যুক্তরাষ্ট্রের গণতন্ত্র সম্মেলন গণতান্ত্রিক বানিয়েছে চীনকেও!

যুক্তরাষ্ট্রের গণতন্ত্র সম্মেলন বিশ্বে নতুন রাজনৈতিক মেরুকরণের ইঙ্গিত দিচ্ছে কি?
ফাইল ছবি: রয়টার্স

যুক্তরাষ্ট্রের আয়োজিত সাম্প্রতিক গণতন্ত্র সম্মেলনে আমন্ত্রিত দেশগুলোর তালিকা কি সঠিক? এটি কি আসলেই গণতন্ত্রকে শক্তিশালী করে তোলার সম্মেলন? এই সম্মেলন আদতে চীনবিরোধী আরেকটি জোটে পরিণত করার চেষ্টা? আমেরিকার কি গণতন্ত্র নিয়ে কথা বলার নৈতিক অধিকার আদৌ আছে? নানা প্রশ্ন শুধু বিশ্বব্যাপীই ঘুরপাক খাচ্ছে না, খাচ্ছে আমাদের দেশেও।

ওদিকে গণতন্ত্রের সম্মেলনে বাংলাদেশ আমন্ত্রিত না হওয়ার আলোচনা শেষ হতে না হতেই তুমুল আলোচনা তৈরি করল বাংলাদেশের বাহিনী র‍্যাবের কিছু সাবেক এবং বর্তমান কর্মকর্তার ওপর আমেরিকার নিষেধাজ্ঞা। এর মাধ্যমে বাংলাদেশকে এই যাত্রায় নিষেধাজ্ঞা দেওয়া অপর তিন দেশ চীন, উত্তর কোরিয়া ও মিয়ানমারের কাতারে নামিয়ে আনা হলো কি!

সুতরাং গণতন্ত্র, মানবাধিকার—এসব এই মুহূর্তে আমাদের দেশেও বেশ আলোচিত হচ্ছে।

গণতন্ত্র সম্মেলনের ‘প্রকাশ্য’ বক্তব্য
বর্তমান মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের নির্বাচনী প্রতিশ্রুতির মধ্যেই ছিল নির্বাচিত হলে প্রথম বছরেই বৈশ্বিক গণতন্ত্র সম্মেলন আয়োজন করবেন তিনি। সেই প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী প্রথম গণতন্ত্র সম্মেলনটি অনুষ্ঠিত হলো।

এই সম্মেলনের তিনটি ঘোষিত উদ্দেশ্য উল্লেখ করা প্রয়োজন বলে মনে করছি: ১. স্বচ্ছ নির্বাচন নিশ্চিত করা এবং কর্তৃত্বপরায়ণ সরকার প্রতিরোধ করা। ২. দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াই করা। ৩. সব দেশে মানবাধিকার নিশ্চিত করা।

এ ছাড়া সব দেশের নাগরিক সমাজের সঙ্গে অংশীদারি তৈরি করার কথা আছে। আছে এই মুহূর্তে অত্যন্ত প্রভাবশালী হয়ে ওঠা প্রযুক্তি কোম্পানিগুলো (সামাজিক মাধ্যম, যোগাযোগ অ্যাপ, সার্চ ইঞ্জিন) যেন গণতন্ত্রের পথে বাধা হয়ে ওঠে, তেমন কোনো কিছু না করে সেটা নিশ্চিত করার কথা। একই সঙ্গে এটাও নিশ্চিত করার চেষ্টা হবে, এই মাধ্যমগুলো যেন মানুষের বাক্স্বাধীনতা রক্ষা করার সব রকম ব্যবস্থা নেয়।

