যে জলে আগুন জ্বলে!!

ধরুন আপনার শরীরটা একটু খারাপ করেছে, আপনি নিজের ইচ্ছেমতো প্যারাসিটামল খাচ্ছেন সুস্থ হওয়ার জন্য। পরে পরীক্ষা–নিরীক্ষার পর দেখা গেল যে আপনার যকৃত বা লিভার হয়তো আগে কিছুটা খারাপ ছিল, কিন্তু ইচ্ছেমতো প্যারাসিটামল খাওয়ার কারণে পুরোপুরিই খারাপ হয়ে গেছে—কী অদ্ভুত একটা ট্র্যাজেডি!!
সম্প্রতি বনানী, লালবাগ, আর চকবাজারে ঘন ঘন অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা দেখে এই প্যারাসিটামল ট্র্যাজেডির কথাই কেন যেন মনে হচ্ছে।
- আচ্ছা সব আগুনই কি পানি দিয়ে নেভানো যায়?
- তাই তো দেখে এসেছি সব সময়। আর আগুন তো আগুনই!! তার আবার রকম কী!!!
সব আগুন আপাতদৃষ্টিতে দেখতে একরকম মনে হলেও পৃথিবীতে অগ্নি নিরাপত্তার মানদণ্ড স্থাপনকারী সংস্থাগুলো একে মোটামুটি ৫ ভাগে ভাগ করেছে (এ) কাঠ, কাগজ, কাপড়সহ অন্যান্য কার্বন যৌগ, (বি) তেল, রংসহ অন্যান্য দাহ্য রাসায়নিক তরল, (সি) দাহ্য গ্যাস, (ডি) ম্যাগনেসিয়াম, টাইটেনিয়ামসহ অন্যান্য ধাতব পদার্থ, (ই) বৈদ্যুতিক যন্ত্র বা যন্ত্রাংশ। অদ্ভুত ব্যাপার হলো এর মধ্যে (এ) শ্রেণি ব্যতীত আর কোনো শ্রেণির আগুনই সাধারণত পানিতে নেভে না। তার মানে হলো বৈদ্যুতিক শর্টসার্কিট থেকে যদি আগুন লাগে আর পানি দিয়ে সেই আগুন নেভানোর চেষ্টা করা হয়, তাহলে ওই বৈদ্যুতিক যন্ত্র বা যন্ত্রাংশ সম্পূর্ণভাবে পুড়ে শেষ হওয়ার আগে ওই আগুন তো নেভেই না বরং পানির মধ্য দিয়ে বিদ্যুৎ প্রবাহিত হয়ে আগুন আরও ছড়িয়ে পড়তে পারে বা তড়িতাহিত হয়ে মানুষেরও প্রাণহানি ঘটতে পারে।
সাধারণত বিভিন্ন ধরনের আগুন বা এর মিশ্রণের জন্য নির্দিষ্ট ধরনের অগ্নিনির্বাপণব্যবস্থা রাখতে হয়। খরচের দিক থেকে কার্যকরী এমন কোনো ব্যবস্থাই আসলে নেই যা একই সঙ্গে সব ধরনের আগুন নিয়ন্ত্রণ বা নির্বাপণ করতে পারে। এমতাবস্থায় প্রকৌশলগত দিক থেকে উপযুক্ত সমাধান হচ্ছে সব ধরনের পদার্থ যেন একসঙ্গে থাকতে না পারে তা নিশ্চিত করা আর মিশ্রণ থাকলে সেই অবস্থার উপযোগী একটা সমাধান বের করা। উদাহরণস্বরূপ যদি চকবাজারের অগ্নিকাণ্ডের কথা বলি, সেখানে একই সঙ্গে ৪ শ্রেণির আগুন ছিল (এ) মানুষ এবং সহায় সম্পদ, (বি) রাসায়নিক পদার্থ, (সি) সিএনজি, এলপিজি, (ই) বৈদ্যুতিক ট্রান্সফরমার, যন্ত্র আর তার। পানি দিয়ে তো তাৎক্ষণিক অগ্নিনির্বাপণ সম্ভব ছিলই না, অন্য কিছু দিয়েও আসলে কাজ হতো না, কারণ এই মিশ্রণের উপযুক্ত কোনো নির্বাপণব্যবস্থাই নেই।
