মোহাম্মদ আলী ও ভিন্নমত

মোহাম্মদ আলী
মোহাম্মদ আলী

তারিখটা এখনো সবার স্পষ্ট মনে থাকার কথা। ২৮ এপ্রিল ১৯৬৭, হিউস্টনের সেনাভর্তি দপ্তরে, মোহাম্মদ আলী সেদিন ইতিহাস সৃষ্টি করলেন। তখন ভিয়েতনামে যুদ্ধ চলছে, বৃষ্টির মতো বিমান থেকে ঝরছে নাপাম বোমা, পাখির মতো মরছে মানুষ। এটা এমন একসময়ের কথা, যখন মার্কিন সেনাবাহিনীতে অংশগ্রহণ বাধ্যতামূলক ছিল। ১৯৪৮ সালে গৃহীত আইন অনুসারে, স্বাস্থ্যগত বা বিশেষ কারণে বাদ না পড়লে, ১৮ থেকে ২৬ বছরে প্রত্যেক মার্কিন নাগরিক—সাদা, কালো বা পীত বর্ণের—কমপক্ষে ২১ মাস সেনাবাহিনীতে অংশগ্রহণ করতে বাধ্য। সেই নির্দেশ অমান্য করলে জেল ও জরিমানার বিধান ছিল।
সরকারি চিঠিতে পাওয়া নির্দেশ অনুযায়ী সেদিন হিউস্টনে মোহাম্মদ আলী যথাসময়ে সেনা দপ্তরে হাজির হয়েছিলেন। যখন তাঁর নাম ধরে ডাকা হলো, ২৫ বছরের সেই যুবক জানালেন, তিনি সেনাবাহিনীতে যোগ দেবেন না। তাঁর ধর্ম ও নৈতিক চেতনা এই যুদ্ধের বিরুদ্ধে। কোনো প্রতিবাদ ছাড়া নির্দ্বিধায় গ্রেপ্তার বরণ করলেন বিশ্বের হেভিওয়েট বক্সিং চ্যাম্পিয়ন। যুদ্ধের বিরুদ্ধে ও মার্কিন সাম্রাজ্যবাদী রাজনীতির বিরুদ্ধে সেটি ছিল এক প্রবল মুষ্ট্যাঘাত। ঠিক যে রকম তীব্র মুষ্ট্যাঘাতে বিশ্বচ্যাম্পিয়ন বক্সার তাঁর সব প্রতিদ্বন্দ্বীকে ধরাশায়ী করেছেন।
হঠাৎ, কোনো ভাবনাচিন্তা ছাড়া, সস্তা হাততালির জন্য আলী এ কাজটি করেননি। সেনাবাহিনীতে যোগ দিতে অস্বীকার করলে তাঁকে কী চরম মূল্য দিতে হবে, আলী জানতেন। মনে রাখা ভালো, এটা এমন একসময়ের কথা, যখন আলী তাঁর বক্সিং জীবনের সেরা সময় অতিবাহিত করছেন। দুই বছর আগে সনি লিস্টনকে মাত্র দুই মিনিটে দ্বিতীয়বার পরাজিত করে সবাইকে তাক লাগিয়ে দিয়েছেন। পরের বছর পাঁচটি লড়াইয়ে জিতে তিনি খ্যাতির শীর্ষে। ১৯৬৭-তে, সেনাবাহিনীতে অংশগ্রহণ অস্বীকার করার ঠিক আগে আগে, আর্নি টেরেল ও জোরা ফোলিকে ধরাশায়ী করে নিজের বক্সিং খেতাব অক্ষুণ্ন রেখেছেন। ধনে-মানে তখন তিনি পৃথিবীর সেরা বক্সার। আলী জানতেন সেনাবাহিনীতে অংশগ্রহণে অস্বীকার করার এই সিদ্ধান্তের জন্য তিনি গ্রেপ্তার হতে পারেন। তার চেয়েও ভয়ের কথা তাঁর বক্সিং খেতাব ছিনিয়ে নেওয়া হবে, প্রতিটি শ্বেতকায় আমেরিকানের চোখে তিনি হবেন বিশ্বাসঘাতক। সম্পূর্ণ সচেতনভাবে, সব জেনেশুনে নিজের সিদ্ধান্তে অটুট থাকলেন আলী।
