রক্তস্নাত মুক্তিযুদ্ধে আবেদ

মুক্তিযুদ্ধকালে লন্ডনে ‘হেল্প বাংলাদেশ–এর শোভাযাত্রায় স্যার ফজলে হাসান আবেদ,  শাড়ি পরিহিত নারীটির পেছনে।
মুক্তিযুদ্ধকালে লন্ডনে ‘হেল্প বাংলাদেশ–এর শোভাযাত্রায় স্যার ফজলে হাসান আবেদ, শাড়ি পরিহিত নারীটির পেছনে।

২৫ মার্চের আকস্মিক আক্রমণে ঢাকার সঙ্গে চট্টগ্রামের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল। ফজলে হাসান আবেদ ঢাকায় এসে পৌঁছানোর চেষ্টা করছিলেন। দু-তিন দিন ধরে চেষ্টা চালানোর পর তিনি তাঁর কর্মস্থল চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় আসতে সক্ষম হলেন।

মে মাসের প্রথম দিকে তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন, পালিয়ে ইংল্যান্ডে চলে যাবেন। সেখানে গিয়ে মুক্তিযুদ্ধে সহায়তার জন্য গড়ে তুলবেন সংগঠন। প্রথমে পাকিস্তান, পরে আফগানিস্তান হয়ে ইংল্যান্ডে যাওয়ার পরিকল্পনা করলেন ফজলে হাসান আবেদ। পরিকল্পনামতো ঢাকা থেকে বিমানযোগে করাচি এসে পৌঁছালেন তিনি। করাচিতে কয়েক দিন থেকে তিনি গেলেন ইসলামাবাদ।

ইসলামাবাদে পাকিস্তান গোয়েন্দা বাহিনীর হাতে গ্রেপ্তার হলেন ফজলে হাসান আবেদ। অভিযোগ, তিনি ঢাকার অফিসে কাউকে কিছু না বলে পালিয়ে এসেছেন। আইএসআইয়ের লোকেরা আবেদকে তাদের এক কর্নেলের কাছে নিয়ে গেল। চলল বিস্তর জিজ্ঞাসাবাদ। কোনো অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়ায় দুদিন পরে তিনি মুক্তি পেলেন।

পূর্বপরিকল্পনামতো আফগানিস্তানের উদ্দেশে ইসলামাবাদ ত্যাগ করলেন। প্রথমে ট্যাক্সি করে পেশোয়ার। সেখানে একটি হোটেলে রাতযাপনের পর সকালবেলা খাইবার পাসের বাস ধরে চেকপোস্ট পেরিয়ে প্রবেশ করলেন আফগানিস্তানে। এরপর আবারও বাসে করে জালালাবাদ—সেখান থেকে দীর্ঘ, ঝুঁকিপূর্ণ পথ পেরিয়ে কাবুল। শেষে কাবুল থেকে লন্ডন।

