যৌতুক: আইনের সংস্কারেই কাজ শেষ?

দেশ থেকে যৌতুকপ্রথা দূর করতে বাংলাদেশের সরকার ১৯৮০ সালে যৌতুক নিরোধ আইন প্রণয়ন করেছিল। ওই আইনে বলা হয়েছিল, যৌতুক গ্রহণকারী ও যৌতুক প্রদানকারী উভয়ই সমান অপরাধী। তারা উভয়েই সর্বোচ্চ এক বছর মেয়াদের কারাদণ্ড বা সর্বোচ্চ পাঁচ হাজার টাকা জরিমানা অথবা উভয় প্রকার দণ্ডে দণ্ডিত হবেন।
৩৮ বছর আগে আইনটি প্রণীত হলেও এ আইনের প্রয়োগ খুব একটা দেখা যায়নি। বরং আইনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে যৌতুক আদান-প্রদান হয়েছে দেদার। বরপক্ষের চাহিদা অনুযায়ী কনেপক্ষ যৌতুক দিয়েই গেছে। আর যৌতুক না দেওয়ায় কত নারী যে নির্যাতনের শিকার হয়েছেন, কত নারীর সংসার ভেঙেছে, আর কত নারী যে খুন হয়েছেন, তার কোনো সঠিক পরিসংখ্যান নেই। কিন্তু যৌতুক চাওয়ার জন্য কারও শাস্তি হয়েছে—এমনটা খুব কমই দেখা গেছে।
সরকার সম্প্রতি যৌতুক আদান-প্রদান প্রতিরোধে ১৯৮০ সালের আইনটি সংস্কারের উদ্যোগ নেয়। গত মে মাসে মন্ত্রিসভা ‘যৌতুক নিরোধ আইন ২০১৮’-এর খসড়ার চূড়ান্ত অনুমোদন দেয়। নতুন আইনে শাস্তির মেয়াদ ও জরিমানার পরিমাণ দুটিই বাড়ানো হয়েছে। নতুন আইনে বলা হয়েছে, কেউ যৌতুক দাবি করলে তিনি পাঁচ বছরের জেল বা ৫০ হাজার টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন। আইনের পাঁচ নম্বর ধারায় বলা হয়েছে, কাউকে ক্ষতিগ্রস্ত করার জন্য কেউ যদি যৌতুকসংক্রান্ত মিথ্যা মামলা দায়ের করেন, তাঁরও সর্বোচ্চ পাঁচ বছরের জেল থেকে সর্বনিম্ন এক বছরের জেল বা ৫০ হাজার টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন। এই আইনের অধীনে সংঘটিত অপরাধ আমলযোগ্য ও জামিন অযোগ্য হবে; তবে আপসযোগ্য হবে।
সরকারের আইন সংস্কারের এই উদ্যোগকে আমরা ধন্যবাদ জানাই। আইনের সংস্কার তো হলো। কিন্তু এ আইনের প্রয়োগ হবে কি? নাকি আগের মতোই অকার্যকর থেকে যাবে?
আমার এ রকম প্রশ্নের পেছনে বড় কারণ হলো, যৌতুক আদান-প্রদানের বিষয়টি সমাজে ব্যাপকভাবে স্বীকৃত এবং বেশির ভাগ মানুষই আর এটাকে অপরাধ বলে মনে করে না। আমাদের সমাজে বিয়েশাদিতে যৌতুক দেওয়াটা এক অলিখিত নিয়মে পরিণত হয়েছে। অনেকে যৌতুক পাওয়াটাকে পুরুষের অধিকার বলে মনে করেন। কোনো পুরুষ যখন শ্বশুরবাড়ি থেকে যথেষ্ট যৌতুক পান না, তখন তাঁকে নানা কথা শুনতে হয়। তুলনা করা হয় অন্যদের সঙ্গে, যাঁরা কিনা এর চেয়ে বেশি যৌতুক পেয়েছেন। বিয়ের সময় ছেলেপক্ষকে যৌতুক দেওয়া হবে—এটাই এখন স্বাভাবিক ঘটনা। বরং যৌতুক না দেওয়াটাই এখন বড় অপরাধ। মেয়ের বাবার সামর্থ্য থাকুক আর নাই থাকুক, যৌতুক দিতেই হবে। নিজের না থাকলেও ধারদেনা করে হলেও দিতে হবে। আর এভাবে যৌতুক দিতে গিয়ে কত পরিবার যে সর্বস্বান্ত হয়েছে, তার কোনো ইয়ত্তা নেই।
যৌতুকের তালিকায় কী থাকে না! নগদ অর্থ, জমি, বাড়ি, গাড়ি, মোটরসাইকেল, টেলিভিশন, ফ্রিজ, খাট, আলমারি, ড্রেসিং টেবিল, ডাইনিং টেবিল, ওয়ার্ডরোবসহ আরও অনেক কিছু থাকে। মেয়ে সুখে থাকবে—এই আশায় মা-বাবাসহ অভিভাবকেরা এসব যৌতুক দেন। দেখা যাচ্ছে, বিয়ে করাটা ছেলেদের জন্য বিরাট লাভজনক একটি ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু এর মধ্য দিয়ে তাঁরা যে নিজেদের অসম্মানিত করছেন, তা কি তাঁরা বুঝতে পারেন? তাঁদের কি কখনো অনুধাবন হয় না যে তাঁরা যৌতুক চেয়ে বা নিয়ে নিজেদের কত ছোট করে ফেলছেন?
অনেকে যৌতুককে ভবিষ্যতের রক্ষাকবচ হিসেবে দেখে থাকে। আমার পরিচিত এক শিক্ষিত তরুণকে এ রকম পরিকল্পনা করতে দেখা গেছে যে বিয়ের সময় যৌতুক হিসেবে যা পাবেন, সেটা দিয়েই নিজের কর্মসংস্থানের একটা ব্যবস্থা করে ফেলবেন। সুতরাং কষ্ট করে চাকরি খোঁজার তাঁর কোনো প্রয়োজন নেই। অনেক অভিভাবকে দেখেছি ছেলেদের তেমন পরামর্শই দেন। আর মেয়ের অভিভাবকরাও অনেক আগে থেকে মেয়ের বিয়েতে যৌতুক নেওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিতে থাকেন। যেমন: মেয়ের জন্মের সঙ্গে সঙ্গেই অনেকে নতুন ব্যাংক হিসাব খোলেন, জমি কেনেন, গাছ লাগান অথবা কিছু গরু কিনে রাখেন।
এসব থেকে বোঝা যায়, যৌতুকের বিষয়টি আমাদের সমাজের কত গভীরে শিকড় গেড়ে আছে। শুধু আইনের সংস্কার করে সমাজ থেকে যৌতুকপ্রথা দূর করা যাবে না; এ জন্য সামাজিক সচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে। সবাইকে বোঝাতে হবে যৌতুক নেওয়া কোনো সম্মানজনক বিষয় নয়। বরং এটা খুবই লজ্জার একটি বিষয় এবং অপরাধও বটে। মেয়েদের এবং তাঁদের অভিভাবকদের উদ্দেশে বলতে চাই, যেসব পুরুষ বিয়েতে যৌতুক চান, তাঁরা আর যা-ই হোক, কখনোই ভালো মানুষ নন। তাঁদের প্রত্যাখ্যান করুন। সবাই যদি একযোগে রুখে দাঁড়ায়, দেশ থেকে ঠিকই একদিন যৌতুকপ্রথা দূর হয়ে যাবে। আসুন সবাই শপথ নিই, ‘যৌতুক নেব না, দেবও না’।
রোকেয়া রহমান: সাংবাদিক