আন্তর্জাতিক সম্পর্কে কোনো চ্যারিটির জায়গা নেই
এই উপশিরোনামে লেখা বাক্যটি আমাদের সবার সব সময় মনে রাখা উচিত আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বোঝাবুঝির ক্ষেত্রে। আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে প্রতিটি দেশের প্রতিটি পদক্ষেপের পেছনে থাকে স্বল্প, মধ্য কিংবা দীর্ঘমেয়াদি নানা স্বার্থ। চীন-পাকিস্তান সম্পর্কের ক্ষেত্রে বহুল ব্যবহৃত ‘সব ঋতুর বন্ধু’ কিংবা ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের ক্ষেত্রে বর্তমান বাংলাদেশ সরকারের ব্যবহার করা ‘স্বামী-স্ত্রীর মতো সম্পর্ক’, ‘ভাই-বোনের মতো সম্পর্ক’, ‘রক্তের রাখিবন্ধন’-জাতীয় কথাগুলো আসলে কতগুলো কূটনৈতিক বাগাড়ম্বর।

যদি দেখা যায় কোনো দেশ অন্য দেশকে মানবিক সাহায্য করছে, কোনো দেশ যদি অন্য কোনো দেশকে স্বাধীনতাসংগ্রামে সাহায্য করছে, এক দেশ অন্য দেশের ‘উন্নয়ন সহযোগী’ হয়েছে—এগুলোকে কখনো কখনো চ্যারিটি বলে মনে হলেও প্রতিটি আসলে সেই দেশের স্বার্থের হিসাব-নিকাশ থেকেই করে। অনেক সময় দুটি দেশের জনগণের স্বার্থ পারস্পরিকভাবে মিলে যায়—উপকৃত হয় দুই দেশের জনগণই। আবার বহু সময় কোনো একটি দেশের শাসক অপর একটি দেশের সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি করে নিজে এবং তার সঙ্গে জড়িত মানুষেরা লাভবান হয়, কিন্তু ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় দেশের সাধারণ নাগরিকেরা।

কর্তৃত্বপরায়ণ দেশগুলো চীনের সহজ টার্গেটে পরিণত হওয়ার একটা স্বাভাবিক প্রবণতা আছে। অবিকশিত গণতন্ত্র কিংবা কর্তৃত্বপরায়ণ হওয়ার কারণে প্রায় পুরো আফ্রিকা, এশিয়ার অনেক দেশসহ ইউরোপের কর্তৃত্বপরায়ণ হয়ে ওঠা দেশগুলো চীনের প্রভাববলয়ে চলে যাচ্ছে। সুতরাং আমেরিকাকে তার বৈশ্বিক ব্যবস্থায় অবস্থান পুনরুদ্ধার করার ক্ষেত্রে যত বেশি সম্ভব দেশকে কর্তৃত্বপরায়ণতা থেকে বের করে আনতে হবে। এটাই গণতন্ত্র সম্মেলন নিয়ে আমেরিকার প্রধান স্বার্থ।

এই আলোচনাকে আমরা যদি সঠিক বলে মনে করি, তাহলে আমরা বুঝব আজ গণতন্ত্র সম্মেলনের সমালোচনা করতে গিয়ে আমাদের দেশের রাজনৈতিক দল তো বটেই, আন্তর্জাতিক সম্পর্কের কিছু বিশ্লেষক গণতন্ত্র সম্মেলন ডাকার নৈতিক অধিকার আমেরিকার আছে কি না কিংবা এর লক্ষ্য গণতন্ত্র শক্তিশালী করা নাকি অন্য কিছু জাতীয় যেসব প্রশ্ন তুলেছেন, সেগুলোকে অবান্তর বলে মনে হবে।

আন্তর্জাতিক সম্পর্ক কেমন হওয়া উচিত, কোনটি নৈতিক আর কোনটা সেটা নয়, এসব আলোচনা বাতুলতা। আমরা চাই বা না চাই, পৃথিবী এভাবেই চলে, এভাবেই কাজ করে। কোনো ইউটোপিয়ান নীতিতে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক চলেনি ইতিহাসের কোনো দিন।