যখন কোনো অগ্নি নিরাপত্তাব্যবস্থা নকশা বা স্থাপন করা হয়, তখন সেটা এমনভাবে করা হয় যেন (১) আগুন ধরার আগেই এর লক্ষণ টের পাওয়া যায়, (২) আগুন ধরে গেলে সঙ্গে সঙ্গেই জানা যায় এবং খুব অল্প সময়ের (বড়জোর কয়েক মিনিট) মধ্যেই নিভিয়ে ফেলা যায়, (৩) নেভানো না গেলেও সেই আগুন যেন একটা জায়গাতে আবদ্ধ থাকে, ছড়িয়ে না পড়ে সেই ব্যবস্থা করা যায়। এর কোনোটাই যখন ঠিকভাবে হয় না, তার মানে হলো ওই অগ্নি নিরাপত্তা বা নির্বাপণব্যবস্থা প্রায় বা সম্পূর্ণ ব্যর্থ।
একটা স্থাপনার নিজস্ব উপযুক্ত অগ্নিনিরাপত্তাব্যবস্থা না থাকলে বা সে ব্যাপারে আমরা যাঁরা ব্যবহারকারী তাঁদের প্রায়োগিক জ্ঞান না থাকলে আসলে ফায়ার ব্রিগেডের পক্ষে ভালো কোনো ফলাফল দেওয়া কখনোই সম্ভব নয়। আমাদের মাথায় রাখতে হবে, ফায়ার ব্রিগেড কখনোই প্রাথমিক অগ্নিনির্বাপণব্যবস্থা হওয়া উচিত নয়। ফায়ার ব্রিগেড ঘটনাস্থলে আসতে যে ন্যূনতম সময় নেয়, সেই সময়ে আগুন যেভাবে ছড়িয়ে পড়ে, বিশেষত বৈদ্যুতিক যন্ত্র বা যন্ত্রাংশ আক্রান্ত করে, তাতে হয়তো অগ্নিনির্বাপণব্যবস্থার সমাধান ফায়ার ব্রিগেড শুধু পানি দিয়ে দিতে পারবে না।
বাংলাদেশ ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের প্রদেয় পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০১৮ সালে সারা দেশের মোট ১৯ হাজার ৬৪২টি অগ্নিকাণ্ডের মূল কারণের মধ্যে ৪৩ শতাংশই সরাসরি বিদ্যুৎ (ই) শ্রেণির আর ১৮ শতাংশ হচ্ছে সরাসরি গ্যাস (সি) শ্রেণির। এর মানে হলো ৬১ শতাংশ ক্ষেত্রে আগুনের শুরুটাই পানি দিয়ে নেভানোর উপযোগী নয়। আর বাংলাদেশের বাস্তবতায় যেকোনোভাবে আগুন ছড়ানো মানেই হলো বৈদ্যুতিক যন্ত্র, যন্ত্রাংশ বা তারে অথবা চুলার গ্যাসে ছড়িয়ে পড়া। তাহলে এই মিশ্র শ্রেণির আগুনের জন্য আমরা আদৌ প্রস্তুত আছি কি?