সেটি ছিল বিশ্বের ইতিহাসে ভিন্নমতের এক সেরা উদাহরণ। তিনি সক্রেটিসের মতো দার্শনিক ছিলেন না, গ্যালিলিওর মতো বিজ্ঞানী ছিলেন না, গান্ধীর মতো রাজনীতিক ছিলেন না। শুধু একজন বক্সার, সেই এক ঘটনায় বিশ্বের স্মরণীয় ভিন্নমতাবলম্বীদের তালিকায় নিজের নাম লেখালেন। তিনি কেন ভিয়েতনামের যুদ্ধে অংশ নিতে চান না, তার ব্যাখ্যায় আলী যা বলেছিলেন, যুদ্ধবাজ আমেরিকার মুখে সেটি ছিল সেরা চপেটাঘাত। আলী বললেন, ‘আমাকে কেন সামরিক উর্দি পরে ১০ হাজার মাইল দূরে ভিয়েতনামের বাদামি মানুষদের ওপর বোমা ফেলতে ও গুলি ছুড়তে বলা হবে, যখন (আমার নিজ শহর) লুইভিলে তথাকথিত নিগ্রোদের সঙ্গে কুকুরের মতো ব্যবহার করা হয়, তাদের মৌলিক অধিকারটুকুও অস্বীকার করা হয়?
না, নিজ দেশ থেকে ১০ হাজার মাইল দূরে শুধু বিশ্বের কালো মানুষের ওপর শ্বেতকায় দাস প্রভুদের প্রভুত্ব বজায় রাখতে আরেক অভাগা দেশের মানুষ খুন করতে, তাদের জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে মারতে আমি যাব না। এই নারকীয় বর্বরতার অবসান হতে হবে, এখন থেকেই। আমাকে সাবধান করে বলা হয়েছে, আমার এই সিদ্ধান্তের ফলে চ্যাম্পিয়ন হিসেবে আমি কোটি কোটি ডলার উপার্জনের সুযোগ হারাব, আমার সম্মান ছিনিয়ে নেওয়া হবে।
আমি আরও একবার স্পষ্ট করে বলতে চাই, আমার মানুষদের সত্যিকার শত্রু (বিদেশে নয়) এখানে, আমার নিজের দেশে। যারা ন্যায়বিচার, স্বাধীনতা ও সমতার জন্য লড়াই করছে, তাদের দাস বানানোর হাতিয়ার হয়ে আমি কিছুতেই নিজের ধর্মবিশ্বাস ও নিজের (কালো) মানুষদের জন্য অবমাননা বয়ে আনতে পারব না।
আমি যদি এ কথা জানতাম যে এই যুদ্ধের ফলে ২ কোটি ২০ লাখ (কালো) মানুষের জীবনে মুক্তি আসবে, তাহলে আমাকে সেনাবাহিনীতে ভর্তির নির্দেশ দিতে হতো না, আমি কালই তাতে যোগ দিতাম (স্বেচ্ছায়)। আমাকে হয় এ দেশের আইন অথবা আল্লাহর আইন মানতে হবে। নিজের বিশ্বাসের পক্ষে দাঁড়িয়ে আমার হারানোর কিছুই নেই। অতএব আমি জেলে যেতেই মনস্থ করেছি। এ আর নতুন কী কথা, আমাদের মতো কালো মানুষদের এ দেশে ৪০০ বছর ধরে জেলে পুরে রাখা হয়েছে।’
ঠিক সেই মুহূর্তে, আলী আর শুধু একজন বক্সার থাকলেন না, হয়ে উঠলেন নৈতিকতার পক্ষে মানবতার সেরা এক কণ্ঠস্বর। যাঁদের আমরা রাজনৈতিক ভিন্নমতাবলম্বী বলে জানি, তাঁরাও আলীর সেই সিদ্ধান্ত ও তাঁর কথা থেকে প্রেরণা খুঁজে পেলেন। রোবসন আইল্যান্ডে ২৭ বছর জেলে কাটিয়েছেন নেলসন ম্যান্ডেলা। তিনি বলেছিলেন, ‘আলীর সেই এক সিদ্ধান্ত থেকে আমি শক্তি পেয়েছিলাম, আমার মধ্যে নিশ্চিত বিশ্বাস জন্মেছিল একদিন জেলখানার এই দেয়াল ভেঙে পড়বেই।’ মার্টিন লুথার কিং, কৃষ্ণ অধিকার আন্দোলনের অবিসংবাদিত নেতা বলেছিলেন, ‘আলী আমাদের মনের কথাটাই বলেছে, আমরা যারা কালো, বাদামি ও দরিদ্র, তারা সবাই এক নিপীড়ন ব্যবস্থার শিকার।’
আলীর এই সিদ্ধান্ত ও বক্তব্য এত গুরুত্বপূর্ণ কেন?