মুক্তিযুদ্ধের উত্তাল তরঙ্গমালা তত দিনে দেশের সীমানা অতিক্রম করে বহির্বিশ্বে আছড়ে পড়েছে। লন্ডনেও ছড়িয়ে পড়েছে তার ঢেউ। সেখানে পৌঁছে আবেদ তাঁর বন্ধুদের সঙ্গে মিলে গঠন করলেন একটি সংগঠন, ‘অ্যাকশন বাংলাদেশ’। এই সংগঠন মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে নানামুখী তত্পরতা পরিচালনা করেছিল। আবেদ ও তাঁর সহযোগী বন্ধুরা যথার্থই উপলব্ধি করেছিলেন, পাকিস্তানি বাহিনীর বর্বর হামলা ও নির্বিচার গণহত্যা, পাশবিক নির্যাতন, অগ্নিসংযোগ, খুন, ধর্ষণ সম্পর্কে বিশ্ববাসীকে অবগত করা প্রয়োজন। এর ফলে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে বিশ্বব্যাপী জনমত গঠিত হবে এবং পৃথিবীর নানা দেশ থেকে সাহায্য-সহযোগিতার হাত প্রসারিত হবে। প্রথমেই লন্ডন টাইমস পত্রিকায় একটি বৃহদাকার বিজ্ঞাপন প্রকাশ করলেন তাঁরা। বিজ্ঞাপনের ভাষ্য ছিল: বাংলাদেশে নৃশংস গণহত্যা চালানো হচ্ছে। এই গণহত্যা বন্ধ করার জন্য বিশ্ববাসী এবং জাতিসংঘকে কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে। এরপর তাঁরা ব্রিটিশ এমপিদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে তাঁদের কাছে বাংলাদেশের ভয়াবহ পরিস্থিতি এবং অমানবিক নৃশংসতা তুলে ধরলেন। পার্লামেন্ট অধিবেশনে বাংলাদেশ প্রসঙ্গটি উত্থাপন করার জন্যও দেনদরবার চলল। শুধু ইংল্যান্ডেই নয়, পার্শ্ববর্তী দেশগুলোতে গিয়ে সে দেশের জনমতকে প্রভাবিত করার জন্য নানামুখী প্রচারমূলক তত্পরতা চালালেন তাঁরা। বিভিন্ন গণমাধ্যম, বিশেষত রেডিও-টেলিভিশনে সাক্ষাত্কার প্রদান করে তাঁরা পাকিস্তানিদের নৃশংস কর্মকাণ্ডের বিবরণ তুলে ধরলেন।

>

ফারুক চৌধুরী, সুবলকুমার বণিক ও সাজেদুর রহমান রচিত ‘ব্র্যাক: উন্নয়নের একটি উপাখ্যান’ বইয়ের একটি অধ্যায়ের সংক্ষেপিত অংশ

ফজলে হাসান আবেদ প্রথম টেলিভিশন সাক্ষাত্কার দিয়েছিলেন কোপেনহেগেনে। তাতে বাংলাদেশের স্বাধীনতাসংগ্রামের পূর্বাপর ইতিবৃত্ত ব্যাখ্যা করেছিলেন তিনি। বিভিন্ন মিডিয়ায় প্রচারিত সাক্ষাত্কারগুলো ইউরোপের দেশগুলোতে জনমত গঠনে ইতিবাচক ভূমিকা রেখেছিল।

অ্যাকশন বাংলাদেশের কর্মকাণ্ড মূলত ইংল্যান্ডে পরিচালিত হচ্ছিল। আগস্ট মাসে নিউজউইক-এ বাংলাদেশ সম্পর্কে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে এই আশঙ্কা করা হয়েছিল, আমন ধানের ফলন মার খাওয়ায় দেশের অভ্যন্তরে খাদ্যসংকট দেখা দিতে পারে। অ্যাকশন বাংলাদেশ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করল, তাদের কার্যক্রম কেবল প্রচারমূলক তত্পরতায় সীমাবদ্ধ রাখলে চলবে না; মুক্তাঞ্চল, বিশেষত সীমান্ত এলাকাগুলোতে সাহায্য পাঠানোর মাধ্যমে কার্যক্রমের বিস্তার ঘটাতে হবে। এ জন্য নতুন একটি সংগঠন গড়ে তোলা হলো। এর নাম হলো ‘হেল্প বাংলাদেশ’। সত্তরের ঘূর্ণি-উপদ্রুত উপকূল অঞ্চলের দুর্গত মানুষের সেবায় আবেদ এবং তাঁর সহযোগীরা যে সংগঠনটি গড়ে তুলেছিলেন, তার নাম ছিল ‘হেল্প’। এবার সেই নামটিই আরেকটু সম্প্রসারিত হয়ে হলো ‘হেল্প বাংলাদেশ’। ‘হেল্প বাংলাদেশ’-এর পক্ষ থেকে দেশের মুক্তাঞ্চলগুলোতে অভাবী মানুষের কাছে খাদ্য পাঠানোর পরিকল্পনা করা হলো। সিদ্ধান্ত হলো, বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী ভারতীয় এলাকায় খাদ্যগুদাম তৈরি করে সেখান থেকে খাদ্যসামগ্রী সরবরাহ করা হবে। এ জন্য ভারত সরকারের অনুমতির প্রয়োজন ছিল। অনুমতি সংগ্রহের লক্ষ্যে তাঁরা বিভিন্ন পর্যায়ে প্রচেষ্টা চালাতে লাগলেন।

