যে কারণে ট্রাম্পকে ভয় পাচ্ছেন না খামেনি

ওয়াশিংটন পোস্ট পত্রিকায় গত ১৩ জুন জাতিসংঘে যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক রাষ্ট্রদূত জালমে খলিলজাদের একটি নিবন্ধ ছাপা হয়েছে। এতে তিনি বলেছেন, ইরান-চুক্তি থেকে ট্রাম্পের বেরিয়ে যাওয়া এবং তেহরানের ওপর নতুন করে অবরোধ আরোপ করার পর এখন ইরান সরকারের সামনে ট্রাম্পের সঙ্গে সরাসরি আলোচনায় বসার সুযোগ তৈরি হয়েছে। তিনি যুক্তি তুলে ধরে বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্র ইরানের ওপর ‘সর্বোচ্চ পর্যায়ের’ যে অর্থনৈতিক অবরোধ আরোপ করেছে, তা ইরানকে শুধু যে মধ্যপ্রাচ্যে প্রক্সি যুদ্ধ চালাতে বিরত রাখবে, তা-ই নয়, বরং এতে অর্থনৈতিক টানাটানির মধ্যে পড়ে দেশটির স্থিতিশীলতায় একটা বড় ধরনের ঝাঁকুনি তৈরি হবে।

খলিলজাদ বলেছেন, ওবামা প্রশাসন এই কায়দা অনুসরণ করে সুফল পেয়েছিল। নিষেধাজ্ঞার চাপে পড়ে ২০১৩ সালে ইরান আলোচনার টেবিলে বসতে বাধ্য হয়েছিল এবং প্রেসিডেন্ট হাসান রুহানির আমলেই ২০১৫ সালে ইরান একটি পারমাণবিক চুক্তিতে সই করেছিল। তবে এ যুক্তি এখনকার পরিস্থিতিতে মানানসই মনে হচ্ছে না। অবরোধ দিলে তেহরান আবার টেবিলে বসবে—এমন ধারণাকে ত্রুটিপূর্ণ বলে মনে হচ্ছে।

উত্তর কোরিয়ার নেতা কিম জং-উনের মতো আয়াতুল্লাহ আলী খামেনির যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে শাসনব্যবস্থার বৈধতা আদায়ের কোনো দরকার পড়ছে না। ফলে তাঁর জন্য ট্রাম্পের সঙ্গে মুখোমুখি আলোচনায় বসা এ মুহূর্তে জরুরি তো নয়ই, বরং এখন ট্রাম্পের সঙ্গে আলোচনায় বসলে খামেনিকে উল্টো বিপদে পড়তে হতে পারে। এতে দেশে ও দেশের বাইরে খামেনিকে বহু সমর্থক হারাতে হবে।

আয়াতুল্লাহ খামেনি সব সময়ই যুক্তরাষ্ট্র এবং যুক্তরাষ্ট্রের নীতির প্রতি সন্দেহ প্রকাশ করে এসেছেন। এমনকি ২০১৫ সালে চুক্তিতে সই করার পরও তিনি যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে নতুন চুক্তি যাতে না হয়, সে জন্য সব পথ বন্ধ করে রেখেছিলেন। ট্রাম্প চুক্তি থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পর খামেনি ওয়াশিংটনকে বিশ্বাস করা যায় না বলে এত দিন যে কথা বলে এসেছেন, তা জোরালোভাবে প্রমাণিত হয়েছে।

খামেনির রাজনৈতিক ভাবাদর্শ ও অবস্থানের কেন্দ্রবিন্দুতে আছে মার্কিন-বিরোধিতা। তিনি প্রথম থেকে বলে এসেছেন, ইরান থেকে ইসলামি প্রজাতন্ত্র উৎখাত করে তেহরানকে পদানত রাখা এবং এ অঞ্চলে উপনিবেশ গড়ে তোলার বিষয়ে পশ্চিমারা চক্রান্ত করে যাচ্ছে। এই ‘চক্রান্ত’ প্রতিহত করার অঙ্গীকারের মধ্যেই খামেনির রাজনীতির মূল শক্তি প্রোথিত। খামেনি তাঁর বক্তৃতায় সব সময়ই তথাকথিত ‘অ্যাক্সিস অব রেজিস্ট্যান্সে’র (প্রতিরোধকারী মিত্রশক্তি) দোহাই দিয়ে থাকেন। এই ‘মিত্রশক্তি’ বলতে তিনি পশ্চিমা আগ্রাসনবিরোধী দেশগুলোর ঐক্যবদ্ধ শক্তিকে বুঝিয়ে থাকেন। সেই মিত্রশক্তির মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের ঘোর বিরোধী ভেনেজুয়েলাও আছে।