বিশ্বে গণতন্ত্রের পুনর্জাগরণ করানো আমেরিকার ‘চ্যারিটি’ নয়
বৈশ্বিক গণতন্ত্রে জোয়ার-ভাটা আছে। এখন গণতন্ত্রের ভাটার টান চলছে। ২০০৬ সালের পর থেকে বিশ্বে কার্যকর গণতন্ত্রের সংখ্যা প্রতি বছর ক্রমাগত কমছে; অনেক বেশি দেশ আরও বেশি কর্তৃত্বপরায়ণ হয়ে উঠছে। কর্তৃত্বপরায়ণ দেশগুলো চীনের সহজ টার্গেটে পরিণত হওয়ার একটা স্বাভাবিক প্রবণতা আছে। অবিকশিত গণতন্ত্র কিংবা কর্তৃত্বপরায়ণ হওয়ার কারণে প্রায় পুরো আফ্রিকা, এশিয়ার অনেকগুলো দেশ তো বটেই, ইউরোপের কর্তৃত্বপরায়ণ হয়ে ওঠা দেশগুলো চীনের প্রভাববলয়ে চলে যাচ্ছে। হাঙ্গেরি ও পোল্যান্ড এর খুব জ্বলন্ত উদাহরণ।

সুতরাং আমেরিকাকে তার বৈশ্বিক ব্যবস্থায় অবস্থান পুনরুদ্ধার করার ক্ষেত্রে যত বেশি সম্ভব দেশকে কর্তৃত্বপরায়ণতা থেকে বের করে আনতে হবে। এটাই গণতন্ত্র সম্মেলন নিয়ে আমেরিকার প্রধান স্বার্থ।

আমেরিকার গণতন্ত্র সম্মেলন প্রসঙ্গে আমেরিকার অতীতের নানা ‘কুকর্ম’ নিয়ে অনেকে আলোচনা করছেন। এই আলোচনাগুলো অর্থহীন। যখন কোনোখানে গণতন্ত্রকে বাধাগ্রস্ত করে আমেরিকার তার স্বার্থরক্ষার প্রয়োজন ছিল, তখন সে সেটা করেছে। এখন আমেরিকা যদি মনে করে গণতন্ত্রকে আবার শক্তিশালী করার মাধ্যমেই তার স্বার্থ রক্ষা হবে, তাহলে সে সেটাই করবে। এখানে আমেরিকাকে আলাদা করে দেখার কোনো কিছু নেই। পৃথিবীর প্রতিটি দেশ তার সামর্থ্য অনুযায়ী এটাই করে।

বর্তমান সময়ে আমেরিকার ট্রাম্পের ‘গুটিয়ে থাকা বিশ্বনীতি’ থেকে সরে আসা, গণতন্ত্র, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, মানবাধিকারের পক্ষে আর দুর্নীতির বিপক্ষে দৃঢ়ভাবে কথা বলা সেই সব দেশের জনগণের জন্য একটা আশা তৈরি করছে, যেখানে এর মধ্যেই কর্তৃত্ববাদ জেঁকে বসেছে অথবা গণতন্ত্র ভীষণভাবে ক্ষয়িষ্ণু হয়ে পড়েছে। বাংলাদেশের জনগণের জন্য (সরকার নয়) এখানেই একটা স্বার্থের বিষয় আছে।

বাংলাদেশে নিযুক্ত চীনা রাষ্ট্রদূতের সাম্প্রতিক মন্তব্যে বিস্মিত নই
অতিসম্প্রতি বাংলাদেশে নিযুক্ত চীনা রাষ্ট্রদূত বাংলাদেশ নিয়ে যেসব মন্তব্য করেছেন, তাতে আমি মোটেও বিস্মিত নই। এই অঞ্চলের ভূরাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে এখন আর কূটনৈতিক ভাষায় নরমভাবে কথা বলার চাইতে স্পষ্টভাবে বলাটাকেই অনেক বেশি জরুরি বলে মনে করছে চীন।

যখনই আমেরিকা বা পশ্চিমা বিশ্ব কোনো দেশকে নিষেধাজ্ঞা দেয়, সেই দেশের পাশে চীন কিংবা রাশিয়া গিয়ে দাঁড়ায়; এটা পুরোনো চর্চা। এর মাধ্যমেই আপাতদৃষ্টে বিপদাপন্ন দেশটির সাহায্যকারী হিসেবে সেই দেশটির সঙ্গে সম্পর্ক আরও গভীর করে তোলার চেষ্টা করে। গণতন্ত্রের সম্মেলনে ডাক না পাওয়ার পর বাংলাদেশকে সান্ত্বনা দিয়ে রাশিয়ার দূতাবাস পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে বার্তা দিয়েছে। তাদের কৌশলগত দিক থেকে এটাই ঠিক। তবে চীনা রাষ্ট্রদূত যা যা বলেছেন, তার মধ্যে একটি বিষয়ে আমার কাছে অত্যন্ত লক্ষণীয় ব্যাপার বলে মনে হয়েছে।

