যে দেশে সেতুতে উঠতে নৌকা ও মই লাগে

ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ভেঙে পড়ার আগে ২২ বছরেও ব্যবহৃত না হওয়া সেতু

ঘটনা খুবই সামান্য। একটা সেতু ভেঙে পড়েছে নৌকার আঘাতে। তাতে কারও কোনো ক্ষতি হয়নি। কারণ, এই সেতুটা ছিল একটা জলাশয়ের মাঝখানে। সেটা ছিল পানি থেকে বেশ উঁচুতে। দুই পারের ডাঙা থেকে অনেক দূরে। সেটার সঙ্গে সংযোগ স্থাপনের জন্য কোনো সড়ক দুই পাড়ের কোথাও ছিল না। একটা জলাশয়ের মধ্যে একটা বকের মতো এই সেতুটা দাঁড়িয়ে ছিল। ২২ বছর সেতুটার কোনো ব্যবহার হয়নি। তারপর একটা নৌকা ধাক্কা দিলে সেতুটা ভেঙে পড়ে যায়। সেতুর অবস্থান ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়া উপজেলার ধরখার ইউনিয়নে। বনগজ ও কৃষ্ণনগর গ্রামের মধ্যবর্তী নয়াখালের ওপর সেতুটি নির্মাণ করা হলেও সেটা কোনো কাজে আসেনি। (প্রথম আলো ৩ সেপ্টেম্বর ২০২১।)

এই খবরে কারও ঘুমে ব্যাঘাত ঘটেনি, কপালে ভাঁজও পড়েনি সামান্য। পড়ার কথা নয়। ২০১৬ সালের ৩ নভেম্বর প্রথম আলোয় আমরা পড়েছি, পৌনে তিন হাজার সেতু কোনো কাজে লাগছে না। অনেক সেতুর নির্মাণকাজ যুগের পর যুগ অর্ধসমাপ্ত পড়ে আছে, বহু ঠিকাদার পলাতক। কোথাও সেতু আছে, সংযোগ সড়ক নেই, সেতুতে উঠতে গেলে নৌকা লাগে, মই লাগে। কোথাও-বা সেতু আছে, নদী নেই, সেতুর পাশ দিয়ে সড়ক চলে গেছে স্বচ্ছন্দে! এই পৌনে তিন হাজার সেতুর প্রতিটির জন্য এক কোটি টাকা খরচ হলেও পৌনে তিন হাজার কোটি টাকা খরচ হয়েছে, ১০ কোটি টাকা খরচ ধরলে ২৭ হাজার কোটি টাকা খরচ হয়েছে। খরচ তো খরচই, রাস্তাঘাট, জলাশয়, জনপদ, পরিবেশের ওপরে চাপটা কত পড়েছে ভাবুন, কত ভারী ভারী ট্রাক গেছে, কত গাছ আর মাটিকে পুড়তে হয়েছে ইট হওয়ার জন্য, কত আবর্জনা জমেছে!

একটা প্রয়োজনীয় প্রকল্প সুন্দরভাবে শেষ করার পেছনে একটা লোক বিশ টাকার জায়গায় বাইশ টাকা খরচ করলে তবু নিজেকে প্রবোধ দিতে পারি, কিন্তু সম্পূর্ণ অপ্রয়োজনীয় একটা প্রকল্প বিশ টাকার জায়গায় বিশ হাজার টাকা খরচ করে মাঝপথে পরিত্যক্ত করে যদি কেউ সটকে পড়ে, তখন আর কোনো সান্ত্বনা পাওয়া যায় না

আরেকটা খবর ও তার ছবিগুলো দেখে রীতিমতো কান্না আসে। নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লার খান সাহেব ওসমান আলী স্টেডিয়ামের ছবি প্রকাশিত হয়েছে প্রথম আলোয় ৭ সেপ্টেম্বর ২০২১-এ। আমি নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছি না। এটা কি স্টেডিয়াম, নাকি হাওর এলাকা! আউটার স্টেডিয়ামে দীর্ঘদিনের জমানো পানিতে কচুরিপানা স্থায়ী বাসা বেঁধেছে। পুরো স্টেডিয়ামটা এখন পরিত্যক্ত ভুতুড়ে জলাশয়ে পরিণত! আমি নিজে একজন প্রকৌশলী, আপনারা বিশ্বাস করবেন, আমি একটা রাত ঘুমোতে পারিনি! একটা প্রকল্প হবে, তার আগে সম্ভাব্যতা যাচাই হবে না? আশপাশের জমির চেয়ে নিচু জমিতে এই ধরনের প্রকল্পের প্ল্যান করতে পারলেন কোন প্রকৌশলীরা? এটা তো একেবারে গোড়াতেই গলদ এবং অবশ্যই প্রাথমিকভাবে এটা একটা ইঞ্জিনিয়ারিং ত্রুটি। প্রকৌশলীরা বলবেন, সিদ্ধান্ত এসেছে রাজনৈতিকভাবে। বলা হয়েছে, এখানে স্টেডিয়াম হবে। বটে, তাহলে আপনি প্রকৌশলী, আপনি বলবেন না যে এই নিচু জমিতে স্টেডিয়াম হলে এটায় রাজ্যের পানি এসে জমবে, এখানে তেলাপিয়া মাছের চাষ করা যাবে, আরেকটু এগিয়ে কুমির চাষেরও উদ্যোগ নেওয়া যাবে!