যে ভাষ্যের ওপর খামেনির রাজনৈতিক অবস্থান দাঁড়িয়ে আছে, সেটি হলো ইসলামি বিপ্লবের পর থেকে এ পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্র ইরানের ‘আচরণ পরিবর্তন’ করার কথা বলে আসলে সরকারব্যবস্থা পরিবর্তনের চেষ্টা করে এসেছে। সেই যুক্তিতে খামেনি মনে করেন, যুক্তরাষ্ট্রের চোখরাঙানিতে একটু ছাড় দিলেই তারা আরও বড় ধরনের চাপ তৈরির সুযোগ খুঁজবে।

ধারণা করা হয়, আমেরিকান সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে ‘প্রতিরোধের মিত্রশক্তি’ গড়ে তোলার ধারণাই খামেনিকে ৩০ বছর এই পদমর্যাদায় টিকিয়ে রেখেছে। এখন তাঁর বয়স ৭৯ বছর। শরীরও ভেঙে পড়েছে। তিনি এখন এমন একটি উত্তরাধিকার রেখে যেতে চান, যার মাধ্যমে দীর্ঘদিন ইরানিরা তাঁকে শ্রদ্ধার চোখে দেখবে। তাঁর শাসনামলেই ইরানের পারমাণবিক কার্যক্রম দেশটিকে পারমাণবিক শক্তিধর দেশগুলোর ক্লাবে অন্তর্ভুক্ত করতে পারত; কিন্তু ২০১৫ সালে চুক্তি স্বাক্ষরের কারণে সেই সুযোগ খামেনির হাতছাড়া হয়ে যায়। তাঁর সামনে ‘আমেরিকা-বিরোধিতা’ ও ‘সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধিতার’ অ্যাজেন্ডা ছাড়া আর কোনো জুতসই উত্তরাধিকার (লিগ্যাসি) নেই। এ কারণে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের চাপে মাথা নত করে সমর্থকদের চোখে ছোট হতে চাইবেন না। বরং আমেরিকা-বিরোধিতাকে আরও জোরালো করে তিনি তাদের মধ্যে অমর হতে চান।

যুক্তরাষ্ট্র চুক্তি থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পর খামেনি এখন আগের চেয়ে বেশি জনসমর্থন পাচ্ছেন। আন্তর্জাতিক চাপের মধ্যে দশকের পর দশক টিকে থাকার জন্য ইরান ইতিপূর্বে যে নীতি অনুসরণ করে এসেছে, তা তিনি জারি রাখবেন। খামেনি ইতিমধ্যেই ‘প্রতিরোধমূলক অর্থনীতিতে’ ফিরে এসেছেন। এই নীতির আওতায় ইরান আমদানি কমিয়ে দিয়ে অভ্যন্তরীণ উৎপাদন বাড়াবে। আর রাজনৈতিকভাবে খামেনি ইতিমধ্যেই স্পষ্ট করে বলেছেন, ট্রাম্পের সঙ্গে সরাসরি বসার কোনো চিন্তা তাঁদের নেই। ইরানের যে নেতারা যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আলোচনায় বসা উচিত বলে বক্তব্য দিচ্ছেন, অধিকাংশ ইরানি তাঁদের পশ্চিমাদের দালাল বলে মনে করছেন। এ কারণে খামেনির পক্ষে ট্রাম্পের সঙ্গে বৈঠক করার কোনো সুযোগ নেই।

আল–জাজিরা থেকে নেওয়া। ইংরেজি থেকে অনূদিত

সাঈদ গোলকার টেনেসি ইউনিভার্সিটির রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক