যেখানেই থাকি, রংপুর জিলা স্কুলেই আছি

উৎ​সবের রঙে রংপুর জিলা স্কুল
উৎ​সবের রঙে রংপুর জিলা স্কুল

রংপুর জিলা স্কুল মানে সবুজ জোড়া মাঠ। তার যেন কোনো আদি নেই, অন্ত নেই। সেই মাঠ দুটোর মধ্যখানে পিচঢালা রাস্তা। তারপর দুটো বটগাছ। তারপর সেই খিলান শোভিত চুন-সুরকির ভবন। আমাদের সময়ে, ১৯৮০ সাল পর্যন্ত তা-ই ছিল। তারপর সেটা সংস্কার করা হয়। কড়ি-বর্গা শোভিত ছাদের বদলে আসে কংক্রিট। সেই হলরুমটা কি এখনো আছে? সেই খাঁজকাটা দরজা, জানালার বিশাল কবাট। আমাদের হলরুমের দরজাটাকে সিংহদরজাই বলা উচিত। 

১৮৩২ সালে স্থাপিত রংপুর জিলা স্কুল। আর ১৬ বছর পর আমরা পালন করতে পারব দু শ বছর। রংপুর জিলা স্কুলের স্মৃতি মানেই মজার স্মৃতি। আনন্দের স্মৃতি। কী একেকজন শিক্ষকই না ছিলেন। দেয়াল পত্রিকা করেছি। স্টেশন বানান লিখেছি ‘ষ’ দিয়ে। আবদুল আলীম স্যার, মোগল বাদশাহর মতো তাঁর দেহকান্তি, সাদা ধবধবে দাড়ি, পেছনে দাঁড়িয়ে বললেন, ‘কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় কনভেনশন অনুযায়ী ইংরেজি “এস”-এর বাংলা “স”, কাজেই তুমি স্টেশন বানান ভুল লিখেছ।’ অমন স্যারেরা ছিলেন বলেই আমি আর ইকবাল বাহার—আমরা দুজনেই ইংরেজিতেও লেটার মার্কস পেয়ে গেলাম।
একদিন আবুল হোসেন স্যার কোলে নিয়েছিলেন। তখন আমি এইটে পড়ি। একটা প্রতিযোগিতায় বক্তৃতা, আবৃত্তি আর রচনা লেখা—তিন বিষয়েই জেলার মধ্যে ফার্স্ট হয়ে স্কুলে ফিরেছি, স্যার শোনামাত্র আমাকে কোলে তুলে নিয়ে হেড স্যারের রুমে ঢুকে গেলেন। অত বড় দামড়াকে কেউ কোলে তোলে?
ক্লাস সিক্সে ক্লাস টিচার পেলাম কাইয়ুম স্যারকে। হাতের লেখা পত্রিকা বের করলাম ‘কচিকণ্ঠ’। স্যার সেই পত্রিকা নিয়ে গিয়ে পুরো স্কুলকে দেখাতে লাগলেন। তখন বললেন, ‘দেয়ালপত্রিকা করো।’ করলাম। সেটা স্কাউটের রুমে অনেক দিন রাখা ছিল।
আমাদের সময়ে মোহাম্মদ বারী ভাই, এখন ঢাকায় নাটক করেন, ছিলেন হিরো। তিনি স্কুলের বার্ষিক পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে দুটো নাটিকা করেছিলেন। কৌতুক আসলে। একটাতে তিনি সেজেছিলেন আমাশয়ের রোগী। ইন্টারভিউ দিতে গিয়ে একটু পর পর পেট মোচড়ান আর বলেন, ‘আমেশা।’ সেইটা মনে পড়লে এখনো হাসি পায়।
মোনায়েম স্যার অঙ্ক ক্লাস নিতেন। ফিজিক্সও পড়াতেন। তাহের আলীকে দেখলে বলতেন, ‘টপে আছে।’ তাহের আলীর গল্প দুটো আমি অনেকবার লিখেছি। একবার সে ক্লাসরুমের সব বেঞ্চ উল্টে রেখেছিল। রাতে বৃষ্টি হলো। পুরোনো ছাদ চুয়ে পানি পড়ে মেঝে ভাসছে। বেঞ্চ সব ওলটানো। মোস্তাফিজ স্যার বেত উঁচিয়ে বললেন, ‘বল, বেঞ্চ ক্যান উল্টাইছিস?’ তাহের আলী বলল, ‘বৃষ্টি তো আকাশ থেকে পড়ে, তাই বেঞ্চ উল্টে রাখলাম, যাতে ভিজে না যায়।’ স্যার হেসে ফেললেন, ‘যা, তোকে ক্ষমা করি দিলাম, উকিল তো ভালোয় ধরছিস।’