প্রথম আলোর ৫ সেপ্টেম্বর ২০২১-এর খবর: পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্রে সঞ্চালন লাইন পুরোপুরি চালু না হওয়ায় প্রতি মাসে বাংলাদেশ-চায়না পাওয়ার কোম্পানিকে ১০০ কোটি টাকা ভর্তুকি দিতে হচ্ছে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডকে। ঠিকাদার ঠিক সময়ে সঞ্চালন লাইন বানিয়ে দিতে পারেননি। এই সঞ্চালন লাইন আগামী বছর চালু হবে বলে আশা আছে। ১২টা মাস দেরি হলে ১ হাজার ২০০ কোটি টাকা লোকসান হবে বাংলার জনগণের। কী এমন! এর চেয়েও ভয়াবহ খবর পড়েছিলাম, শতকোটি টাকা খরচ করে ট্রান্সফরমার কেন্দ্র বসানো হয়েছে, কিন্তু সেখানে নিয়ে যাওয়ার মতো কোনো বিদ্যুৎ নেই, সংযোগ লাইন নেই, বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র নেই। সঞ্চালন কেন্দ্র নির্মাণের প্রকল্প শেষ!

আমরা হাজার কোটি টাকা খরচ করে ফ্লাইওভার বানানোর পর বুঝেছি, এই ফ্লাইওভারের কোনো প্রয়োজন ছিল না, যানবাহন এটাতে ওঠে না, নিচ দিয়েই চলাচল করে। বাংলাদেশে অসমাপ্ত সেতুর মতো, অপ্রয়োজনীয় সঞ্চালন কেন্দ্রের মতো অগণিত প্রকল্প হচ্ছে, যা করা হচ্ছে শুধু প্রকল্প করার জন্য। সেই প্রকল্প কেন, করলে কার লাভ হবে, স্থাপনা নির্মাণের পর সেটা চালাবে কে, কর্তৃপক্ষ কে, কর্মকর্তা-কর্মচারী কে, উপকারভোগী কে, সেগুলো চালানোর জন্য যে বার্ষিক বাজেট দরকার তা আসবে কোত্থেকে, এসব ঠিক না করেই কাজ শুরু করে দেওয়া হচ্ছে। পৌনে তিন হাজার সেতুর মতো হাজার হাজার স্থাপনা আর কাঠামো পড়ে আছে। যেমন পড়ে আছে হাসপাতালের নামে আনা দামি দামি যন্ত্রপাতি। বিমানবন্দর থেকে সেসব যন্ত্রপাতি ছাড়িয়ে আনারও দরকার পড়ছে না।

কোম্পানি কা মাল, দরিয়া মে ঢাল। আমাদের সরকারি টাকা আমাদের, জনগণের। ঋণ করে যদি টাকা আনা হয়, সে ঋণের বোঝা দেশের গরিব মানুষের পিঠেই চাপে। একটা বিড়ি খেলেও গরিব মানুষকে ভ্যাট-ট্যাক্স দিতে হয়, সিনেমা দেখতে গেলেও। সেই টাকা কোন দরিয়ায় ঢালা হয়! শুধু প্রকল্প করো, মেগা প্রকল্প হলে মেগা লাভ, কিন্তু সেই প্রকল্প থেকে দেশের কী লাভ হচ্ছে, মানুষের কী লাভ হচ্ছে, কে দেখবে?