গণতন্ত্র এবং গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে নিজেদের মতো করে ব্যাখ্যা করে নিজেদের গণতান্ত্রিক দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করেছেন। এমনকি নিজেদের ‘গণতান্ত্রিক’ প্রমাণ করার জন্য তাঁরা গণতন্ত্রের সংজ্ঞা পাল্টে ফেলার কথা বলছেন। তিনি এই যে বক্তব্যগুলো দিলেন, সেটি আসলে সম্প্রতি প্রকাশিত গণতন্ত্র নিয়ে একটি চীনা শ্বেতপত্রের অংশ।

চীনের ‘যে গণতন্ত্র কাজ করে’
ঘটা করে আমেরিকার গণতন্ত্র সম্মেলনের উদ্দেশ্য চীনের না বোঝার কোনো কারণ নেই। তাই চীনের নানামুখী প্রতিক্রিয়া খুবই প্রত্যাশিত। এর মধ্যে সবচেয়ে মজার যে ঘটনাটি ঘটেছে সেটা হচ্ছে গণতন্ত্র নিয়ে চীনের প্রকাশিত একটি শ্বেতপত্র। ‘চায়না: ডেমোক্রেসি দ্যাট ওয়ার্কস’ শিরোনামের মোটামুটি দীর্ঘ একটি লেখায় চীন নানাভাবে প্রমাণ করার চেষ্টা করেছে চীন একটি অসাধারণ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র।

এই দলিলে আলোচনা আছে চীনের আইন পরিষদ, অর্থাৎ ন্যাশনাল পিপলস কংগ্রেস (এনপিসি) কীভাবে আইন পাস করে। আমাদের জানানো হয়েছে, সেখানে চীনা কমিউনিস্ট পার্টি একমাত্র দল নয়, আছে আরও আটটি দল। সেখানে আছে একেবারে স্বতন্ত্র সদস্যও। তাই সেখানে নাকি খুবই আলাপ-আলোচনার সুযোগ আছে। অবশ্য অন্য দলগুলোর ক্ষেত্রে বলা হয়েছে, তারা চীনা কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্ব মেনে কাজ করে।

পৃথিবীর কোনো সিস্টেমই শতভাগ নিখুঁত নয়। সবচেয়ে উন্নত গণতান্ত্রিক দেশগুলোতেও পদ্ধতিগত কিছু সমস্যা তো থাকেই। কিন্তু এখনো পৃথিবীতে গণতন্ত্রই বিকল্পহীন শাসনব্যবস্থা; জনগণের আস্থার একমাত্র জায়গা। তাই ‘বনিয়াদি গণতন্ত্র’, ‘উন্নয়নের গণতন্ত্র’ কিংবা ‘কার্যকরী গণতন্ত্র’ নামে আদতে ‘গণতন্ত্র’ শব্দটি নিজের সঙ্গে যুক্ত করতে চায় সব স্বৈরাচারী শাসক। এভাবেই তাঁরা জয়ী করেন, অপরিহার্য করে তোলেন গণতন্ত্রকে।

সেই শ্বেতপত্র আমাদের জানায়, তাদের আছে বিশেষজ্ঞদের নিয়ে গঠিত চায়নিজ পিপলস ন্যাশনাল কনসালট্যাটিভ কনফারেন্স (সিপিপিসিসি), যেখানে পার্টির সদস্য ছাড়াও আছেন রাষ্ট্রের নানা ‘স্বাধীন’ থিঙ্কট্যাংক এবং বিশেষজ্ঞরা। বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠী-অধ্যুষিত অঞ্চলে স্বায়ত্তশাসনের কথা বলা আছে, আছে গ্রামপর্যায়ে নাগরিকদের প্রতিনিধি ‘নির্বাচন’ করার ক্ষমতার কথা।