আর জিলা স্কুলের বটগাছের নিচে গল্প করতে করতে তাহের আলীর সেই মহান উক্তি, ‘সব সময় ভয়ে ভয়ে থাকি রে, কখন কী ভুল হয়া যায়।’
কী তাহের আলী, কী ভুল তুমি করেছ?
ঢাকায় গিয়েছিল তাহের আলী। বড়লোক আত্মীয়র বাড়িতে উঠেছে। বাথরুমের বালতির পানি কমোডে ঢালার পর বুঝল, লুঙ্গি ভিজানো ছিল বালতিতে। সেই লুঙ্গির অর্ধেকটা ঢুকে গেছে কমোডের পাইপে। এখন সে কী করবে?
তাই তার উপলব্ধি, ‘সব সময় ভয়ে ভয়ে থাকি রে, কখন কী ভুল হয়া যায়।’
সিরাজ স্যার এলেন। নতুন। বাংলা পড়ান। তিনি চলতি বাংলা প্রচলন করলেন। আর ক্রিয়াপদ বাক্যের মাঝখানে আনা শুরু করলেন। যেমন, আমি ভাত খাই। এটাকে বলা যায়, আমি খাই ভাত। পুরো স্কুল সেই উত্তেজনায় কাঁপতে লাগল।
তিনি বটগাছের নিচে ব্যাকরণ নিয়ে একটা ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান করেছিলেন। একজনের বুকে লেখা ‘দি’, একজনের বুকে ‘এ’, আরেকজনের ‘এন’, তারা একে একে এসে বলল, ‘উই আর আর্টিকেলস।’ উফ, কী যে সুন্দর হয়েছিল অনুষ্ঠানটা।
ক্লাস নাইনে পড়ি। স্কুল ছুটি। বাসার সামনের মাঠে লুঙ্গি পরে খেলছি। স্কুল থেকে পিয়ন ভাই এসেছেন সাইকেল নিয়ে, ‘আপনাকে হেড স্যার ডাকে।’ আমি বলি, ‘লুঙ্গি পরে স্কুলে যাব না।’ তিনি বললেন, ‘আপনাকে যে অবস্থায় যখনই পাওয়া যাবে, ধরে নিয়ে যাওয়ার অর্ডার হয়েছে।’ গেলাম স্কুলে, সাইকেলের সামনে বসে। স্যার তাঁর রুম খুলে বসে আছেন। আমাকে জড়িয়ে ধরলেন। বললেন, ‘তোমাকে ঢাকা যেতে হবে। প্রেসিডেন্ট তোমাকে সংবর্ধনা দেবেন। তুমি বিভাগের মধ্যে বৃত্তিতে ফার্স্ট হয়েছ। আজ তোমাকে বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট ডাকছেন। দোয়া করি, একদিন তোমাকে পৃথিবীর প্রেসিডেন্ট ডাকবেন।’ আবেগের তোড়ে স্যার বলে ফেললেন। পৃথিবীর যে প্রেসিডেন্ট হয় না, স্যার তা খেয়াল করেননি।
ছবি আঁকতাম বলে স্কুলের প্রত্যেক ক্লাসরুমের সামনের সাইনবোর্ড আমাকে দিয়ে লিখিয়ে নিলেন স্যারেরা। স্টিলের পাতে তেলরং দিয়ে লিখলাম। তা কি আর কাগজে কালি দিয়ে লেখার মতো সোজা? বহুত কষ্ট হয়েছিল। কিন্তু বহুদিন আমার হাতের লেখাই ক্লাসরুমের দরজার ওপরে ঝুলে ছিল।
আমাদের বন্ধুরা। রিবেন ছিল মহারসিক। টিপু ছিল খেলাপাগল। আমরা কেউ মোহামেডান, কেউ আবাহনী। খালি ঝগড়া করতাম। রাজ ছিল বড়লোক। রাজ আর দীপুর গাড়ি ছিল। আমরা সবাই হেঁটে যেতাম স্কুলে। দল বেঁধে। মোহাম্মদ আলী ক্লে মুষ্টিযুদ্ধ করবেন। টিভিতে দেখাবে। টিভি আছে ভিকটোর বাড়ি। স্কুল ছুটি হয়ে গেল। আমরা বক্সিং দেখতে গেলাম ভিকটোর বাড়ি। মোহাম্মদ আলী ক্লে হেরে গেলেন। পরের দিন মোস্তাফিজ স্যারের অমিয় বাণী, ‘এহ, এই খেলা দেখিবার জন্য ছুটি নিছেন, গু-হারা হারছে।’ কথাটা ‘গো-হারা’।
দুপুরে ছিল টিফিন। তিন টাকা ছিল টিফিন ফি। সিংগারা, নিমকি-জিলাপি, খোরমা, মিষ্টি—একেক দিন একেকটা ছিল টিফিন। রেইনি ডে হলে ডাবল টিফিন।