আমাদের স্থাপনাগুলোতে আমরা অনেক সময়ই বহনযোগ্য অগ্নিনির্বাপক সিলিন্ডার দেখে থাকি। এমন স্থাপনাগুলোতে অনেক ক্ষেত্রেই স্থায়ী এবং স্বয়ংক্রিয় অগ্নিনির্বাপণব্যবস্থা না থাকলেও আমরা ধরে নিই যে উপযুক্ত প্রশিক্ষণ দিয়ে বাসিন্দাদের এমনভাবে গড়ে তুলব যে আগুন জ্বলার সঙ্গে সঙ্গে আগুনের ধরন বুঝে উপযুক্ত নির্বাপক দিয়েই আগুন নিভিয়ে ফেলব। খুব ইতিবাচক ভাবনা হলেও সমস্যাটা হচ্ছে এর সাফল্য সম্পূর্ণভাবে নির্ভর করে আগুন দেখতে পাওয়ার ওপর। যদি মানুষ টের না পায় বা মানুষের অনুপস্থিতিতে আগুন ধরে যায়, এই পদ্ধতি যে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হতে পারে তা বলাই বাহুল্য। এসব ক্ষেত্রে আগুনকে একটা জায়গায় আবদ্ধ রাখার জন্য অগ্নিপ্রতিরোধক দরজা ব্যবহার করা হয়। বর্তমানে বহু প্রতিষ্ঠানেই লাল রঙের এ ধরনের দরজা দেখা যায়, যা বেশ প্রশংসনীয়। তবে দুঃখজনক ব্যাপার হচ্ছে জানালা বা ভেন্টিলেশনের জায়গাগুলোতে অনেক ক্ষেত্রেই অগ্নিপ্রতিরোধক কোনো ব্যবস্থা থাকে না, এ যেন বজ্র আঁটুনি, ফসকা গেরো! অগ্নিপ্রতিরোধক না হলে আগুন জানালা বা ভেন্টিলেশন দিয়েও ছড়িয়ে পড়তে পারে। সে ক্ষেত্রে মহামূল্য অগ্নিপ্রতিরোধক দরজা সাদা হাতি ছাড়া আর কিছু না।
আমাদের দেশের অনেক নামীদামি প্রতিষ্ঠানের অনেক নামীদামি স্থাপনাতেই দুর্ভাগ্যজনকভাবে ভাবনার এমন অসম্পূর্ণতা দেখতে পেয়েছি। উপযুক্ত অগ্নি শনাক্তকরণ ও নির্বাপণব্যবস্থা, বাসিন্দাদের উপযুক্ত প্রশিক্ষণ আর আগুন ছড়ালেও এক জায়গাতে আবদ্ধ রাখার যে প্রক্রিয়া, সব মিলিয়ে এই পরিপূর্ণ ব্যবস্থার দেখা পাওয়া দুর্লভ বৈকি! সব যেন কোনো রকমে ‘কমপ্লায়েন্স’ সনদ পাওয়ার মধ্যে আটকে আছে, আগুন কবে ধরবে না ধরবে, বা আদৌ ধরবে কি না, সেই জন্য কিছু করা যেন বড্ড বাজে খরচ।
উপযুক্ত অগ্নিনিরাপত্তার ব্যবস্থা করা অবশ্যই কিছুটা ব্যয়সাপেক্ষ, কিন্তু অসম্পূর্ণ নিরাপত্তাব্যবস্থা বা নিরাপত্তার অভাব যে ক্ষতির সৃষ্টি করে, তা কি আদৌ অর্থ দিয়ে মূল্যায়ন করা সম্ভব! আর যে ক্ষতি আর্থিক মূল্য দিয়ে বিবেচনা করা যাচ্ছে, সেই তুলনায় উপযুক্ত অগ্নিনিরাপত্তা কি খুব বেশি ব্যয়বহুল ছিল! ক্ষতিগ্রস্তরাই হয়তো এর উত্তর আরও ভালোভাবে দিতে পারবেন।
উপযুক্ত অগ্নিনিরাপত্তাব্যবস্থা ব্যয়বহুল নয়, বরং নিরাপত্তার অভাবই বহুগুণ বেশি ব্যয়বহুল!
(মোহাম্মদ তানভীর হোসাইন, অগ্নিনিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ, প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা, রিএকট্রন বাংলাদেশ প্রাইভেট লিমিটেড)