জনগণের অভাব-অভিযোগ-ক্ষোভের কথা ক্ষমতাসীন পার্টি তার চ্যানেলে বের করে নিয়ে আসে। একই সঙ্গে জনগণ তাদের স্থানীয় প্রতিনিধির কাছে তাদের সমস্যার কথা জানাতে পারে এবং তার মাধ্যমে ধাপে ধাপে সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছাতে পারে। এ ছাড়া জনগণ তাদের নানা সামাজিক মাধ্যমে তাদের অভিযোগ জানাতে পারে। এভাবেই তাঁরা একটি ‘কার্যকর গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা’ নিশ্চিত করেছেন।

এই শ্বেতপত্রে গণতন্ত্রের মূল ভিত্তি নির্বাচনী ব্যবস্থাকে তুলাধোনা করার চেষ্টা করা হয়েছে। বলা হয়েছে, এই ব্যবস্থায় নির্বাচনের সময় অনেক গান-নাচ হয়, কিন্তু নির্বাচনের পর সরকার তার প্রতিশ্রুতি রক্ষা করে না বলে এই ব্যবস্থা অর্থহীন।
চীনের এসব দাবি নিয়ে আলোচনা করে খুব সহজেই প্রমাণ করা যায় এসব দাবি কতটা অসার। কিন্তু আমি বিশ্বাস করি, পাঠকেরা সুস্পষ্টভাবেই বুঝতে পারছেন এসব দাবি খণ্ডন করার কিছু নেই। এই দেশে বাস করে ক্ষমতাসীন সরকারের দিক থেকে এমন নানা কথা বলে দেশকে অসাধারণ গণতান্ত্রিক দাবি প্রতিনিয়ত করতে দেখি।

বরং চীন গাইতে পারত কর্তৃত্বপরায়ণতার জয়গান
শুরুতেই বলে রাখি, বর্তমান বিশ্বে অর্থনৈতিক উন্নয়নে চীনের সাফল্য তার কর্তৃত্বপরায়ণ সরকারব্যবস্থার কারণে ঘটেছে বলে যে আলাপ, সেটা নিয়ে খুব যৌক্তিক প্রশ্ন তোলা যেতে পারে। চীনের চেয়ে কম সময় পূর্ণ গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার অধীনে মানবাধিকার, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নিশ্চিত করে চীনের চেয়ে অনেক ভালো অর্থনীতি তৈরি করতে পেরেছে, এমন দেশের উদাহরণ আছে। এই গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা আমি শিগগির করব ভিন্ন একটি কলামে।

চীনা ডেটার বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে গুরুতর সমালোচনা থাকলেও আমরা এ কথা নিশ্চয়ই মেনে নেব, চীন তার নিজস্ব ঢঙের শাসনপদ্ধতি এবং অর্থনৈতিক ব্যবস্থার মাধ্যমে উল্লেখযোগ্য অর্থনৈতিক অগ্রগতি করেছে।

সেই পরিপ্রেক্ষিতেই চীন দাবি করতে পারত গণতন্ত্রের বিরুদ্ধে তার এই কর্তৃত্ববাদী ব্যবস্থাই সঠিক। তারা দেখতে পারত এই ব্যবস্থার মাধ্যমে তারা কতটা উন্নতি করতে পেরেছে। তাদের ব্যবস্থা গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার চেয়ে উন্নত প্রমাণের জন্য তারা যেমন ভারতের সঙ্গে নিজেদের অর্থনৈতিক উন্নতির তুলনা সব সময় করে, সেটা আরও জোরেশোরে চালিয়ে যেতে পারত।

চীন তার কর্তৃত্ববাদী ব্যবস্থার পক্ষে শক্তভাবে দাঁড়িয়ে অন্য দেশগুলোকে তার মতো ব্যবস্থায় আসার আহ্বান জানাতেই পারত। যেমন বাংলাদেশে ২০১৮ সালের তথাকথিত নির্বাচনটির পর চীনা সরকারের মুখপাত্র গ্লোবাল টাইমসে বাংলাদেশকে বহুদলীয় ব্যবস্থা থেকে সরে আসার প্রেসক্রিপশন দেওয়া হয়েছে ‘বহুদলীয় রাজনৈতিক ব্যবস্থা থেকে সরে আসার মাধ্যমে বাংলাদেশ আরও বেশি সুযোগ সৃষ্টি করতে পারবে’ শিরোনামের এক উপসম্পাদকীয়তে।