একই সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধে আরও প্রত্যক্ষ অবদান রাখার জন্য তাঁরা সচেষ্ট হলেন। ভাড়াটে যোদ্ধাদের মাধ্যমে পাকিস্তানের একটি সমুদ্রবন্দরে নাশকতামূলক বোমা বিস্ফোরণ ঘটিয়ে বিশ্বব্যাপী চাঞ্চল্য সৃষ্টির পরিকল্পনা করা হলো। এ জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ ১৬ হাজার ৮০০ পাউন্ড সংগৃহীত হলো। কিন্তু এ ধরনের একটি ব্যয়বহুল কাজ করা সংগত হবে কি না, সে বিষয়ে তাঁরা দ্বিধা কাটিয়ে উঠতে পারছিলেন না। প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে এই পরিকল্পনা নিয়ে আলোচনা করার জন্য ফজলে হাসান আবেদ ও ভিকারুল ইসলাম চৌধুরী সেপ্টেম্বর মাসে কলকাতায় এলেন।

মুজিবনগর সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের কাছে তাঁরা তাঁদের পরিকল্পনার কথা বললেন। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী বোমা বিস্ফোরণ পরিকল্পনার সঙ্গে একমত হলেন না। তিনি এ ধরনের অভিযানের সাফল্যের সম্ভাবনা এবং ব্যর্থতার আশঙ্কার পাশাপাশি প্রবাসী সরকারের আর্থিক সংকটের কথা বললেন। তাঁদের সংগৃহীত অর্থ তিনি সরকারি তহবিলে প্রদান করার আহ্বান জানালেন।

কিন্তু সরকারি তহবিলে অর্থ প্রদান না করে মুক্তিযোদ্ধাদের সরাসরি সাহায্য করার উদ্যোগ নিল ‘হেল্প বাংলাদেশ’।

‘হেল্প বাংলাদেশ’-এর পক্ষ থেকে সীমান্ত এলাকায় খাদ্যগুদাম নির্মাণের যে পরিকল্পনা করা হয়েছিল, এ ব্যাপারে ভারত সরকারের ইতিবাচক মনোভাব লক্ষ করা গেল। কিন্তু খাদ্যগুদাম নির্মাণ, খাদ্য সংগ্রহ ও সরবরাহ প্রচুর ব্যয়সাধ্য কাজ। ফজলে হাসান আবেদ প্রয়োজনীয় অর্থ সংগ্রহের উদ্দেশ্যে লন্ডনে এলেন। আর খাদ্যগুদাম নির্মাণের জন্য ভারত সরকারের অনুমতি লাভের কাজে ভিকারুল ইসলাম চৌধুরী রয়ে গেলেন কলকাতায়। লন্ডনে অর্থ সংগ্রহ অভিযান জোরেশোরে এগিয়ে চলল। ব্রিটেনের বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় এ জন্য আকুল আবেদন জানানো হয়েছিল। আর সেই আবেদনে সাড়াও মিলেছিল প্রচুর।

মুক্তিযুদ্ধকালে ‘অ্যাকশন বাংলাদেশ’ লন্ডনে বিভিন্ন সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডও পরিচালনা করেছিল। লন্ডনস্থ মার্কিন দূতাবাসের সামনে একবার আয়োজন করা হয়েছিল একটি পথনাটকের। পাকিস্তানি সেনাদের নির্যাতন এবং মুক্তিসেনাদের অগ্রযাত্রার আলেখ্য ছিল এই নাটকের বিষয়বস্তু। নাটকটি ব্রিটিশ টেলিভিশনেও প্রচারিত হয়েছিল।