রংপুর জিলা স্কুল
রংপুর জিলা স্কুল

আহা, আমাদের রংপুর জিলা স্কুল। কী যে ভালোবাসতেন আমাদের স্যারেরা। এখনো বাসেন। আমি তো কেমিস্ট্রিতে খুব খারাপ ছিলাম। ভালো ছিলাম বাংলায়। কেমিস্ট্রি পড়াতেন শহীদুল স্যার। আমি কেমিস্ট্রি পারতাম না। তাই আমার ধারণা ছিল, স্যার নিশ্চয়ই আমাকে বেশি পছন্দ করেন না। নয় বছর আগে আমরা জিলা স্কুলের ১৭৫তম জয়ন্তীর অনুষ্ঠান করেছিলাম।
শুনি শহীদুল স্যার আরেকজনকে বলছেন, ‘আনিসুল আছে, তাইলে আর চিন্তা নাই, অনুষ্ঠান ভালো হবে।’ আরে, কেমিস্ট্রি স্যার কী বলেন। আমি না কেমিস্ট্রিতে খারাপ ছিলাম!
আমার বন্ধুরা কে কোথায় এখন? বিজ্ঞানমেলায় পুরস্কার বিজয়ী ফিজো? সিংগারা হাউসের মালিকের ছেলে লুকু? আমার এক নম্বরের চ্যালা স্বপন? পণ্ডিত স্যারের ছেলে লাহিরী? যমজ দুই ভাই? আবুল হোসেন স্যারের ছেলে মাসুম? ড্রিল স্যারের ছেলে জুয়েল?
ভিকটো ছিল আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের একজন। এইবার রংপুর জিলা স্কুলের ১৮৪তম বছরে ১৪ ও ১৫ সেপ্টেম্বর ২০১৬ যে পুনর্মিলনী অনুষ্ঠান হচ্ছে, মন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর যা উদ্বোধন করে দেবেন, তাতে আমার রেজিস্ট্রেশন করে দিয়েছে ভিকটো। এখন স্বাস্থ্যবিষয়ক আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন গবেষক। চাঁদার টাকা ও-ই দিয়েছে। কিন্তু ও নিজেই বোধ হয় রংপুর যেতে পারবে না। তাতে কী। আমাদের স্লোগান হলো, ‘যেথায় থাকি যে যেখানে, বাঁধন আছে প্রাণে প্রাণে।’
আমরা, রংপুর জিলা স্কুলের বর্তমান ছাত্র, প্রাক্তন ছাত্র, শিক্ষক-কর্মচারীরা, যে যেখানে থাকি, আমাদের মন পড়ে থাকবে রংপুর জিলা স্কুলের মাঠে। যেখানে আমরা বলতে পারি,
আকাশ আমায় শিক্ষা দিল উদাস হতে ভাইরে,
কর্মী হবার মন্ত্র আমি বায়ুর কাছে পাইরে,
পাহাড় শেখায় তাহার সমান হই যেন ভাই মৌনমহান,
খোলা মাঠের উপদেশে দিলখোলা হই তাইরে।
আমাদের আকাশ ছিল। বাতাস ছিল। মাঠ ছিল। পাহাড় ছিল না। কিন্তু পাহাড়ের মতো বড় হৃদয়ের শিক্ষকেরা ছিলেন।