নৌকার আঘাতে ভেঙে যাওয়া সেতু। নির্মাণের পর গত ২২ বছরে একবারও ব্যবহৃত হয়নি সেতুটি। কারণ, এটির সঙ্গে কোনো সংযোগ রাস্তা ছিল না। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়া
ছবি: প্রথম আলো

এক টাকার প্রকল্পও যদি অপ্রয়োজনীয় হয়, তার জন্য জবাব দিতে হবে। অপ্রয়োজনীয় ব্যয়ের জন্য দায়ী ব্যক্তিদের ধরতে হবে। একটা অপ্রয়োজনীয় সেতু, অপ্রয়োজনীয় ফ্লাইওভার, অপ্রয়োজনীয় সঞ্চালন কেন্দ্র, অপ্রয়োজনীয় বিদ্যুৎকেন্দ্র, অপ্রয়োজনীয় বা কাজে লাগছে না এমন স্থাপনার পেছনে শুধু যে টাকা খরচ হয় তা তো নয়, সোনার চেয়ে দামি জমি নষ্ট হয়, বাংলার আকাশ-বাতাস-মাটি-নদীকে এই সব প্রকল্প বা স্থাপনার জন্য মূল্য দিতে হয়, প্রশাসনকে মূল্যবান শ্রমঘণ্টা বিনিয়োগ করতে হয়, জনগণকে বছরের পর বছর দুর্বিষহ দুর্ভোগ পোহাতে হয়। প্রকল্প শেষ হওয়ার পর জনগণ যদি বলে এই ফ্লাইওভার তো আমাদের কাজে লাগছে না, সেতুগুলো যদি খালে-বিলে-নদীতে সংযোগ সড়কবিহীন অবস্থায় একা একা কাঁদে, তাহলে এই প্রকল্পের সিদ্ধান্ত যাঁরা দিয়েছেন, যাঁরা সম্ভাব্যতা যাচাই করেছেন, যাঁরা প্রকল্প পরিচালক ছিলেন, তাঁদের সবাইকে জবাব দিতে হবে।

শুধু কোটি কোটি টাকা নয়ছয় করে শ্যালিকা, দুলাভাই, শ্বশুর-শাশুড়ির নামে রাখবেন, জমিজমা কিনবেন, বিদেশে পাচার করবেন, নাতির খতনায় কোটি কোটি টাকা খরচ করবেন আর জবাব দেবেন না, তা তো হবে না! স্টেডিয়াম বানালে খেলা হতে হবে, সংস্কৃতি কেন্দ্র বানালে সংস্কৃতির চর্চা হতে হবে, লাইব্রেরি বানালে বই থাকতে হবে এবং পাঠক থাকতে হবে, রাস্তা বানালে সেটা মানুষের কাজে লাগতে হবে, সেতু বানালে সেটার ওপর দিয়ে নিয়মিত যানবাহনের চলাচল থাকতে হবে, সঞ্চালন কেন্দ্র বানালে সংযোগ থাকতে হবে। যেখানে যেখানে এর ব্যত্যয় ঘটবে, সেখানেই ব্যবস্থা নিতে হবে। নজরদারি ছাড়া নয়ছয় হবেই। শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া না হলে এ রকমটা হতেই থাকবে।

আমরা যেমন ফল-ফসল-মাছ-ডিম-দুধ উৎপাদনে রেকর্ড করছি, তেমনি আমরা রেকর্ড করছি দুর্নীতিবাজ উৎপাদনে। এই দেশে সড়ক বানানোর প্রতি মাইলের খরচ পৃথিবীর মধ্যে সবচেয়ে বেশি। এই দেশ থেকে বিদেশে টাকা পাচার হয় সবচেয়ে বেশি। চুরি যে হয় সেটা আমরা জানি। একটা প্রয়োজনীয় প্রকল্প সুন্দরভাবে শেষ করার পেছনে একটা লোক বিশ টাকার জায়গায় বাইশ টাকা খরচ করলে তবু নিজেকে প্রবোধ দিতে পারি, কিন্তু সম্পূর্ণ অপ্রয়োজনীয় একটা প্রকল্প বিশ টাকার জায়গায় বিশ হাজার টাকা খরচ করে মাঝপথে পরিত্যক্ত করে যদি কেউ সটকে পড়ে, তখন আর কোনো সান্ত্বনা পাওয়া যায় না। মনে হয়, বাবা, তুমি পুরো টাকাটাই চুরি করতা, এই অর্ধেক প্রকল্প করে আমার দেশের মাটি, পানি, আকাশ, বাতাস নষ্ট করে রাখলে কেন? পৌনে তিন হাজার অসমাপ্ত সেতু আমাদের বুকে পৌনে তিন হাজার ছুরিকাঘাত করে।

এই আঘাত কি আমাদের নীতিনির্ধারকদের মনে একটুও রেখাপাত করে না? কেন তাঁরা ভ্রুক্ষেপ করবেন না! একটা জাতীয় কমিশন গঠন করুন। অসমাপ্ত, অর্ধসমাপ্ত, মাঝপথে পরিত্যক্ত, অপ্রয়োজনীয় প্রকল্পগুলো নিয়ে তদন্ত হোক। শ্বেতপত্র প্রকাশ করা হোক। এই ভয়াবহ মারি থেকে বাংলাদেশকে রক্ষা করতেই হবে।


আনিসুল হকপ্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক ও সাহিত্যিক