সাপ্তাহিক নেশন পত্রিকার ভাষ্যকার ডেভিড জিরিন তার ব্যাখ্যা করেছেন এভাবে, মোহাম্মদ আলী যা করেছিলেন তা হলো, সত্যিকার সাহসের প্রকাশ। বক্সিং রিংয়ে তিনি সনি লিস্টনের মতো বিশ্বচ্যাম্পিয়নকে ধরাশায়ী করেছেন। কিন্তু শুধু সেটিই তাঁর সাহসের প্রকাশ ছিল না। অসীম ক্ষমতাধর মার্কিন সরকারের বিরুদ্ধে তিনি দাঁড়িয়েছিলেন, তাদের অন্যায় যুদ্ধনীতির প্রতিবাদ করেছিলেন, কালো মানুষের অধিকারহীনতার প্রতিবাদ করেছিলেন। প্রকৃত সাহসের তো সেটাই পরিচয়। তিনি ভীত হতে অস্বীকার করেছিলেন, অন্যদের সাহস জুগিয়েছিলেন।
আলী যখন ভিয়েতনাম যুদ্ধের বিরুদ্ধে দাঁড়ালেন, তিনি কালো মানুষ হলেও শ্বেত সভ্যতার সব সুবিধা তাঁর মুঠোর নাগালে ছিল। সাদা মানুষের কাছে ধন ও ক্ষমতার চেয়ে বড় কিছু নেই। তারা বিস্মিত হয়ে দেখল একজন কালো মানুষ কী অনায়াসে ধন ও ক্ষমতা দুটোই ত্যাগ করছেন নীতির খাতিরে। আর সংগ্রামরত কালো মানুষেরা তাঁর মধ্যে পেল এমন একজন মানুষ, যিনি সারা বিশ্বের মানুষকে সদর্পে বললেন, ‘আমি কালো, কোনো অংশে আমি তোমার চেয়ে খাটো নই।’
মার্কিন লেখক জেরাল্ড আর্লি লিখেছেন, আলীর সে কথা শুনে সেদিন আমি কেঁদেছি, আমার বুক গর্বে ভরে গেছে। নিজেকে কালো বলতে আমার আর কোনো দ্বিধা ছিল না। ‘সেদিন আমি কেঁদেছি আলীর জন্য, আমার নিজের জন্য, সব কালো মানুষ ও তাদের সম্ভাবনার জন্য।’
আলী পৃথিবীর একজন সেরা মুষ্টিযোদ্ধা ছিলেন, সম্ভবত সর্বকালের সেরা। প্রজাপতির মতো উড়ে বেড়াতেন, মৌমাছির মতো হুল ফোটাতেন তিনি। শুধু একজন সেরা বক্সার হলে তাঁকে আমরা শুধু একজন বড় খেলোয়াড় বলেই মনে রাখতাম। বিশ্বে অনেক সেরা খেলোয়াড় আছেন কিন্তু নৈতিক অবস্থানের জন্য বা অবিচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের জন্য কে এমন ঝুঁকি নিতে পারেন! এখানেই আলীর শ্রেষ্ঠত্ব, নিজের নৈতিক অবস্থানের জন্য সব খ্যাতি ও ধন তিনি হেলায় ছুড়ে ফেলেছিলেন।
অন্য কোনো পরিচয় নয়, এই সাহসী ভিন্নমতাবলম্বী বিদ্রোহীকেই আজ বিশ্বের মানুষ ভালোবাসার অশ্রু ও পুষ্পাঞ্জলিতে স্মরণ করছে।
৬ জুন ২০১৬, নিউইয়র্ক
হাসান ফেরদৌস: যুক্তরাষ্ট্রে প্রথম আলোর বিশেষ প্রতিনিধি।