সত্যি বলতে চীন তার এই দর্শন পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে রপ্তানি করার চেষ্টা করেছে, করছে এখনো। সঙ্গে সারা পৃথিবীর যেখানেই কর্তৃত্ববাদী শাসক আছে, তাদের সঙ্গে একটা ভালো বোঝাপড়ার সম্পর্ক তৈরি করার চেষ্টা করছে।

অথচ আমাদের কাছে আপাতবিস্ময় হয়ে আসে যখন দেখি চীন নিজের কর্তৃত্বপরায়ণতাকে লুকিয়ে ফেলে নিজেকে গণতান্ত্রিক প্রমাণ করার চেষ্টা করছে।

চীন আসলে মহিমান্বিত করল গণতন্ত্রকেই
এখানে আমি গণতন্ত্র বলতে চীনা মডেলের ‘যে গণতন্ত্র কাজ করে’, সেটাকে বোঝাতে চাইনি। বোঝাতে চেয়েছি সত্যিকারের গণতন্ত্রকে। এই যে শ্বেতপত্রে চীন বলছে, ‘গণতন্ত্র মানবতার অত্যাবশ্যক মূল্যবোধ’, ‘গণতন্ত্র প্রতিটি দেশের নাগরিকের অধিকার’, এই যে চীন নিজকে গণতান্ত্রিক বলে দাবি করছে, নিজকে সেভাবে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য বিস্তারিত পেপার তৈরি করছে, তাতে একটা বিষয় খুব স্পষ্ট—চীন বুঝতে পারছে তার দেশে এবং বর্তমান পৃথিবীতে জনগণের কাছে গণতন্ত্রের মূল্য এবং চাহিদা এখনো তীব্রভাবেই আছে।

আলোচিত শ্বেতপত্রে বলা হয়েছে, কারও নির্ধারিত মানদণ্ডের সঙ্গে তুলনা করে অন্য দেশের গণতন্ত্র আছে, নাকি নেই, সেটা নির্ধারিত হতে পারে না। পৃথিবীর ভূপ্রকৃতি এবং জাতিগত ভিন্নতা মেনে নিয়ে গণতন্ত্রের ধরন নির্ধারণ করতে হবে। এসব বলে চীন নিজেকে গণতান্ত্রিক প্রমাণ করতে এতটা মরিয়া হয়েছে যে তারা বলেছে, প্রয়োজনে গণতন্ত্রের সংজ্ঞা পাল্টাতে হবে। এই চর্চা চীনের নতুন নয়। একেবারে পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় চলে যাওয়ার পরও নিজেকে এখনো সমাজতান্ত্রিক দাবি করতে গিয়ে দেং জিয়াও পিংয়ের আমল থেকেই চীন তার অর্থনীতিকে ‘সোশ্যালিজম উইথ চায়নিজ ক্যারেক্টারিস্টিকস’, ‘সোশ্যালিস্ট মার্কেট ইকোনমি’ ইত্যাদি নানা অভিধায় অভিহিত করে।

পৃথিবীর কোনো সিস্টেমই শতভাগ নিখুঁত নয়। সবচেয়ে উন্নত গণতান্ত্রিক দেশগুলোতেও পদ্ধতিগত কিছু সমস্যা তো থাকেই। কিন্তু এখনো পৃথিবীতে গণতন্ত্রই বিকল্পহীন শাসনব্যবস্থা; জনগণের আস্থার একমাত্র জায়গা। তাই ‘বনিয়াদি গণতন্ত্র’, ‘উন্নয়নের গণতন্ত্র’ কিংবা ‘কার্যকরী গণতন্ত্র’ নামে আদতে ‘গণতন্ত্র’ শব্দটি নিজের সঙ্গে যুক্ত করতে চায় সব স্বৈরাচারী শাসক। এভাবেই তাঁরা জয়ী করেন, অপরিহার্য করে তোলেন গণতন্ত্রকে।

ডা. জাহেদ উর রহমান ইনডিপেনডেন্ট ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশের শিক্ষক