হয়। এখন দেশ–বিদেশের অনেক মানুষ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আসেন শুধু সেই নজরুলের কবরে শ্রদ্ধা জানাতে, ফাতেহা পাঠ করতে।

অভিজ্ঞতা যাঁদের আছে, তাঁরা জানবেন লন্ডনের টিউব বা প্যারিসের মেট্রো অথবা ঘরের কাছে কলকাতার পাতালরেলে কেমন ভিড় হয়। ২০১৮ সালের মে মাসে এমনই এক ভিড়ের সন্ধ্যায় কলকাতার দমদমগামী পাতালরেলের যাত্রী ছিলেন দুই তরুণ–তরুণী। ভিড়ের চাপে তাঁরা একে অপরকে জড়িয়ে ধরে দাঁড়িয়ে ছিলেন কিছুক্ষণ। আর তাতেই তীব্র আপত্তি জানাতে শুরু করেন সহযাত্রীরা। দমদম স্টেশনে পৌঁছাতেই তাঁদের ট্রেন থেকে টেনেহিঁচড়ে নামানো হয় প্ল্যাটফর্মে। এরপর মারধর করতে শুরু করেন যাত্রীরা। গণপ্রহারে যাঁরা অংশ নিয়েছিলেন, তাঁদের মধ্যে বেশির ভাগই মধ্যবয়সী বা প্রৌঢ়। এরপর সারা কলকাতায় প্রতিবাদের ঝড় ওঠে।

আমাদের কক্সবাজার সৈকতে বেড়াতে যাওয়া দম্পতিদের কাছে বিয়ের কাবিননামা দেখতে চাওয়া পুলিশের খবর আমরা জেনেছি। এবার ভ্যালেন্টাইন দিবসে মুম্বাইয়ের জুহু সৈকতে বসে থাকা মানুষদের বিরক্ত করতে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল একদল স্বঘোষিত নৈতিকতা রক্ষক। যেকোনো নারীর সঙ্গে পুরুষকে বসে থাকতে দেখলেই তাদের মাথা চড়ে যাচ্ছিল। এক যুগলকে তারা তাড়া দেয় তখন তখনই বিয়ে করার জন্য। বিবাহিত সেই যুগলকে আবার কেন তাদের সামনে বিয়ে করতে হবে, সেটা নিয়ে গোল বাধে। নৈতিকতা রক্ষকদের সঙ্গে ভাড়া করা পুরোহিত ছিলেন। শেষ পর্যন্ত হয়তো তাঁদের আবার বিয়ে করতে হয়নি কিন্তু হেনস্তার চূড়ান্ত অবস্থায় পড়তে হয়েছিল।

বাংলাদেশেও মাঝেমধ্যে কিশোরদের ‘মোরাল’ ঠিক করার জন্য মোড়ল–মাতবর আর ‘আইনের’ মানুষদের মন হাঁপিয়ে ওঠে। চুলের ছাঁট নিয়ে তাঁদের রিজার্ভেশন বেশি বলে অনেকের ধারণা। তবে অনেক মনোবিজ্ঞানী মনে করেন, প্রকাশ্যে জোর করে চুল কেটে দেওয়ার মধ্যে যে আদিম উদ্দীপনা আছে, সেটাই এই নৈতিকতা রক্ষকদের বেশি উৎসাহিত করে। পার্কে বা বাগানে ঘুরতে যাওয়া কিশোর–কিশোরীদের থানায় ধরে এনে অভিভাবকদের ডেকে নৈতিকতার বাণী শুনিয়েও মাঝেমধ্যে জাতি রক্ষার কাজ করেন অনেকে।

আরও পড়ুন

ফেব্রুয়ারির ১৪ তারিখে এবারও পুলিশ নিয়ে কয়েকজন ম্যাজিস্ট্রেট নাকি পার্কে পার্কে ঘুরেছিলেন ‘বেহায়াপনা’ বন্ধ করতে। বগুড়ার খবর কাগজে এসেছে। শহরের সাতমাথা এলাকার এডওয়ার্ড পার্ক ও খান্দারের ওয়ান্ডারল্যান্ডে ‘অভিযান’ চালান একজন সহকারী কমিশনার ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট। আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন (এপিবিএন) সদস্যদের সঙ্গে নিয়ে সেখানে তরুণ-তরুণী এবং যুগলদের জিজ্ঞাসাবাদ করেন ম্যাজিস্ট্রেট। এমনকি তাঁদের অভিভাবক ডেকে অপদস্থ করেন তিনি। অভিযানে এক তরুণের গায়ে হাত তুলতেও দেখা যায় এক এপিবিএন সদস্যকে। এসব ঘটনার ভিডিও চিত্র তাৎক্ষণিকভাবে ছড়িয়ে পড়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে।

দিনের বেলায় প্রকাশ্য পার্কে যদি তরুণ–তরুণীরা যেতে না পারেন, তাহলে তাঁরা কোথায় যাবেন। মোবাইল, ফেসবুক আর নেশা নিয়ে ঘরকুনো এক জাতির স্বপ্ন কি আমরা দেখছি? তরুণ–তরুণীদের প্রকাশ্য চলাফেরা, বিনোদন, সংস্কৃতিচর্চার জায়গা দিতে হবে। তাঁদের বন্ধ করে চুল ছেঁটে ঘরে আটকে রেখে সুস্থ জাতি গঠন কি সম্ভব?

গওহার নঈম ওয়ারা লেখক ও গবেষক

[email protected]